মাস্টারদা বললেন-‘এ হচ্ছে প্রীতিলতা’

3

রেবা বড়ুয়া

প্রীতিলতা ওয়াদ্দাদার। ছোটবেলার নাম ‘রানী’। ১৯১১ সালের ৫ মে তিনি পটিয়া থানার ধলঘাট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম জগবন্ধু ওয়াদ্দাদার এবং মাতা প্রতিভা ওয়াদ্দাদার।
তিনি ১৯২৪ সাল চট্টগ্রাম শহরের ডা: খাস্তগীর উচ্চ ইংরেজি বালিকা বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন। যথন তিনি অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী তখন থেকেই বিপ্লবী মন্ত্রণা লাভ করতে থাকেন। উক্ত বিদ্যালয় থেকেই ১৯২৭ সালে তিনি ম্যাট্রিক পাশ করেন। ১৯২৯ সালে ঢাকার ইডেন কলেজ থেকে আই.এ পরীক্ষায় মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেন। আই.এ পাশের পর বিয়ের প্রস্তাব আসে। তিনি তা নাকচ করে দিয়ে ১৯২৯ সালে ভর্তি হন কলকাতার বেথুন কলেজে। কলেজের ছাত্রী নিবাসে থাকতেন। কিছুদিনের মধ্যেই বিপ্লবী দলের চট্টগ্রাম শাখার সদস্যদের সাথে তাঁর যোগাযোগ হলো। ওই বিপ্লবীদের মাধ্যমেই মাস্টারদা নির্দেশ পাঠালেন প্রীতিলতার কাছে। সেই নির্দেশ মোতাবেক কলকাতায় প্রীতিলতা গড়ে তুললেন একটা বিপ্লবী চক্র। অল্প সময়ের মধ্যেই এই বিপ্লবী চক্রে অনেক মেয়ে এসে যোগ দিল। কলকাতার একটি গোপন কারখানায় বিপ্লবীদের আয়োজনে বোমার খোল বানানো হয়। চট্টগ্রাম থেকে নির্দেশ আসে সেগুলো নিয়ে আসবার জন্য। পূজার ছুটিতে প্রীতিলতা, কল্পনা দত্ত, সরোজিনী পাল, নলিনী পাল ও কুমুদিনী রক্ষিত- অনেকগুলো বোমার খোল নিয়ে চট্টগ্রামে পৌঁছলেন। বোমার খোলগুলো বিপ্লবীরা তাঁদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে নিয়ে গেলেন। এই সূত্রেই বিপ্লবী অম্বিকা চক্রবর্তী ও নির্মল সেনের সঙ্গে চট্টগ্রামে তাঁদের পরিচয় ঘটে। প্রীতিলতা ফিরে যান কলকাতায়, বেথুন কলেজে।
চট্টগ্রাম থেকে সংবাদ গেল বিপ্লবী রামকৃষ্ণ বিশ্বাস, যিনি চট্টগ্রাম বিপ্লবী দলের সৈনিক, ধরা পড়েছেন ব্রিটিশ সৈন্যদের হাতে। তাঁকে আলিপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়েছে। রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের ছোট বোন পরিচয়ে প্রীতিলতা কারাগারে তাঁর সঙ্গে একে একে চল্লিশবার দেখা করেছেন। ফলে তাঁর মধ্যে একটা নতুন বিশ্বাসের জন্ম হয়। মৃত্যুপথযাত্রী এই দেশপ্রেমিকের সাহচর্য প্রীতির জীবনাদর্শকে পূর্ণতার দিকে এগিয়ে দিয়েছে। তখন থেকে প্রীতিলতা মরণপণ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হন।
