মাসের মধ্যে ১৬ দিনই ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ চট্টগ্রামের বায়ু!

25

আসাদুজ্জামান রিপন

২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ৮ দিন চট্টগ্রামের বায়ুর মান ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ ছিল। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ১৬ দিনই চট্টগ্রামের বায়ুর মান ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’। অর্থাৎ ঠিক দশ বছর পরে সে মাত্রা বেড়েছে দ্বিগুণ। এছাড়া ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘অস্বাস্থ্যকর’ ছিল ১২ দিন। একইভাবে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ১২দিন ছিল ‘অস্বাস্থ্যকর’। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বায়ুদূষণ সতর্কতা ছিল ৩ দিন, ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তা ছিল ১ দিন।
চট্টগ্রামে বায়ুদূষণ বেশি করে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোই। তাছাড়া দশ বছরে জনসংখ্যা, আবাসিক ভবন নির্মাণ, গাড়ির সংখ্যাসহ পাল্লা দিয়ে বেড়েছে কারখানা স্থাপনও। এসব কারণে চট্টগ্রামে বায়ুদূষণ বেড়েছে।
এদিকে পরিবেশের খোঁজ রাখার দায়িত্ব যাদের তারাই জনবল সংকটে ভুগছে। তবে পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, বিভিন্ন সেমিনার, সচেতনতা ক্যাম্পিংয়ের মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করা হচ্ছে।
উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় যথাযথ পরিবেশ বিধি না মানার ফলে বায়ু দূষণ বাড়ছে এবং স্থায়ী হচ্ছে। এছাড়া বায়ুদূষণের পাশাপাশি পরিবেশ রক্ষায় পরিবেশ অধিদপ্তরকে সহায়তায় সহায়তা সেল গঠনের পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।
জানা গেছে, নগরীর অধিকাংশ এলাকাতেই রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করছে সিডিএ, ওয়াসা, কর্ণফুলী গ্যাস, সিটি কর্পোরেশনসহ বিভিন্ন সংস্থা। এমনকি কোনও কোনও এলাকার রাস্তা কেটে মেরামত না করে ওভাবেই ফেলে রাখায় সেখানে তৈরি হচ্ছে ধুলাবালি। নির্মাণাধীন এলাকায় নিয়মিত পানি ছিটানোর জন্য আইন থাকলেও সেগুলো মানা হচ্ছে না। বিভিন্ন পয়েন্টে উন্নয়ন প্রকল্পের চলমান কাজ থেকে সৃষ্ট ধুলায় নাকাল যাতায়তকারীরা। তাছাড়া ফিটনেস বিহীন যাববাহনের কালো ধোঁয়ার কারণে বায়ু দূষেণের মাত্রা বেড়ে যায়।
বিআরটিএর তথ্যমতে, নগরীতে প্রায় ২ লাখ ১৯ হাজার যানবাহন চলাচল করে। এরমধ্যে রয়েছে ৩৬ হাজার ৭৭৯টি ফিটনেস বিহীন যানবাহন। কালো ধোঁয়া বা কার্বন মনোক্সাইড গ্যাস উৎপাদনকারী যানবাহনের সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার। এরমধ্যে এ ক্ষতিকর গ্যাস ছড়ানো ফিটনেসবিহীন ট্রাক ৪ হাজার ৫৯টি, অটোটেম্পু ৬ হাজার ৯১৫টি, পিকআপ প্রায় ৪ হাজার ৫০৭টি চলাচল করে। এছাড়া নগরীতে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, আউটার লিংক রোড় নির্মাণসহ মেগা প্রকল্পগুলো চলমান রয়েছে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, বাতাসে ধুলাবালির সাথে যানবাহনের কালো ধোঁয়ায় থাকা কিছু ভারি ধাতু অক্সাইড ফুঁসফুস, হার্ট ও কিডনিকে অকেজো করে দিতে পারে। এর ফলে স্ট্রোক, হার্ট, কিডনি জটিলতার রোগী বেড়ে গেছে।
সরেজমিন নগরীর প্রধান সড়কের বহদ্দার হাট থেকে টাইগার পাস অংশে দেখা যায়, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও নির্মাণকাজের জন্য ভয়াবহ দ‚ষণের কবলে পড়েছে এ সড়কের বিভিন্ন জংশন। সৌর্ন্দযর্বধনের লক্ষ্যে আক্তারুজ্জামান ফ্লাইওভারের পিলারে লাগানো সবুজ কার্পেট ধুলোর আস্তারণের কারণে বোঝা যায় না। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ কাজের কারণে লালখান বাজার এলাকার ধুলার রাজ্যে পরিণত হয়েছে। এ পথে চলাচলকারী অনেকে মুখে মাস্ক, রুমাল চেপে চলাফেরা করছেন।
লালখান বাজার জংশনে কথা হয় বেসরকারি চাকরিজীবী হাবিব উল্লাহ’র সাথে। তিনি বলেন, প্রতিদিন অফিসে যাওয়ার সময় লালখান বাজার থেকে টাইগার পাস পযর্ন্ত ধুলোর যন্ত্রনায় আমরা অতিষ্ট। মাত্রাতিরিক্ত ধুলার কারণে প্রায় মাথাব্যাথা,

শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে সমস্যা হয়।
ওয়াসা মোড় এলাকার বাসিন্দা সাইফুল বলেন, রাস্তায় বের হলে মনে হয় মরুভূমিতে আসছি। একপাশে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে অন্যপাশে ওয়াসার নির্মাণ কাজ চলে। এতে ধুলার কারণে যতবার রাস্তায় বের হই, ততবার বাসায় গিয়ে গোসল করতে হয়।
নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি আশিক ইমরান পূর্বদেশকে বলেন, প্রাকৃতিক সৌন্দের্যের একটা নগরীকে ধ্বংস করে ফেলছে। উন্নত দেশগুলোতে পরিবেশ আইন মেনে নির্মাণ কাজ হয়। অথচ এদেশে যে যার মত করে পরিবেশকে ধ্বংস করে নির্মাণ কাজ করে। শুধু বাতাস না, আমরা সকল ধরনের দূষণের শিকার। এ শহরের প্রতি কারো দায়বদ্ধতা নেই। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য দূষিত শহর রেখে যাচ্ছি। এ দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে পরবর্তী দশ বছরে দূষণ তিন থেকে চারগুণ বৃদ্ধি পাবে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবেশবিদ ড. অলক পাল বলেন, অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণে এককাজ দুইবার করতে হয় বলে ধুলোবালির পরিমাণ বেড়ে যায় এবং তা স্থায়ী রূপ নেয়। তাছাড়া যানবাহন আর কল-কারখানার ধোঁয়ার কারণে বায়ুদূষণ বেড়েছে। বায়ুদূষণের ফলে জনস্বাস্থ্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। দিন দিন হার্ট অ্যাটাকের সংখ্যা বাড়ছে।
তার মতে, সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া বায়ুদূষণ কমানো সম্ভব নয়। উন্নত বিশ্বের মত বায়ু দূষণরোধে একটি শক্তিশালী এনফোর্সমেন্ট গঠন করা যায়। যার মাধ্যমে নিদিষ্ট মাত্রার চেয়ে বেশি বায়ু দূষণ করলে শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারে।
পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগর গবেষণাগারের পরিচালক (উপসচিব) নাসিম ফারহানা শিরীন বলেন, ফিটনেসবিহীন যানবাহন আর কল-কারখানার ধোঁয়ার কারণে বায়ুদূষণ বাড়ছে। তাছাড়া বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়নের কাজের কারণে ধুলাবালি সৃষ্টি হয়। কারখানা স্থাপনের সময় ইটিপি স্থাপন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। অতিরিক্ত বায়ুদূষণের কারণে বিভিন্ন কারখানাকে জরিমানা করা হয়েছে। তাছাড়া বিভিন্ন সংস্থার চলমান প্রকল্প বাস্তবায়নে শতভাগ পরিবেশ আইন মেনে চলার জন্য বলা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আমরা গ্রিণ এনার্জি, ক্লিন এনার্জির কথা বলছি। নাগরিকদের সচেতনতা বৃদ্ধি, বায়ুদূষণের ভয়াবহতা বিষয়ে সচেতন করতে বিভিন্ন সাইনবোর্ড গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে স্থাপন করেছি। বিভিন্ন স্কুল-কলেজে সেমিনারে মাধ্যেমে সচেতন করছি।