মাহবুবে সোবহানী শেখ সৈয়দ মুহিউদ্দিন আবদুল কাদের জিলানী (রহ.)

303

মাহবুবে সোবহানী গাউসে ছমদানী পীরে লা-সানী শেখ সৈয়দ মুহিউদ্দিন আবদুল কাদের জিলানী আল গিলানী (রা.) পারস্যের জিলান নগরীতে ৪৭০ হিজরি ২৯ সাবান দুনিয়াতে শুভ আগমন করেন। পিতা আবুর সালেহ জঙ্গি, মাতা উম্মুল খায়ের ফাতেমা (রহ.)। তিনি পিতার দিক দিয়ে হযরত ঈমাম হাসান (রা.) এবং মাতার দিক দিয়ে হযরত ঈমাম হোসাইন (রা.) এর বংশধর।
পিতা আবু সালেহ জঙ্গি (রহ.) ছিলেন বিখ্যাত আলেমে দ্বীন ফরহেজগার শরিয়তের অলিয়ে কামেল। পবিত্র ইসলামের খেদমতে জিহাদে অংশগ্রহণের কারণে তাঁকে জঙ্গি উপাধীতে ভূষিত করা হয়।
আবু সালেহ জঙ্গি (রহ.) এক ভ্রমণে রোজার শেষে নদীর পানি দিয়ে ইফতার সম্পাদন করতে গেলে নদীর স্রোতে একটি ফল ভেসে যাচ্ছে দেখে ওই ফল নিয়ে ইফতার করে নামাজে দাঁড়িয়ে গেলেন। নামাজে রুহহানিয়তের অভাব দেখে বুঝতে পারলে অন্যের হক ফল খাওয়ার কারণেই এই ফল। তিনি ফলের মালিক খোঁজ কতে নদীর তীরে হাঁটতে হাঁটতে একটি ফলের বাগান দেখলেন। বাগানের মধ্যে এক কামিল বুজুরগ নামাজ পড়ছেন। নামাজ শেষ হলে বুজুরগ ব্যক্তিকে আবুল সাহেব জঙ্গি সবকথা খুলে বলেন এবং তাঁর ধারণা ফলটি এই বাগানের; তাই ক্ষমা অথবা মূল্য নেওয়ার আবেদন জানালেন। কামিল বুজুরগ বললেন, মূল্য নেব না, শর্ত পূরণ করলে ক্ষমা করতে পারি। শর্ত হলো আমার বোবা, আতুড় ও অন্ধ একটি মেয়ে আছে তাকে বিয়ে করতে হবে। হক্কুল ইবাদ (মানুষের হক) মানুষে মাফ না করলে আল্লাহ ক্ষমতা করে না বলেই সালেহ জঙ্গি বিয়েতে সম্মতি প্রদান করেন। বিয়ের মোহরানা বাবদ তাঁর কাছে কিছুই নেই বলে শ্বশুরের ফলের বাগানে দশ বছর চাকরি করার শর্ত মতে বিয়ের আক্দ হয়। বিয়ের পর দেখা গেল মেয়ে অন্ধ, বোবা, আতুড় কিছুই নয়। এ ব্যাপারে মেয়ের বাবার কাছে প্রশ্ন করা হলে তিনি জবাবে বলেন, আমার মেয়ে পর পুরুষের দিকে জীবনে দৃষ্টিপাত করেনি বলেই অন্ধ, বড় শব্দে কথা বলেনি বলেই বোবা, বাইরে কোথাও যাননি বলে আতুড় বলেছি। এই মহিয়সী মহিলা হযরত ফাতেমার গর্ভেই হযরত বড় পীর মহিউদ্দিন আবদুল কাদের জিলানী (রা.) জন্মগ্রহণ করেন।
গাউসে পাকের জন্মের পূর্বে পিতা আবু সালেহ জঙ্গি (রা.)কে রাসুলে পাক (দ.) স্বপ্নে বলেন, ‘আল্লাহ পাক তোমাকে এমন একটি সন্তান প্রদান করবেন যে আমার প্রিয়, আল্লাহর পছন্দনীয় এবং নবী রাসুলদের মধ্যে আমার যে মর্যাদা, আমার অলিদের মধ্যে তাঁর সে মর্যাদা প্রাপ্ত হবে।’
