মা একটি বেহেস্তের নাম

15

 

‘মা’ অতি ছোট্ট একটি শব্দ। কিন্তু এর গুরুত্ব এবং মর্যাদা কতটুকু তা বলে শেষ করা সম্ভব নয়। কিন্তু এমন দয়ালু এবং মর্যাদাবান মানুষটিকে কখনো কি আমরা সঠিক ভাবে মর্যাদা দিতে পেরেছি? যে মানুষটি আমাদের ১০ মাস ১০ দিন গর্বে ধারণ করে প্রসব যন্ত্রণা সহ্য করে এই সুন্দর পৃথিবীতে মুক্ত ভাবে শ্বাস নিতে দিচ্ছে, আমরা সেই মানুষটিকে বিনিময়ে কি দিচ্ছি? অনেকেই হয়তো মাকে হাক ভর্তি টাকা দিচ্ছেন কিংবা ভালো ভালো খাবার খাওয়াচ্ছেন। কিন্তু মা কি চায় সেটা কি বুঝতে চেয়েছি?
আমরা কি কখনো চিন্তা করে দেখেছি মা আমাদের জন্য কি করে বা মূলত আমাদের কি দেয়। ক’জন মা তার সন্তানকে ভালো খাবার কিংবা প্রচুর টাকা দিচ্ছে। ক’জন মা তার সন্তানকে দামি গাড়িতে করে দামি শপিংমলে নিয়ে যাচ্ছে। সব মায়েরাই এসব তাদের সন্তানদের দিতে পারে না। কিন্তু এসব মায়ের ভালোবাসার কাছে মামুলি এবং তুচ্ছ। কারণ মায়েরা যা দেয় তা পৃথিবীর কেউ কখনোই দিতে পারবে না আমাদের। আমরা শপিংমলের দামি কাপড়টি কিংবা রেস্টুরেন্টের দামি খাবারটি পরে আবার পাবো। কিন্তু মায়ের ভালোবাসা একবার মিস হলে তা কখনোই ফিরে পাওয়া সম্ভব না।
যাইহোক, মূল কথায় আসি, প্রতিটি সন্তান-ই জানে আমাদের মা আমাদের জন্য কতটা কষ্ট করে এবং কতটা ভালোবাসে। কিন্তু আমরা আমাদের মাকে কতটা ভালোবেসেছি কিংবা ভালোবাসা দিয়েছি? হ্যাঁ। অন্তরে মায়ের জন্য প্রচুর ভালোবাসা রয়েছে কিন্তু কখনো প্রকাশ করিনি। এমনো অনেকে রয়েছে। কিন্তু মা তো তার ভালোবাসা অন্তরে রেখে দেয়নি, তিনিতো তার ভালোবাসা আমাদের দিয়ে দিচ্ছেন। আমরা কেনো মায়ের জন্য ভালোবাসা অন্তরে রেখে দিবো। আমরা এমনো কিছু সন্তান রয়েছি যারা মাকে ভালোবাসতে পারিনা আবার কষ্ট দিতে জানি। আমরা যখন বাইরে গিয়ে বন্ধু বান্ধবের সাথে আড্ডা দেই তখন মা কল দিলে আমরা অনেকেই বিরক্ত বোধ করি। কিন্তু একবারও চিন্তা করিনা মা কেমন আছে, সে কার সাথে কথা বলছে, তার কি কোনো সমস্যা হয়েছে কিনা। আমরা এসব একটুও ভাবি না। আমরা এমনিতে সমাজের সামনে লোক দেখানো মায়ের প্রতি ভালোবাসা অধিক পরিমাণে দেখায়। ‘মা দিবস’ আসলে লাফিয়ে লাফিয়ে বলি মা আমি তোমাকে ভালোবাসি। ফেইসবুকে মায়ের জন্য ভালোবাসার বাণী লিখে ভরিয়ে ফেলি। কিন্তু বাস্তবে আমরা কি করি সেটা আমাদের চাইতে ভালো কেউ বলতে পারবে না। আমরা বন্ধুবান্ধবের সাথে কিংবা প্রেমিক প্রেমিকার সাথে বড় বড় রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাবার খেয়ে থাকি। কিন্তু একবারও কি ভেবে দেখেছি মা তখন কি খাচ্ছে, কার সাথে খাচ্ছে, কিভাবে খাচ্ছে। না, সত্যি বলতে কখনোই এমনটা ভাবিনি আমরা কেউ। আমরা অসুস্থ হলে মা আমাদের জন্য পারে না জীবনটা দিয়ে দিতে। তখন মা আমাদের জন্য কি করে কিংবা কেমন করে সেটা আমরা ভালো ভাবেই জানি। কখনো খেলায় কিংবা অন্য কোথাও আহত হলে মায়ের অবস্থা কেমন হয় সেটাও আমরা নিজেরাই দেখেছি। কিন্তু আমরা মায়ের অসুস্থতার সময় কি করেছি? কখনো জানতে চেষ্টা করেছি ‘মা তুমি কেমন আছো?’। কখনো কি জানতে চেষ্টা করেছি ‘মা তোমার শরীর ভালো আছে?’