বি.এ পরীক্ষা দেবেন, দেবেন না করেও শেষ পর্যন্ত পরীক্ষা দিলেন তিনি। সবগুলো পরীক্ষাই দিলেন। ১৯৩১ সালে বি.এ পাশও করলেন। তারপর চলে এলেন চট্টগ্রামে। চট্টগ্রামে এসেই প্রীতিলতা মাস্টারদার সঙ্গে দেখা করতে উদগ্রীব হয়ে ওঠেন। এরই মধ্যে হঠাৎ করেই দেখা হয়ে গেল কল্পনা দত্তের সঙ্গে। কল্পনা দত্ত বেথুন কলেজ থেকে আগেই ট্রান্সফার নিয়ে চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হয়েছে। কথায় কথায় জানলেন, সেও বিপ্লবে যুক্ত হতে সংকল্পবদ্ধ। মাস্টারদার সাথে যোগাযোগ করতে সেও উদগ্রীব।
চট্টগ্রামে নতুন একটি মধ্য-ইংরেজি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নন্দনকাননে। দানশীল ও বিদ্ব্যোৎসাহী অপর্ণাচরণ এই বিদ্যায়তনের প্রতিষ্ঠাতা। প্রীতিলতা ১৯৩১ সালে এই বিদ্যালয়েই প্রধান শিক্ষয়িত্রী পদে যোগদান করলেন।
চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র, এক তরুণ বিপ্লবীর মাধ্যমে কল্পনা দত্ত সংযোগ করে নিলেন মাস্টারদার সঙ্গে। রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের ফাঁসির আগে আলীপুর জেলে তাঁর সঙ্গে বহুবার সাক্ষাৎ করেছেন প্রীতিলতা, মাস্টারদা তাও জানেন। প্রীতিলতার মুখ থেকেই সাক্ষাৎকারের সকল কথা শুনতে উৎসুক মাস্টারদা। এই সংবাদ পেয়ে প্রীতলতাও অত্যন্ত ব্যগ্র হয়ে পড়েন। বিপ্লবীদের প্রধান কেন্দ্র ধলঘাট গ্রামের গোপন ঘাঁটিতে সর্বাধিনায়ক মাস্টারদা সূর্য সেনের সাথে প্রীতলতার সাক্ষাতের ব্যবস্থা হলো, ১৯৩২ সালের জুন মাসে। সাথী হলো ভোলা, আসল নাম অপূর্ব। সে মাস্টারদার একনিষ্ঠ ভক্ত, কর্মী। সে হলো প্রীতিলতার গাইড। গাইড অপূর্ব তাঁকে ধলঘাটের পূর্বপাশের গ্রাম রতনপুরের একটি বাড়িতে রাখে। এখানে প্রীতিকে সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকতে হবে, এই নির্দেশ জারি করে অপূর্ব চলে গেল। গ্রাম্য পরিবেশে সন্ধ্যার ছায়া নামতেই সে এসে হাজির। হাসি মুখে সামরিক কায়দায় অভিবাদন করে বলল, লক্ষ্যস্থলের দিকে এখনই আমাদের ‘মার্চ’ করতে হবে। ওখানে মাস্টারদার সঙ্গে সম্ভবত নির্মলদাও থাকছেন।
“অপূর্ব-এর সাথে আমার যাত্রা শুরু হয়। অন্ধকার গাঢ় হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। আমরা হাঁটছি আমাদের গন্তব্যের দিকে। অপূর্ব এলাকার অবস্থা বর্ণনা করছে।-
জালালাবাদ যুদ্ধের পর থেকে ওখানে একটি মিলিটারি ক্যাম্প বসছে। জেলা বোর্ডের রাস্তার পাশেই। ক্যাম্পের বিপরীতে বোর্ড অফিস। একটি বড় বটগাছ ক্যাম্পের কোণায়, বড় একটি পুকুরও। পঁচিশজন পুলিশ থাকে ক্যাম্পে। পুলিশগুলো পাগলা কুকুর যেন। ওরা আত্মগোপনকারী বিপ্লবীদের খোঁজে। ওদের নেতা সাহেব, ক্যাপ্টেন ক্যামারুন। সাহেব ক্যামারুনের স্বভাব বন্য মহিষের মত। সে গ্রামের কিশোর ও ছাত্রদের ধরে আনে ক্যাম্পে, বিপ্লবীদের কথা জিজ্ঞেস করে, জবাব না পেলে অকথ্য নির্যাতন চালায়’’ (বীরকন্যা প্রীতিলতা/বলাকা প্রকাশন)। বাঁ দিকে ঘুরে পথ চলতে শুরু করেন তাঁরা। অপূর্ব’র কথা আবার শুরু হলো, গরিব ব্রাহ্মণের বাড়ি। ঠাকুর জীবিত নেই, আছেন প্রৌঢ়া বিধবা সাবিত্রী দেবী। ওই বাড়িতে মাস্টারদা আর নির্মলদা হয়তো পৌঁছে গেছেন। ১৩ জুন, ১৯৩২ সাল। মাস্টারদা সূর্য সেন আর তাঁর সহযোগী বিপ্লবী নির্মল সেন সাবিত্রী দেবীর বাড়িতে পৌঁছলেন। সন্ধ্যে সাড়ে সাতটায়। আরো পাঁচ মিনিট পর অপূর্ব সেনের সাথে প্রীতিলতাও পৌঁছে গেলেন।
সাবিত্রী দেবীর দোতলা বাড়ি। মাটির দেওয়াল। তাঁরা ভিতরে প্রবেশ করলে অভ্যর্থনা জানাল। মাস্টারদা ও নির্র্মলদা ছাদে আছেন।
সাবিত্রী দেবী দরজার দিকে ফিরে বললেন, ‘এসো’। প্রীতিলতা চললেন তাঁর পিছনে। ছাদে যাওয়ার সিঁড়ির কাছে এসে বললেন, ‘ওপরে যাও’। ওপরে উঠতেই নেতাদ্বয় চোখ তুলে দেখলেন। প্রীতি প্রস্তরখোদিত মূর্তির মতো দÐায়মান। প্রীতির খোলা চোখ দুটি ওঁদের অবস্থানের দিকে। প্রদীপটি ওঁদের সামনেই। তারপরও তাঁদের দেহ প্রীতি দেখতে পাচ্ছে না। দেখছে শুধু চারটি চোখ, জ্বলন্ত চোখ থেকে, জ্যোতি স্ফুরিত হচ্ছে। কথা বললেন মাস্টারদা, এসো।
দুজনই বসেছেন ভেতরে, পাটিতে। মাস্টারদার পিঠ দেয়ালে হেলান দেওয়া। নির্মলদা পাটির কোণে। মাস্টারদা সোজা হয়ে বসে হাঁটু ভাঁজ করলেন। নির্মলদা পাটির শূন্য কোণে ইঙ্গিত করে বললেন, ‘বসো’। প্রীতি ধীরে ধীরে পাটিতে হাঁটু পেতে হাত বাড়ালেন মাস্টারদার পায়ের দিকে। মাস্টারদার প্রতিরোধ-ভঙ্গির হাত এল প্রীতির হাতের সামনে। মাস্টারদার গম্ভীর কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত হচ্ছে যাদুময় শব্দÑ ‘‘প্রীতি এখন স্কুলশিক্ষক নন, বিপ্লবী। বিপ্লবীদের প্রণাম করতেও নেই, নিতেও নেই, বিপ্লবীরা প্রণাম করে শুধু মা-মাটি-মাতৃভূমিকে। তুমিও বিপ্লবী, তুমিও এই নীতি মেনে চলবে। আমি যেমন এদেশের সন্তান, তেমনি তুমিও। তুমি-আমি পৃথক নই, একটি মাত্র পরিচয় ‘বিপ্লবী’, দেশমাতৃকার সেবক।’’এ এক অসাধারণ বাণী। বাড়িয়ে দেওয়া হাত স্তব্ধ। ভিতরের হৃদপিÐও যেন থেমে গেছে প্রীতির। সর্বাঙ্গ যেন দৃঢ় ইস্পাত হয়ে গেছে। হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে পড়েছে অজান্তে। প্রীতি তাকিয়ে আছে মাস্টারদার চোখের দিকে। প্রীতির চোখ বোধহয় আগুন ছিটকাচ্ছিল। সে কেমন আগুন! কঠিন মানুষ, অগ্নিপুরুষ মাস্টারদা প্রীতির চোখে আর চোখ রাখতে পারেননি, চোখ সরিয়ে নেন হঠাৎ।
প্রীতির হাতের ওপর অন্য একটি হাতের স্পর্শ। শিথিল হলো মুষ্টিবদ্ধ হাত, হৃদপিÐ চলছে এখন। প্রীতি দৃষ্টি ঘোরালেন ডান দিকে। ওখানে নির্মলদা। নির্মলদা তাঁর হাতের স্পর্শ দিয়েছেন প্রীতির মুষ্টিবদ্ধ হাতে। তিনি উচ্চারণ করলেন অপূর্ব এক ভঙ্গিতে- ‘মেরি চট্টলা নেহি দেউঙ্গি।’