গাউসে পাকের সম্মানিত মাতা হযরত ফাতেমা (রহ.) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি অন্তঃসত্ত্বাকালীন অবস্থায় গর্ভে তাঁর ছেলের জিকির শুনতে পেতেন।
পীরানে পরী দস্তগীর শেখ ছৈয়দ আবদুল কাদের জিলানী (রহ.)এর জন্মদিন ২৯ শাবান আকাশ মেঘলা থাকার কারণে সন্ধ্যায় রোজার চাঁদ দেখা গেল কিনা মুসলমানদের নিকট সন্দেহ দেখা দিলে তৎকালের এক কামিল অলি বললেন, তোমরা আবু সালেহ জঙ্গির নবজাতক শিশুর নিকট গিয়ে দেখ যে আগামীকাল সকাল থেকে মায়ের দুধ পান করে কিনা, যদি করে তাহলে ধরে নিতে হবে শাবান মাস শেষ, ‘রমজান’ শুরু হয়েছে। দেখ গেল পরদিন ভোর হতেই নবজাতক মায়ের দুধ পান করছে না। সকলেই ধরে নিল রমজান মাস আরম্ভ হয়েছে। শুধু একদিন নয় পুরা রমজান মাস দিনের বেলা এই শিশু মায়ের দুগ্ধ পান করেননি।
মাহবুবে সোবহানী গাউসেপাক (রা.) এর শুভ জন্মদিনে বাগদাদে যত শিশু জন্মগ্রহণ করেন সবই ছেলে সন্তান এবং সকলেই এক এক জন পরবর্তীতে অলিয়ে কামিল হয়েছেন।
চার বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার পর গাউসে পাক (রা.)কে পড়াশোনার জন্য ওস্তাদের কাছে অর্পণ করলে ওস্তাদ পড়া শুরু করতে বলার সাথে সাথে তিনি আউজুবিল্লাহ, বিসমিল্লাহ, পড়ে কোরআনে পাকের প্রথম থেকে আঠারপারা মুখস্থ পড়ে শুনালেন। এসব কোথায় শিখলে? জবাবে তিনি বললেন, আমার মায়ের আঠারপারা কোরান মুখস্থ আছে, এই আঠারপারা সব সময় পড়তেন, আমি আমার মায়ের পেটে বসে এইগুলো মুখস্ত করেছি। তিনি অল্প বয়সে অবশিষ্ট বার পারা মুখস্ত করেছি। তিনি অল্প বয়সে অবশিষ্ট বারপারা মুখস্থ করে পূর্ণ কোরআনে হাফেজ হয়ে যান।
হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রা.) উচ্চ শিক্ষা অর্জনের জন্য বাগদাদ নগরীর যাওয়ার ইচ্ছা করলে বৃদ্ধা মা তাঁর কাপড়ের ভিতরে চল্লিশ দিনার সেলাই করে দিয়ে বললেন, কোন কারণেই যেন কখনো মিথ্যা না বলে। শিশু পুত্র সেই উপদেশ মনে রেখে বাগদাদগামী ব্যবসায়ী কাফেলার সাথে যাত্রা শুরু করেন। গভীর রাতে এই কাফেলা ডাকাত কর্তৃক আক্রান্ত হলে সকলের অর্থ মালামাল লুণ্ঠন হয়। শিশু আবদুল কাদেরের কাছে জিজ্ঞাসা করে এক ডাকাত, তোমার কাছে কি আছে? তিনি বললেন, চল্লিশ স্বর্ণমুদ্রা আমার মা কাপড়ের ভিতরে সেলাই করে দিয়েছে, তা আছে। বিস্মিত