। আমরা কিন্তু সামন্য মাথাব্যথা হলেও মাকে এসে বলি, ‘মা আমার ভালো লাগছে না’। কিন্তু মায়ের গুরুতর অসুখের কথাও আমাদের কখনো বলেনা কিংবা আমরা জানতে চেষ্টা করিনা। শরীরে অসুস্থতা নিয়েও রান্না করে যায় আমাদের পছন্দের এবং প্রিয় খাবারটি। ঘরের সকল কাজ নিশ্চুপ ভাবে করে যায়। বুজতে দেয় না কষ্ট হচ্ছে কিংবা আর পারছে না। আর আমরা কয়জনেই বা বুঝতে চেষ্টা করি। আসলে এটায় আমাদের নিয়ম। আমরা যখন বুঝতে শিখি কিংবা একটু বড় হয়ে যায় তখন আর মাকে মূল্যই দিই না। মায়ের সাথে পরামর্শ কিংবা কোনো ধরনের কথা শেয়ারও করি না। আমরা তখন নিজেরা একটু বেশিই বুঝি। এরপর মায়ের ভুল ধরতে শুরু করি। মাকে ধমক দিতে শুরু করি। আমরা বাবাকে যেমন তেমন মান্য করলেও মাকে কখনোই মান্য করিনা। শুনতে খারাপ লাগলেও এগুলোই আমাদের চরম অপ্রিয় সত্য। মা আমাদের কিছু বারণ করলেও আমরা সেটা তেমন তোয়াক্কা করিনা। আমরা নিজেদের মতো নিজেরাই চলি। একটা সময় এসে আমরা প্রেমিক প্রেমিকার কথা যেভাবে মূল্য দিই, সেভাবে মায়ের এক শতাংশ কথাও মূল্য দিই না।
আমাদের কাছে তখন ভালোবাসার মানুষ হয়ে দাড়ায় ওই প্রেমিক প্রেমিকারাই। তাদের জন্য আমরা অনেক সময় জীবনও দিয়ে দিতে পারি, কিন্তু আমাদের যে মানুষটি শূন্য থেকে এই পর্যায়ে আসতে সাহায্য করেছে তার জন্য কিছুই করতে পারিনা। প্রেমিক প্রেমিকাকে বলতে পারি “তুমি না খেলে আমি খাবো না”, কিন্তু মাকে কখনো বলিও না “মা খেয়েছো”। এটায় আমাদের অদ্ভুত ভালোবাসা। ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য কে আর পাচ্ছে কে! এদিক থেকে চিন্তা করলে আমরা নিজেরাই বিবেকহীন এবং অসৎ। কারণ যার প্রাপ্য জিনিস তাকে না দিলে সেটা কখনোই সততার মধ্যে পড়ে না। আমাদের সমাজে এমনও অনেক মানুষ রয়েছে যারা আজ মাকে ভালোবাসতে চাইলেও পারছেনা। কারণ আজ তাদের মা নেই। যখন ছিলো তখন হয়তো সেই সুযোগটি পাইনি। আজ সময় এসছে কিন্তু মা নেই। এমনো হাজারও মা হারা সন্তান এই সমাজে রয়েছে। কিন্তু যাদের আছে তারা মাকে কতটুকু সম্মান, ভালোবাসা দিচ্ছি। সমাজে এমনও কিছু সন্তান রয়েছে যারা তার জন্মদাত্রী মায়ের শরীরে হাত তুলতেও দ্বিধা করে না। হয়তো ১০ মাস ১০ দিন গর্বে ধারণ করার বিনিময়ে এই সম্মানটুকু দিয়েছে তার গর্বধারিনী মাকে। আমার কথা হচ্ছে সম্মান দিতে না পারলেও অসম্মান কেনো করবো আমরা মাকে। কোন অপরাধের বিনিময়ে মায়ের উপর আঘাত করবো। শারীরিক কিংবা মানসিক সবভাবেই মাকে আমরা অনেকেই এখন আঘাত করে থাকি। আসলে এটা ১০ মাস ১০ দিন গর্বে রাখার পুরস্কার, প্রসব ব্যথা সহ্য করে সন্তানকে জন্ম দেওয়ার পুরস্কার, শিশু কালে আমাদের লালন পালন করার পুরস্কার, নিজে না খেয়ে আমাদের খাওয়ানোর পুরস্কার।
এতোকিছুর পরেও সন্তানের জন্য মায়ের মনে ভালোবাসা ব্যতীত আর কিছুই থাকে না। আমরা অপরাধ করলে মা সবসময় আমাদের ক্ষমা করে দেয়। মা শুধু চায় আমরা যেনো ভালো থাকি এবং সুন্দর থাকি। মা যদি না ফেরার দেশেও চলে যায় সন্তানের মঙ্গল কামনা সেখান থেকেও করবে। কারণ সে তো “মা”। মা চায় আমরা শুধু তাকে মা বলে ডাকি আর একটু ভালোবাসি। কিন্তু আমরা মাকে “মা” ডাকার মতো সময়ও আজকাল পাই না। একবার চিন্তা করে দেখিতো আমরা দিনে কয়বার মাকে “মা” বলে ডেকেছি। ফলাফল খুবই নিম্ন হবে। এটা অসম্ভব কিংবা অবাস্তব কিছু নয়। আমরা যতটাই বড় হচ্ছি ততটাই মায়ের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। এমনও সন্তান রয়েছে যাদের মা আজ বৃদ্ধাশ্রমে রাত কাটায়। হায়রে মা! ক্ষমা করে দিও তাদের। যেদিন তুমি থাকবে না সেদিন হয়তো তোমাকে অনেক অনেক খুঁজবো আমরা, কিন্তু পাবো না। আজ পেয়ে হারিয়ে ফেলছি মাকে। তবু জানি সন্তান মাকে কষ্ট দিয়ে থাকলেও মা সেটা ভুলে যাবে এবং সন্তানকে ক্ষমা করে দিবে। এটাই মায়েদের নিয়ম।
লেখক: প্রাবন্ধিক