এইসময় সিঁড়িতে দ্রæত পদচারণার শব্দ। তাঁদের দৃষ্টি লাফিয়ে পড়ে সিঁিড়র মুখে। অপূর্ব লাফিয়ে আসে ওপরে। উচ্চারণ করে একটি মাত্র শব্দ ‘পুলিশ’। মুহুর্তে লাফিয়ে ওঠেন মাস্টারদা ও নির্মলদা। ভোজবাজীর ভেলকির মতোই রিভলবার এসে পড়ে ওঁদের হাতে। মাস্টারদা প্রীতির উদ্দেশ্যে নির্দেশ বাক্য ছোড়েন Ñ‘নিচে চলে যাও, ওদের আত্মীয় পরিচয় দিও। যাও- তাড়াতাড়ি।’ প্রীতি থাকতে চাইলেন। ‘না’ বলে গর্জন করলেন মাস্টারদা। প্রীতি লাফ দিলেন সিঁড়ির দিকে। রিভলবার হাতে সিঁড়ির গোড়ায় চলে এল ক্যাপ্টেন ক্যামারুন। তার পিছনে পিছনে ঢুকল ক্ষুদে ব্রিটিশ বাহিনী ও পুলিশের দল। ক্যামারুন দ্রæত উঠছে সিঁিড় বেয়ে। পৌঁছে গেছে মাঝামাঝি। নির্মলদা সিঁড়ির মাথায়। গুড়–ম্… এক ঝলক আগুন বেরুল নির্মলদার রিভলবার থেকে। ক্যামারুনও গুলি ছোড়ে। আবার ওপরের আগ্নেয়াস্ত্র থেকে অগ্নিবর্ষণ হয়, গুড়–ম্ গুড়–ম্… প্রচÐ গোলাগুলির শব্দে বাড়ি কাঁপতে থাকে। ক্যামারুন হঠাৎ ছিটকে পড়ে নিচে। একটু হাত পা নেড়ে স্তব্ধ হলো ক্যামারুনের দেহ। গোলাগুলির শব্দ থেমে গেল। তার বাহিনী হতভম্ব। মাঝ সিঁড়ি থেকে লাফিয়ে পড়লেন মাস্টারদা। অপূর্ব সেন তাঁর পাশে। এত বড় বিপর্যয়েও চাঞ্চল্য নেই। রিভলবারের ট্রিগারে আঙ্গুল রেখে নির্দেশ দেন, অপূর্ব’র সাথে যাও।
প্রীতি ছুটলেন অপূর্ব’র সাথে। মাস্টারদা লাফিয়ে চলে এলেন তাঁদের পাশে অন্ধকারে। তাঁদের পায়ের তলায় পাতার ‘খস্-খস্’ শব্দ। গুড়–ম্ শব্দে প্রীতির পাশ থেকে অপূর্ব’র দেহটা পড়ে গেল। প্রীতি থমকে গেলেন হঠাৎ, কিন্তু মাস্টারদার হাতের টানে ছিটকে চলে গেলেন অনেক দূরে। সেখান থেকে গড়িয়ে গড়ের ভিতর। পানাভরা গড়, জলভর্তি, প্রচÐ ঠান্ডা। মাস্টারদাও প্রীতির পাশে লাফিয়ে নেমেছেন। কিন্তু কোনো শব্দ বা কথাবার্তা নেই। ধুপধাপ পা ফেলে এগিয়ে আসছে পুলিশ। শ্বাস নেওয়ার জন্য নাক ওপরে রেখেছেন শুধু। মাথার ওপরেও কচুরিপানার ডগা আর পাতা। তার ওপরে ঘন অন্ধকার।
প্রীতির মাথার ওপরের কচুরিপানার পাতার ওপর দিয়েও ছড়্ ছড়্ করে চলে গেল দুটো গুলি। দু’মিনিট পর আগুনের আলোয় আলোকিত হলো চারিদিক। দাউ দাউ জ্বলছে আগুন, জ্বলছে সাবিত্রী দেবীর বাড়িটি। ক্যামারুন হত্যার প্রতিশোধ নিয়েছে সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী।
চারিদিক নিস্তব্ধ। পাশের পানা নড়ল। চাপা কণ্ঠ মাস্টারদার, ওপরে উঠব, এসো। পানা সরিয়ে চলে গেলেন প্রীতি। মাস্টারদা তাঁর হাত ধরে টেনে তুললেন ওপরে। ছুটলেন তারপর দুজনে। দূরে- ঠিকানাহীন।
ধলঘাট যুদ্ধের চল্লিশ ঘণ্টা পর অপর্ণাচরণ মধ্য ইংরেজি বালিকা বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকার অফিসের চেয়ারে প্রীতিলতা উপবিষ্ট, তিনি দায়িত্ব পালন করছেন প্রধান শিক্ষিকার।
