মাহে রমজান আত্মশুদ্ধির এক অনন্য সুযোগ

39

চৌধুরী মোহাম্মদ মাহবুবুল আলম

বছর ঘুরে মুসলিম উম্মাহর দুয়ারে এলো রহমত, মাগফেরাত ও নাজাতের মাস পবিত্র মাহে রমজান। রোজা শব্দটি ফারসি। এর আরবি পরিভাষা হচ্ছে সওম। সওম অর্থ বিরত থাকা,পরিত্যাগ করা। ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায় সওম হলো আল্লাহর সন্তুটি কামনায় সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নিয়তসহকারে পানাহার ও যৌনসম্ভোগ থেকে বিরত থাকা। দ্বিতীয় হিজরির শাবান মাসে মুসলমানদের উপর রোজা ফরজ হয়েছিল। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, হে মুমিনগণ! তোমাদের প্রতি রোজা ফরজ করা হয়েছে যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের প্রতি, যাতে তোমরা আল্লাহভীরু হতে পারো, পরহেজগার হতে পারো। (সুরা বাকারা আয়াত ১৮৩)।
পবিত্র রমজান মাসে আল্লাহ্ তাআলা মহাগ্রন্থ আল কোরআন নাযিল করেছেন। হজরত আবু হোরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন রাসুলে পাক (সা.) বর্ণনা করেন, প্রত্যেক বস্তুর জাকাত রয়েছে, তেমনি শরীরেরও জাকাত আছে, আর শরীরের জাকাত হচ্ছে রোজা পালন করা। অর্থাৎ জাকাত দানে যেভাবে মালের পবিত্রতা অর্জন হয়, তেমনি রোজা পালনের মাধ্যমে শরীর পবিত্র হয়, গুনাহ মুক্ত হয়। হজরত সাহল বিন সাদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলে পাক (সা.) ইরশাদ করেন, জান্নাতের আটটি দরজা রয়েছে। এর মধ্যে একটি দরজার নাম ‘রাইয়ান’। এ দরজা দিয়ে শুধু রোজাদারগণ প্রবেশ করবেন। অন্যরাও এই দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে চাইবে। কিন্তু রোজাদার ব্যতীত অন্য কাউকে এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। (বুখারি ও মুসলিম)।
হাদিসে কুদসিতে, আল্লাহ্ তাআলা বলেন, ‘রোজা আমার জন্য আমি স্বয়ং তার প্রতিদান দেব’। রমজানের আগে করোনা সংক্রমণ ও নিত্যপণ্যের দাম দুটোই ঊর্ধ্বমুখী। করোনাকালে একদিকে মানুষের আয় কমে গেছে অন্যদিকে দ্রব্যমূল্যের দাম ঊর্ধ্বগতি। ফলে দৈনিন্দন আয় ও খরচের হিসেব মিলাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। সংসারের খরচ যোগাতে ধারদেনা করা, পুঁজি হারানো সহ নানা সংকটে দিশেহারা। অন্যান্য মাসের তুলনায় রমজান মাসে মুসলিমরা একটু বেশি আল্লাহ তায়ালার ইবাদত বন্দেগিতে লিপ্ত থাকেন। সেহেরি ও ইফতারে ভালো খাবারের আয়োজনের চেষ্টা করেন। ফলে এ মাসে খরচ একটু বেশি হয়। গত বছরের ৮ মার্চ প্রথম করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ার পর ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত প্রথমে ছুটি ঘোষণা করে দফায় দফায় ছুটি বাড়তে থাকে। সর্বশেষ ঘোষণা অনুযায়ী, টানা ৬৬ দিনের ছুটি শেষ হয় গত বছরের ৩০ মে। মানুষ লকডাউনে মাহে রমজান মাস অতিবাহিত করেছিলেন। পুরো সময়টা ছিল আতংক আর মৃত্যুর প্রহর গুণে। মাঝখানে করোনা সংক্রমণ কিছুটা কমলেও রমজানের আগে করোনা সংক্রণ বেড়েছে। এবারের করোনা ও দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতি সংক্রমণ দুটোই সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। সংক্রমণ রোধে এক সপ্তাহ (৫-১১ এপ্রিল) লকডাউনের কবলে দেশ।
আমাদের দেশে রমজান মাস সাধারণ মানুষের জন্য ইবাদতের মাস হলেও কিছু ব্যবসায়ী বিশেষত পাইকারদের জন্য গোনাহ কামানোর মাস। তারা গোনাহ কামানোর জন্য সারা বছর এ পবিত্র মাসটির অপেক্ষা করেন। এ পবিত্র মাসটিকে গোনাহ কামানোর জন্য বেচে নেন। পঁচা পণ্য বিক্রি, মজুদ ও কৃত্রিম পণ্য সংকট তৈরি করে নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে কোটি টাকা মুনাফা করে পাহাড়সম গোনাহ অর্জন করেন।
বিশ্বের অনেক দেশে রমজান মাসে দ্রব্যমূল্যের দাম কমিয়ে দেন। কিন্তু মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এ দেশে ব্যবসায়ীরা নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে দেন। তবে দ্রব্যমূল্যের দাম বৃদ্ধির জন্য সাধারণ মানুষের দায় কম নয়। যে কোন উৎসব উপলক্ষ্যে চাহিদার অতিরিক্ত বাজার করে পণ্য চাহিদা বাড়িয়ে ব্যবসায়ীদের দাম বাড়াতে উদ্বুদ্ধ করেন। সবখানে হুড়োহুড়ি,লাইন লাগিয়ে দেন।
এ সুযোগে পাইকার ও খুচরো ব্যবসায়ীরা কৃত্রিম পণ্য সংকট সৃষ্টি করে দাম বাড়িয়ে ক্রেতাদের পকেট কাটেন। তাই সাধারণ মানুষ যদি একইসাথে বেশি পণ্য কিনে মজুদ না করে স্বাভাবিক নিয়মে পরিমাণমত পণ্য কেনেন তাহলে দাম বাড়ার প্রবণতা কিছুটা কমে আসবে। মাহে রমজান মাসে আমরা শুধু পানাহার ত্যাগ করব তা নয়। সকল প্রকার অন্যায়, অনাচার, মুনাফা, প্রতারণা ত্যাগ করে একজন খাঁটি মুমিন পরিণত হব। ইবাদত, কোরআন তেলাওয়াত, দান, সদকা করব ও সকল প্রকার অনৈতিক কাজ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে একজন খাঁটি মুসলিমে পরিণত করব। আনুষ্ঠানিকতা নয় মাহে রমজান হোক আমাদের জন্য ত্যাগের মহিমায় শুদ্ধতার এক অনন্য মুহূর্ত ও সুবর্ণ সুযোগ।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও গণমাধ্যমকর্মী