মিঠে শাস্তি

78

হাসনাত সৌরভ

তলপেট টনটন করছে। পেচ্ছাপ পেয়েছে। খাটো লুঙ্গিখানা গুটিয়ে শওকত উঠেই পড়ল। ভোরের আলো ফুটতে দেরি আছে। ঝিঁঝিঁর ডাকে কান পাতা দায়। বাঁশের দরজাটা সাবধানে ঠেলে উঠোনে বেরুবে। ঘোঁ-ঘোঁ, ফুরুর ফুৎ করে নাক ডাকার আওয়াজ আসছে ওর বাপের। উঠোনে নামতে গিয়ে বুকটা মশারির দড়িতে আটকে গেল। আর তৎক্ষণাৎ “ফুরুর-ফুৎ” বন্ধ হয়ে গেল।
“কে রে ওখেনে? কেডা?”
বাপের ফাটা বাঁশ গলায় কালো মেঘের গর্জন। শওকত কেশো গলায় মিনমিন করে বলে,
“মুই গো, আব্বা।”
বাপের বোধহয় ঘুমের ঘোর কাটেনি।
“মুই বলে ত! মাথাডা ফাটিয়া রাখি দুব, মুইডা কেডা? চিনুস ত আকবর আলিকে।”
চেনা শোনা তো জন্ম থেকে, শওকত ভাবে। মুখে বলে,
“মুই শওকত গো আব্বা। জোর পিসাব লাগে।”
বাপ মশারির ভেতর উঠে বসেছে এবার মালুম হয়।
“অ, তা উঠছু যখন উনানশাল থিকা লণ্ঠনখান আনিয়া দিস ত।”
বাপের বিড়ির নেশা পেয়েছে। শওকত তখন উঠানের বাঁদিকে খড়গাদার পাশে জল ছাড়ছে। আঃ কি আরাম! আঁধারে এখন চোখ সয়ে এসেছে। উনানশাল থেকে টিমটিমে লণ্ঠনটা তুলে এনে বাপের মশারির পাশে রেখে ঘরে ঢুকতে গিয়ে থমকে দাঁড়ায় শওকত। মাথায় খেলে যায়, উঠেই যখন পড়েছে, আজ তবে বিশ্বাসদের তাল কুড়োনোই যায়। ওরম ধামা ধামা কালোপানা মিঠে তাল এ চত্বরে কোথাও নেই। তালের পিঠা বড় ভালো লাগে খেতে। পিঠা করতে যদিও তেল লাগে। পিঠা না হলে তালের রুটিও কিন্তু বেশ লাগে খেতে। রেশনে গম নিজেই এনেছে এ হপ্তায় তিন কেজি। যেমন ভাবা তেমনি কাজ।
আকবর আলির সেই যে ঘুম ভেঙেছিল, আর ঘুম আসেনি। বিড়ি টানতে টানতেই বড়র ডাক এলো। সেসব মিটিয়ে টিটিয়ে একেবাওে গোসল করে মালুম হল বহুদিন মসজিদে গিয়ে ফযরের নামাজ পড়া হয়নি। যেমন ভাবনা তেমনি কাজ। মনটা বেশ ভালো হয়ে গেল ভেবেই। ধোয়া লুঙ্গি আর একটা পরিষ্কার ফতুয়া গলিয়ে দাঁড়িতে হাত বুলোতে বুলোতে আকবর চলল মসজিদের পানে। নামাজ আদায় করে বাড়ি ফিরছে যখন, তখন দেখে শওকতের আম্মা হন্ডদন্ড হয়ে আসছে।
“আর ঘরকে যাতি হবে নি, বিশ্বাস বাড়ি চলেন। তুমার ব্যাটাকে নাকি তারা বাঁধিয়া রাখছে।”
“বাঁধিয়া রাখছে? কেনে বাঁধিয়া রাখছে? কিডা করছে মোর বেটা?”
“চল না কেনে? এসতে বলছি আসবা না ইখানপরেই চিল্লাইবা?”
“হাঁ হাঁ, চল চল। আরে ও মাতিন, অই শাহিন, অ শানিউর চল না কেনে। শওকতকে বিশ্বাসবাড়ির লোকে বাঁধিয়া রাখিছে শুনি। কিডা করিছে কি জানি!”
‘‘এই যে আকবর, দলবল নিয়ে চলে এসেচিস যে দেখি, এ্যাঁ! ঊলি ছেলেকে রাত্রিতে চুরি করতে পাঠিয়ে দিস, তাপ্পর সক্কাল সক্কাল দলবল নিয়ে ছাড়াতে চলে আসিস, তোদের দিনকাল তো খুব ভালোই চলছে, এ্যাঁ!’’ বিশ্বাসবাড়ির মেজকর্তা রোয়াকে বসে তারিয়ে তারিয়ে কথাকটি যখন বলছেন, আকবর দেখল সামনের পুকুর পাড়ের লাগোয়া নারকেল গাছে শওকতকে পিছমোড়া করে বেঁধে রেখেছে।
‘‘কি চুরি করছে মোর বেটায়?’’ প্রশ্ন করে শতকতের আম্মা।