রূপকথার কাহিনির মতো ছড়িয়ে পড়েছে ধলঘাট যুদ্ধের খবর। পত্রপত্রিকাতেও ঘটনার বিবরণ এক নয়। ঘটনাস্থলে মৃতদেহ দুজনের। একজনের দেহ শনাক্ত হয়েছে, নাম নির্মল সেন। তাঁর বিশেষিত হলো সন্ত্রাসী আখ্যায়। দ্বিতীয় সন্ত্রাসীর দেহ শনাক্ত হয়নি, বয়সে অত্যন্ত তরুণ। সাবিত্রী দেবী ও তাঁর ছেলেমেয়েকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
সরকারি রিপোর্টে ছাপা হয়েছে, পুলিশ ওই বাড়িতে চারজন সন্ত্রাসীর সন্ধান পেয়েছিল। চারজনের একজন মেয়ে। দুজন সন্ত্রাসীকে পুলিশ গুলি করে মারতে বাধ্য হয়েছে। মেয়েটিকে সাথে নিয়ে অন্য সন্ত্রাসী পালিয়ে যায়। পুলিশ সন্দেহ করছে, পলাতক সন্ত্রাসীই নেতা এবং মেয়েটি ওর রক্ষিতা। ওই দুজনকে ধরার জন্য পুলিশ তল্লাশি চালাচ্ছে। দুজনের সংবাদ দিতে পারলে পুরস্কার দেওয়া হবে।
মামলা দায়ের হয়েছে তাঁদের বিরুদ্ধে। বিচারও হয়েছে। সন্ত্রাসীদের আশ্রয় দেওয়ার কারণে সাবিত্রী দেবী ও তাঁর ছেলে রামকৃষ্ণ চক্রবর্তীর চার বছর করে সশ্রম কারাদÐ হয়েছে। খালাস পেয়েছে কন্যা। মা ও ছেলেকে দÐভোগের জন্য পাঠানো হয়েছে মেদিনীপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে। ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল সশস্ত্র বিপ্লবীদের কর্মসূচিতে চট্টগ্রাম ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের কথাও ছিল। ক্লাবে উৎসবমত্ত ইংরেজদের উপর বোমা-রিভলবার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে হত্যার নির্দেশ ছিল। কিন্তু সেদিন গুড ফ্রাইডে থাকাতে বিপ্লবীদের কর্মসূচি ভেস্তে যায়। ক্লাব বন্ধ ছিল সেদিন। পাহাড়তলীর এই ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের পরিকল্পনা নেওয়া হয় দক্ষিণ কাট্টলী গ্রামের ঘাঁটি থেকে। এই ঘাঁটির নেতৃত্বে ছিলেন শান্তি চক্রবর্তী। ঘাঁটির অদূরেই তরঙ্গোন্মাদ বঙ্গোপসাগর। সাগরের বেলাভূমিতে নিরাপদে অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ চলত, পিস্তল-রিভলবার-রাইফেল ইত্যাদির গুলির শব্দ হারিয়ে যেত সমুদ্র গর্জনে।
শৈলেশ্বর চক্রবর্তীর নেতৃত্বে একদল তরুণ বিপ্লবীকে পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তরুণ বিপ্লবী শৈলেশ্বর ক্লাব আক্রমণে পর পর দু’বার ব্যর্থ হন। এই ব্যর্থতার গøানি নিয়ে শৈলেশ্বর সাগর তীরে দাঁড়িয়ে রিভলবারের বুলেট বুকে আত্মহত্যা করেন। নেতারা কেউ ভাবতেই পারেন নি উৎসাহী, কর্মঠ, সদাহাস্য এই তরুণ-বীর বিপ্লবী শৈলেশ্বর আত্মহত্যা করতে পারেন। আত্মহত্যার পূর্বে শৈলেশ্বর নেতার কাছে জবাবদিহি করেছে, ব্যর্থতার গøানিই এই আত্মহত্যার কারণ।
