‘মিনুকে’ জেল খাটানো সেই কুলসুমা গ্রেপ্তার

52

নিজস্ব প্রতিবেদক

নগরীর রহমতগঞ্জে একটি ভাড়া বাসায় পোশাককর্মী পারভিন হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি কুলসুমা আক্তার ওরফে কুলসুমীকে অবশেষে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত বুধবার দিবাগত রাত তিনটার দিকে ইপিজেড থানাধীন দুই নম্বর মাইলের মাথা এলাকার কমিশনার গলি থেকে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। এসময় মর্জিনা আক্তার নামে তার এক সহযোগীকেও আটক করা হয়। যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি কুলসুমা প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে নিজের বদলে নিরাপরাধ সেই মিনু আক্তারকে কারাগারে পাঠিয়েছিলেন। পরে বিষয়টি জানাজানি হলে উচ্চ আদালতের নির্দেশে মিনু কারাগার থেকে মুক্তি পান। কারামুক্তির ১৩ দিনের মাথায় মিনু সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন।পুলিশ জানিয়েছে, খুনের মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি কুলসুমা আক্তার ও তার সহযোগী মর্জিনা আক্তারসহ আরও কয়েকজনের যোগসাজশে নিরাপরাধ মিনু আক্তারকে অর্থের প্রলোভনে পারভিন হত্যা মামলার আসামি সাজিয়ে হাজতবাস করানোর ঘটনায় কোতোয়ালি থানায় একটি মামলা করা হয়েছে। এসআই আকাশ মাহমুদ ফরিদ বাদী হয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার পেনাল কোড- ১৮৬০ এর ৪১৯/১০৯ ধারায় মামলাটি করেন। ওই মামলায় কুলসুমা ও মর্জিনাসহ অজ্ঞাতনামা আরও কয়েকজনকে আসামি করা হয়েছে। পরে ওই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে হাজির করার পর বিচারক তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। কুলসুমার বাড়ি লোহাগাড়া উপজেলায়।
কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নেজাম উদ্দিন জানান, গ্রেপ্তারের পর থানায় প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে কুলসুমা আক্তার তার পূর্ব-পরিচিত মর্জিনা আক্তারের মাধ্যমে মিনু নামে এক প্রতিবেশিকে খুনের মামলায় নিজের পরিবর্তে সাজা খাটার জন্য জেলে পাঠানোর কথা স্বীকার করেছেন। এ ঘটনায় পুলিশের দায়ের করা মামলায় কুলসুমা ও মর্জিনাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতে রিমান্ড আবেদন দাখিল করা হবে। রিমান্ড মঞ্জুর হলে তাদের জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে একজনের বদলে অন্যজনকে আসামি সাজিয়ে জেল খাটানোর নেপথ্যে থাকা পুরো চক্রটিকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে।
পুলিশ সূত্র জানায়, ২০০৬ সালের ২৯ মে রহমতগঞ্জ এলাকার সাঈদ সওদাগরের ভাড়া ঘরে মোবাইলে কথা বলার ঘটনা নিয়ে বিবাদের জেরে পোশাককর্মী পারভিনকে গলাটিপে হত্যা করা হয়। এরপর নিহতের লাশ কলোনির ভেতর একটি গাছের সঙ্গে গলায় ফাঁস দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হয়। তখন পারভিন আত্মহত্যা করেছে বলে দাবি করেন ওই ভাড়া বাসার আরেক বাসিন্দা ও পোশাককর্মী কুলসুমা আক্তার। এ ঘটনায় থানায় শুরুতে একটি অপমৃত্যু মামলা হলেও তদন্তে হত্যার তথ্য-প্রমাণ বেরিয়ে আসে। ওই বছরের ৬ জুলাই অপমৃত্যু মামলাটি হত্যা মামলায় রূপান্তর করা হয়। দুই বছরের তদন্ত শেষে ২০০৮ সালে কুলসুমা আক্তারকে আসামি করে আদালতে মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ। তদন্ত চলাকালে ২০০৭ সালের ২৬ অক্টোবর পারভিন হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যান আসামি কুলসুমা। অভিযোগপত্র দাখিলের পর ২০০৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি তিনি জামিনে মুক্তি লাভ করেন। আসামি কুলসুমা জামিনে থাকাবস্থায় মামলার বিচার কার্যক্রম সম্পন্ন হয়। ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর তৎকালীন চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. নুরুল ইসলাম পারভিন হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে আসামি কুলসুমা আক্তারকে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদন্ড ও নগদ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও এক বছরের সশ্রম কারাদন্ডের আদেশ দেয়া হয়। রায় ঘোষণার সময় আসামি কুলসুমা আদালতে গরহাজির থাকলেও খোঁজ নিয়ে সাজা হওয়ার বিষয়টি অবগত হন। এরপর দন্ডপ্রাপ্ত কুলসুমা তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী মর্জিনা আক্তারসহ অজ্ঞাতনামা আরও কয়েকজন মিলে সংঘবদ্ধ একটি চক্রের মাধ্যমে মিনু আক্তার নামে হতদরিদ্র এক নারীকে অর্থের প্রলোভনে ফেলে তাকে কুলসুমা সাজিয়ে হাজতবাস করানোর পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনা মোতাবেক ২০১৮ সালের ১২ জুন মিনু আক্তারকে মিথ্যা পরিচয় দিয়ে কুলসুমা আক্তার সাজিয়ে আদালতে আত্মসমর্পণ করানো হয়। সাজাপ্রাপ্ত প্রকৃত আসামি কুলসুমার বদলে শুরু হয় মিনুর হাজতবাস।
এদিকে, চলতি বছরের গত ২৩ মার্চে পারভিন হত্যা মামলার প্রকৃত আসামি কুলসুমার বদলে মিনুর হাজতবাসের খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে ওইদিনই চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ হাইকোর্টে বিচারাধীন ওই মামলার বিষয়ে প্রতিবেদন প্রেরণ করেন। প্রতিবদনে বলা হয়, প্রকৃত আসামি কুলসুমা আক্তারের পরিবর্তে মিনু আক্তার নামে আরেকজন কারাগারে সাজা ভোগ করছেন। জেল সুপারও কারা রেজিস্ট্রারে থাকা দু’জনের ছবির মিল খুঁজে না পাওয়ার বিষয়টি নজরে আসার পর লিখিতভাবে আদালতকে জানান। এরপর উচ্চ আদালতের নির্দেশে গত ১৬ জুন মিনু আক্তার কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন। কারামুক্তির ১৩ দিনের মাথায় গত ২৮ জুন দিবাগত রাতে নগরীর বায়েজিদ-ফৌজদারহাট সংযোগ সড়কের আরেফিননগর এলাকায় দ্রুতগতির একটি ট্রাক মিনুকে চাপা দিয়ে পালিয়ে যায়। ট্রাকচাপায় গুরুতর আহত হন তিনি। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এনে ভর্তি করায়। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৯ জুন ভোরে মারা যান তিনি। নাম-পরিচয় না পাওয়ায় একদিন পর অজ্ঞাতনামা হিসেবে তার লাশ দাফন করে বেসরকারি সংস্থা আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম। পরে মিনুর ভাই রুবেল হোসেন ছবি দেখে বোনের পরিচয় নিশ্চিত করেন।
মিনুর বড় ভাই মো. রুবেল হোসেন বলেন, মানসিক প্রতিবন্ধী ও নিরাপরাধ তার বোনকে প্রলোভনে ফেলে যারা জেল খাটিয়ে জীবনটা ধ্বংস করে দিয়েছে, তাদের উপযুক্ত শাস্তি দাবি করেছেন। তিনি জানান, ছোট বোন মিনু মানসিক প্রতিবন্ধী এবং তার কোনও স্বামী ছিল না। কিন্তু তিন সন্তানকে মানুষ করতে মিনু কখনও ভিক্ষা করতেন, আবার কখনও মানুষের বাসায় বুয়ার কাজ করতেন। সন্তানদের লালন-পালন ও যাকাতের টাকা দেয়ার কথা বলে তার বোনকে কারাগারে পাঠানো হয়। শেষপর্যন্ত তার বোন দুনিয়া থেকেই চিরবিদায় নিয়েছে। যারা তার নিরাপরাধ বোনের জীবনকে এমন করুণ পরিণতির দিকে নিয়ে গেছে, তাদের শাস্তি হওয়া উচিত।