‘‘তুই থাম শওকতের আম্মা। মেয়েছেলা মেয়েছেলার মত থাকবি। বাবুর সাথে মুই কথা কইতিছি। তুই রা কাড়বিনি, এই বলে দিনু। অ, মেজকত্তা ইবারের মত ছাড়ি দাও। মোর বেটা কুনদিন এমন কাজ করতে পারেনা। কিরে মাতিন, কুনদিন শুনছু শওকত কারো কুনো জিনিসে হাত দিছে, ক না কেনে।’’
‘‘হ্যাঁ, হ্যাঁ…. একদম ধর্মপুত্র তোর বেটা। বলি পাঁচিল ডিঙোয়ে ঢুকেছিল কি হাওয়া খেতে? নারকেল গাছে না উঠলে ওকে ধরত কার সাধ্যি! গণেশ…গণেশ….এই গনশা, ব্যাটা কালা….ইদিকে আয়, ওটার হাতদুটো খুলে দে তো। শোন আকবর, তোর ব্যাটাকেই জিজ্ঞেস কর, কি করতে এয়েছিল। আর শোন, আমরা ভদ্রলোক। তোদের মতো কথা নেই বার্তা নেই বেধাড়াক্কা মারধর করিনি। ও স্বীকার করুক, ছেড়ে দেব।’’
শওকত এবার ফোঁপাতে ফোঁপাতে শুরু করল, ‘‘না না মোকে ছাইড়বেননি, মারেন, মোকে মারেন। মুই দোষ করছি। তাল কুড়–ইতে কুড়–ইতে কি হইল কে জানে, নারকেলের কথা মনে হইল। লোভে পইড়ে এমন কাজ করছি মুই, মোরে মারেন কর্তা। তালের পিঠা আর কখুনো খাইতে মন করবনি।’’
‘‘এই তো, ঘরের লোকজন দেখে বুলি ফুটেছে! তা বল, কদ্দিন এসব চলছে, এ্যাঁ, কদ্দিন চুরি চামারি করছিস?’’ মেজকর্তার মুখের কথা শেষ হবার আগেই ধপধপে সাদা কাপড়ে তুলতুলে চাঁপাবরণ বেঁটেখাটো একটি মানুষ বেরিয়ে এলেন। হাতে একটি কাটারি। ইনি বিশ্বাস বাড়ির বড়মা। গড়নে খাটো হলেও আওয়াজ বড়ই তীক্ষè।
“এ্যাই মেজ, বলি সকাল সকাল কি ক্যাঁচর ম্যাচর লাগিয়েচিস রে এ্যাঁ? আজ জন্মাষ্টমীর দিনে একটা বাচ্চা ছেলেকে নাকি তুই বেঁধে রেখেচিস, গণশা বলল।’’
এবার বড়মার চোখ পড়ল শওকতের ওপর। ছুটে গিয়ে তার মাথায় গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন বড়মা।
‘‘আহারে, কি নির্মল, আদুরে গো! বলি তুই ভেবেচিসটা কি বল দেকি মেজ? তাল কুড়োতে পাঁচিল টপকেচে তো কি এমন মহাভারতটা অশুদ্ধ হয়েছে, এ্যাঁ! বৌমা সকাল থেকে বলছে, পুকুরের পাড়ে কাঁঠালিকলার কাঁদিটা পেড়ে আনতে, তার বেলা মুরোদ নেই, এখানে উনি বাচ্চাছেলের উপর কর্তাগিরি ফলাচ্ছেন। বলি ও বাবারা, তোমরা কি পশ্চিম পাড়ার? তা বাবারা এয়েছ যখন, এ বেলা খেয়ে যেও। আজ অবিশ্যি নিরামিষ। তা আমার ছেলের কথায় কিছু মনে করিওনা তোমরা, কেমন? এ্যাই গণেশ, বলি এদের ভেতরে নে গিয়ে বসা।’’
মেজকর্তা কি একটা বলতে যাচ্ছিলেন। তাকে থামিয়ে বড়মা হাতে কাটারিটি ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
‘‘যা আগে কলা কাঁদিটা কেটে আন দিকি। আমি দেখচি এদিকটা।’’
আকবর ছুট গিয়ে বড়মার হাত থেকে কাটারি নিয়ে বলল,
“কত্তারে কাটতে হবেনি, মুই কাটিয়া দিতিছি, মোকে দাও কাটারি। কলাকাঁদির কষ মেলা। কাপড়ে চোপড়ে দাগ লাগি যাবে।’’
বড়মা খুশি হয়ে বলেন, “বাবা, তোমার গায়েও তো পরিষ্কার জামা, খুলে রেখে যাও। আর মোচাটাও বের করে দিও। নারকেলও কটা পেড়। নারকেল দিয়ে মোচার ঘন্ট হয়ে যাবে আজ তবে। তোমার ছেলের জন্য আমি নিজে তালের পিঠে বানাতে বসব এখন। এ্যাই ছেলে চল, তাল মেড়ে দিবি। খাবি যখন, একটু খাটবি না, বল?’’
সবাই হৈ হৈ করে উঠল, “ঠিক ঠিক, এই হল গে চুরির শাস্তি’’ তালের পিঠে, বড়ই মিঠে।