১৯৩২ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর কাট্টলী ঘাঁটি থেকে মাস্টারদার আহŸান এল প্রীতিলতার কাছে। তিনি ছুটে গেলেন ঘাঁটিতে। দাঁড়ালেন তাঁর মুখোমুখি। তিনি দৃপ্ত উচ্চারণে বললেন, আমার দেশে বীর যুবকের অভাব নেই। বালেশ্বর থেকে জালালাবাদ আর কালারপুল, দেশপ্রেমিক তরুণপ্রাণ দেশের জন্য আত্ম-বলিদান করেছে, তাদের রক্তে দেশের মাটি সিক্ত। আজ বাংলার ঘরে ঘরে মায়েরা, বোনেরা, কন্যারাও মেতেছে স্বদেশপ্রেমের মহামরণ খেলায়। কিন্তু ইতিহাসে তা লেখা হচ্ছে না বা হয়নি। আমি চাই, ঝাঁসীর রানী আর নাটোরের রানীর মতোই ইতিহাস। শঠ, প্রবঞ্চক, নিপীড়ক ব্রিটিশ জানুক, জানুক বিশ্বজগত, আমার বাংলার মেয়েরাও মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র সৈনিক।
মাস্টারদার কণ্ঠ থামল একটুখানি। তিনি পায়চারি করলেন দু’সেকেন্ড। দাঁড়িয়ে চোখ তুললেন প্রীতির চোখের দিকে। বললেন, ২৩ সেপ্টম্বর ১৯৩২, পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করা হবে। তার নেতৃত্বে থাকবে তুমি, চট্টগ্রামের রানী, অগ্নিকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দাদার। এই অমোঘ নির্দেশ ঘোষণা করে মাস্টারদা স্থানান্তরে চলে গেলেন। প্রীতি পাষাণ মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকলেন অনেক্ষণ। প্রীতির সমগ্র সত্তায় প্রতিধ্বনি হচ্ছে একটি বাক্যের, ‘চট্টলার রানী অগ্নিকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দাদার।’
এক সময়ে প্রীতি নিজের মধ্যেই জেগে উঠলেন। তাঁর হৃদযন্ত্রের স্বাভাবিক গতি ফিরে এসেছে। দর্শনে অনার্সের ছাত্রী তিনি। জীবন-মৃত্যুর ব্যাখ্যা তাঁর পড়া। প্রথমে মৃত্যুর কথা তাঁর মন জুড়ে। এই অভিযানে বিপুল সম্ভাবনাময় তাঁর জীবনের হয়ত মৃত্যুর যবনিকা পড়বে। পড়–ক যবনিকা, এ-তো সাম্রাজ্যবাদীর বিরুদ্ধে জাতির মুক্তির সংগ্রাম, মৃত্যুর বিরুদ্ধে জীবনেরই যুদ্ধ। ঔপনিবেশিক দুঃশাসনের যূপকাষ্ঠে অগণিত দরিদ্র-নিরন্ন-ভূখা দেশবাসী, শিশু-নর-নারী বলি হয়ে যাচ্ছে, অকালে ঝরে যাচ্ছে নির্দোষ জীবন।
অথচ আমার এই সোনার দেশে কিসের অভাব? চিরসবুজ দেশ, সোনামাখা ফসলের সমারোহ, সোনার ধানে গোলা হয় ভরাট, প্রকৃতির সম্পদে দেশ আমরা পরিপূর্ণ। বণিক এসেছিল দেশে, তারা তাদের বণিক মানদÐকে গায়ের জোরে রাজদÐ করে নিল। পুষতে শুরু করল সামন্তবাদী জমিদার, জোতদার, ধনী আর দালাল। এদের সহায়তায় সর্বনাশ করল আমার দেশের মানুষের।