হয়ে ডাকাত বলল, তোমার কাছে কিছুই নেই বললে তোমার স্বর্ণমুদ্রা আমরা দেখতাম না। তিনি বললেন, আমার আম্মা আমাকে বিদায় দেওয়ার সময় বলেছেন, কখনো কোনো অবস্থায় যেন মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ না করি। আমি মায়ের উপদেশ পালন করছি। গাউসে পাকের মুখে একথা শুনে ডাকাতদের শরীর কাঁপতে শুরু করে এবং চেহারা পরিবর্তন হয়ে যায়। কাঁদতে কাঁদতে ডাকাত দল সকলের মালামাল অর্থ ফেরত গিয়ে গাউসে পাকের হাতে তাওবা করে।
তিনি বাগদাদ নগরীর বিখ্যাত মাদ্রাসায়ে নেজামিয়ার আলেমে দ্বীনের নিকট ব্যাপক ইসলামী শিক্ষা অর্জন করেন। কোরআন, হাদিস, শরীয়ত ও তরিকতের জ্ঞান অর্জনের পর ওয়াজ নসিহত শুরু করেন। তাঁর তকরির শোনার জন্য জ্বিন ও ইনসান একত্রিত হতো। ৫০/৬০ হাজার হতে আরম্ভ করে দেড় লক্ষ লোক পর্যন্ত মাহফিলে সমবেত হতো বলে ইতিহাসে বর্ণিত আছে। কয়েক শত আলেম কালি কলম নিয়ে তাঁর তকরির নোট করতেন। তকরির শুনে অনেক লোক বেহুঁশ হয়ে যেত এবং ইহজগত ত্যাগ করত।
একদিন গাউসে পাক (রা.) মসজিদের দিকে যাচ্ছিলেন, এক রুগ্ন ব্যক্তিকে দেখতে পেলেন হাঁটতে পারছেন না, নড়াচড়া করতে পারছেন না, তিনি গাউসে পাককে বললেন, আমাকে সাহায্য করুন, উঠান। তিনি হাতে স্পর্শ করার সাথে সাথে লোকটি সুস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। গাউসে পাক (রা.) তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কে? তিনি উত্তর দিলেন, আমি দ্বীনে ইসলাম। নবী করিম (দ.) আমাকে জীবিত করার পর অমুসলিমদের থেকে বহুগুণ বেশি মুসলমান নামধারীরা আমার উপর অত্যাচার করেছে। তাই আমার এই অবস্থা। এখন আপনার সাহায্যে আমি পুনরুজ্জীবিত হয়েছি। আপনি এখন থেকে মহিউদ্দিন (দ্বীনকে পুনরুজ্জীবিতকারী) তখন থেকে গাউসে পাকের নাম মহিউদ্দিন হিসেবে খ্যাতি অর্জন করে।
তিনি ৪০ বছর এশার অজু দিয়ে ফজরের নামাজ আদায় করেন। ১৫ বছর রাতে এক পায়ে দাঁড়িয়ে দু’রাকাত নামাজে ৩০ পারা কোরআন খতম করেন। ২৫ বছর মাঠে ময়দানে বনে জঙ্গলে অনাহারে জীবনযাপন করেন। ৩০ হতে ৪০ দিন পর্যন্ত অনাহারে সাওমে বেছাল (রাত দিন অনাহারে রোজা) পালন করতেন।
এই আওলীয়াদের সর্দার পীরানে পীর গাউসুল আজম কুতুবুল আকতার মাহবুবে সোবহানী গাউসে সমদানী শাহ সৈয়দ মুহিউদ্দিন আবদুল কাদের জিলানী (রা.) ৫৬০ হিজরীর ১১ রবিউস সানী ইহজগত ত্যাগ করে পরলোকে শুভগমন করেন।