আমার দেশের মানুষ আজ ভিক্ষুক, নিরক্ষর, উলঙ্গ, মৃত্যুর শিকার। এ সব মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে, জীবনের আলো দিতেই তো সশস্ত্র সংগ্রামে জীবন দিয়েছেন ক্ষুদিরাম, বাঘা যতীন, কানাইলাল, প্রমোদ চৌধুরী। জালালবাদ যুদ্ধের বারো জন শহীদ, রামকৃষ্ণ বিশ্বাস, রামকৃষ্ণ চক্রবর্তী, অপূর্ব সেন, অমরেন্দ্র নন্দী আর নির্মল সেন। তেমনি মৃত্যুর বিরুদ্ধে মহাজীবন প্রতিষ্ঠার সুযোগ প্রীতিলতার সামনে উপস্থিত। প্রীতিলতা আগুন জ্বালাবে দুঃশাসন, নির্যাতন আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে। প্রীতি পবন পুত্রের লঙ্কা দহনের মতো ইংরেজের রাজদÐ আর সিংহাসন পুড়িয়ে ছারখার করে দেবে। তাঁর মধ্যে দাউ দাউ ফুঁসছে আগুন, তিনি এখন অগ্নিকন্যা।
প্রীতি তৈরী হচ্ছেন যুদ্ধের জন্য। সাগরের বেলাভূমিতে চলছে তাঁর অস্ত্র চালনার শিক্ষা। দুদিনেই অস্ত্রশিক্ষা সমাপ্ত। মাস্টারদা রায় দিলেন, এই যুদ্ধের যোগ্য সেনাপতি প্রীতি। প্রীতিলতা দেশপ্রীতির মহিমায় সমুজ্জ্বল নয় শুধু, বিদ্রোহের অনলে পুড়ে খাঁটি সৈনিক। বিদ্রোহানলকে হাতের কব্জিতে পুঞ্জিভূত করে অস্ত্রের ট্রিগার চেপে কিভাবে অনল বর্ষণ করতে হয়, তা সে জেনে গেছে।
যাত্রার পূর্বে মাস্টারদা সাথীদের সঙ্গে প্রীতির পরিচয় করিয়ে দিলেন। প্রীতির পুরুষ বেশ নিরীক্ষণ করলেন। তিনি কঠিন চোখে প্রীতির সাথী বিপ্লবীদের পোশাকও দেখলেন। তারপর উচ্চারণ করলেন- শান্তি চক্রবতী, কালী দে, প্রফুল্ল দাস, সুশীল দে ও মহেন্দ্র চৌধুরী, এই পাঁচজন তোমার সহযোগী, সহযোদ্ধা। প্রীতির প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করে বললেন- ‘‘এ হচ্ছে প্রীতিলতা ওয়াদ্দাদার, অগ্নিকন্যা, চট্টলার রানী। আজকের যুদ্ধের সেনাপতি।’’
কারো মুখে কোনো কথা নেই, নেই শ্বাস ফেলার শব্দও। সবাই স্ট্যাচুর মতো দÐায়মান, মরণযুদ্ধের সংকল্পে দৃঢ়। মাস্টারদার কণ্ঠ ধ্বনিত হলো আবার, -ক্লাবের পশ্চিম দিকে, দশ ফুট দূরে অন্ধকার নির্জন জায়গা, অল্পকিছু ঝোপ আছে, ওখানটায় অপেক্ষা করে থাকবে। ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় ঠিক দশটা যখন হবে, একটা টর্চের আলো পড়বে তোমাদের দিকে। সে আলোর সংকেত দেখাবে ক্লাবের বাবুর্চি মনসুর উল করিম, আমাদের সাথী, মুক্তিযুদ্ধের সৈনিক। আলোর সংকেত পেলেই তোমরা ছুটে যাবে। ছড়িয়ে পড়ে চারদিক থেকে আক্রমণ চালাবে। তোমরা সফল হও। নির্দেশ দিয়ে মাস্টারদা সাগর তীরের অন্ধকারে মিলিয়ে গেলেন।
প্রীতির নেতৃত্বে বিপ্লবীরা পায়ে হেঁটে পৌঁছলেন নির্দিষ্ট জায়গায়। অপেক্ষা করছেন ক্লাবের বাবুর্চি মনসুরের কাছ থেকে আলোর সংকেতের জন্য। আলোর সংকেত পাওয়া গেল। প্রীতিলতা ‘চার্জ’ নির্দেশ ঘোষণা করলেন। বিপ্লবীরা লাফ দিয়ে দিয়ে পৌঁছে গেলেন শত্রæর খুব কাছে। গুলিবর্ষণ, বোমা নিক্ষেপ দ্রæত চলছে। উন্মত্ত বল নাচ থমকে দিয়ে জেগে ওঠে মরণ চিৎকার। সে চিৎকারও তাঁরা স্তব্ধ করে দিলেন বোমা আর বুলেটের ঘা মেরে।
আক্রমণে নেতা সর্বাগ্রে, প্রত্যাবর্তনে নেতা পিছনে, এটা যুদ্ধক্ষেত্রের নীতি। প্রীতি হুইসেল বাজিয়ে সহযোদ্ধাদের প্রত্যাবর্তন নির্দেশ ঘোষণা করলেন। যুদ্ধ শেষ, বিপ্লব সফল। সাথীরা মার্চ করছে। এগিয়ে যাচ্ছে। ক্লাবের সামনে রেলের বড় সড়কে উঠছে। প্রীতিলতা পেছনে।
পাহাড়তলী রেলওয়ে কারখানার উত্তরদিকে ছোট পায়ে চলার পথ। ও পথে হেঁটে উঠবে ওভার ব্রিজে। ব্রিজ পেরিয়ে পাহাড়তলী বাজার। বাজার থেকে ঘাঁটিতে পৌঁছতে সময় খুব লাগবে না তাঁদের। জয়ের আনন্দ সবার মধ্যে। ওরা অনেক এগিয়ে গেছে।
হঠাৎ পাশ থেকে একটা গুলি ছুটে এল, বিদ্ধ হলো প্রীতির বুকের ডান দিকে। প্রীতিলতা বুকে হাত চেপে দৌঁড়াতে চেষ্টা করলেন। পারলেন না, রাস্তার ধুলোয় পড়ে গেলেন। প্রবল রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে প্রীতির, যন্ত্রণার ঝড় উঠতে চাইছে তাঁর দেহজুড়ে, কিন্তু না, সে ঝড় ফিরে ফিরে যাচ্ছে। নাটোরের রানী আর ঝাঁসীর রানী তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে। হাসছেন ভবানী, হাসছেন ল²ীবাঈ। তিনি মাস্টারদার হাতের স্পর্শ পাচ্ছেন মাথায়। নির্মলদা অবাক হয়ে দেখছেন তাঁকে। রামকৃষ্ণ বিশ্বাস, জালালবাদের শহীদরা, অপূর্ব সেন, রামকৃষ্ণ চক্রবর্তীরা সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ক্ষুদিরামের গলায় দড়ির ফাঁস লাগানো, দীর্ঘ দড়ির প্রান্ত ছুঁড়ে দেয় প্রীতির দিকে। প্রীতি হেসে উঠে উচ্চকণ্ঠে।
সংজ্ঞা ফিরে আসে প্রীতির। ফাঁসির দড়ি গলায় পড়তে জন্ম নয় তাঁর। তিনি বিপ্লবী কন্যা-অগ্নিকন্যা! তিনি রানী ভবানী নন, নন ঝাঁসীর রানী ল²ীবাঈ, তিনি চট্টলকন্যা- অগ্নিকন্যা! বীর প্রসবিনী চট্টলার মহাবীর ব্রিটিশত্রাস মহানায়ক সূর্য সেনের ভগিনী প্রীতিলতা- বীর চট্টলার মহারানী! প্রীতির জীবন্ত দেহ কাউকেও স্পর্শ করতে দেবেন না। ইংরেজের শক্তি নেই প্রীতিকে কারাগারে বন্দি করে। চিরমুক্তির পাথেয় প্রীতির কাছে গচ্ছিত। গচ্ছিত পটাসিয়াম সায়ানাইড। হ্যাঁ, পকেটেই আছে। হাতে নিলেন মৃত্যুকে। পুলিশ-মিলিটারি-গোয়েন্দারা খুব সাবধানে এগিয়ে আসছে প্রীতির দিকে। তাদের হাতের রাইফেলের মুখে সুতীক্ষè বেয়নেট। সেই বেয়নেট বাগিয়ে আসছে ওরা। একটি শক্তিশালী টর্চের আলোয় আলোকিত প্রীতির চারিদিক। প্রীতির মুখে হাসির ঝলকানি। প্রীতি হাসতে হাসতে উচ্চারণ করলেন, জননী জন্মভূমি! আমার বন্ধন-মুক্তির দিন এগিয়ে আসছে। তখন ঘড়ির কাঁটা ২৩ সেপ্টেম্বর মধ্যরাত পেরিয়ে- এল ২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৩২। পটাসিয়াম সায়ানাইড অর্থাৎ মৃত্যু হাতে ধরা ছিল, শুধু মুখে ফেলে দিলেন। ভূমি-মা অনন্ত বাহুর বন্ধনে তিনি জড়িয়ে নেন। ঘুমালেন তিনি আমার মা-মাটির কোলে।

লেখক : আইনজীবী, প্রাবন্ধিক