মান্টো সমীপে কতিপয় লাল গোলাপ

166

প্রিয় মান্টো, আপনি কেমন আছেন? আশা করি খোদার ফজলে ভালো আছেন। আপনার চিটিটি গতকালেই পেয়েছি, আগামাথা না ভেবে লিখতে বসলাম। ভুলত্রুটি হলে মার্জনা করবেন। প্রিয় মান্টো, আপনি নিশ্চয়ই জানেন এই বাংলাদেশে তো বটে তাবৎ বিশ্বে এখন ডাকঘর প্রায় উঠে গেছে! প্রাযুক্তিক আবহে আর সময়ের অতি মূল্যের কারণে আমরা কাউকে চিঠি লিখি না এখন। মুহূর্তের মধ্যেই এক ক্লিকে আমরা মনের খবর পাঠাতে পারি দেশের সীমা ছাড়িয়ে প্রতিবেশী কি দূরের কোন দেশে। সময়খেকো আর পাওয়া না-পাওয়ার দুলুনিকে বিদেয় দিয়ে প্রায় অনেক দূর এসে গেছি। বড় দুঃখের খবরের মতো বলতে হয়, চিঠির সেই ওম বর্তমানে পাওয়া যায় জাদুঘরে, আর্ন্তজালিক মোহনে আমরা বড় বেশি আক্রান্ত। বাপ-দাদার আমলের চিঠির ভাষা এখন অতীতের অচিন বস্তুর মতো ঠেকতে পারে, এই পারাটা অন্যায় কিছু নয়। কিন্তু আপনার গল্প, আপনার সৃজনের জ্যোতি এখনও সমানতালে বহাল আছে। চিঠির ব্যাপারটিকে বাপদাদার আমলের পুরনো দস্তাবেজ হিসেবে আমলে না-নিলেও আপনার গল্প তো আর ফেলতে পারি না! হৃদয়ের কুটিরে টান মেরে আপনার গল্প ছুঁয়ে যায় আমাদের ভাবনার সবটুকুতে। তাই, এ ব-দ্বীপের অজানা এক কোণ থেকে আপনার এক গুণমুগ্ধ পাঠক চিঠি লেখার টেবিলে বসেছে। কেমন আছেন, কোথাই আছেন, কিভাবে আছেন, এখন কেমন বোধ করছেন ইত্যাদি জানতে চেয়ে আপনার সময় নষ্ট করবো না। আজ বরং আমি বলবো, আপনি ধৈর্য ধরে পড়বেন। তাছাড়া আপনাকে ভরসা করাতে চাই, কোনদিন চিঠির উত্তর দিয়ে আপনার মূল্যবান লেখার সময় খতম করবো না।
আরে অবাক হওয়ার কিচ্ছু নেই। ভালোবাসার উপরে কোন সত্য নেই, তা আপনি জানেন, আমিও জানতে শিখেছি। প্রেমের জ্বরে মশগুল হয়ে সীমান্ত-দূরত্ব দূর করে কথা বলতে হলে যে অধিকার দরকার, শত্রুদেশের লোকের সাথে কথা বলতে যে আবদার দরকার তা আপনি দিয়েছেন, আপনার জীবন দিয়ে, দৃষ্টি আর সৃষ্টি দিয়ে। এখানে এ-কথাও উল্লেখ করতে হয়, রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে মানুষে মানুষে ব্যবধান বাড়ে, বাড়তে পারাটা স্বাভাবিক। কিন্তু আপনি সাদাত হাসান মান্টো, আপনি জীবনশিল্পী, আপনি মানুষের আবেগ আর সার্বভৌমত্বকে শ্রদ্ধা করেন বলে আপনার সাথে আমাদের বন্ধুত্ব আছে, তা আপনার অজান্তে, অনেকের অগোচরে। চিঠি পড়তে পড়তে আপনি বিস্মিত হতে পারেন, আপনার দেশেরই সেনাদের বর্বর উল্লাসে ধ্বংসযজ্ঞ বানানো দেশ আজ স্বাধীন তো বটেই, বিশ্বের কুলিন সংঘের গুরুত্বপূর্ণ সভ্যও। এবং চাঁন-তারা বুকের রক্তে হটিয়ে লাল-সবুজের নিশান নিয়ে শিরদাঁড়া উচুঁ করে মানবিক বোধ নির্মাণের দেশ থেকে আপনাকে কুর্নিশ জানানো অপ্রত্যাশিত হতে পারে আপনার কাছে, তবে বাঙালিমাত্রই অন্যের মৌলিক সৌন্দর্যবোধে অভিনন্দিত করতে জানে, টুপিখোলা সালাম জানাতে তাদের কাপর্ণ্য নেই কোনকালেই। হয়তো এটা টের পেয়েই বাঙালিকে হৃদয়হীন ভালোবাসা দিয়ে নিঃস্ব করতে চেয়েছে বিশ্বের অনেক মোড়ল হাজার বছর ধরে তা আপনার বিস্মৃত হওয়ার কথা নয় অবশ্য।
সে দীর্ঘ এক পাঠ-যাত্রার পর আপনার সাথে, আপনার শিল্পীমেজাজের সাথে আমার পরিচয়। যে কারণে আপনি আজ শত্রুদেশের নাগরিক, যে কারণে এখনো হাহাকার চলে এপার কি ওপারে, সেই দেশভাগ নিয়ে ভাবনাপুঞ্জের উত্তর খুঁজতে একদা চড়েছিলাম ‘ট্রেন টু পাকিস্তান’-এ। তারপর ‘গাদ্দার’ হয়ে জাফর আলমের অনুবাদকৃত ‘উপমহাদেশের দাঙ্গার গল্প’। ‘ঠান্ডা মাংস’ পড়ে কেমন যেন জমে গিয়েছিলাম পাঠের সেই সময়! আহা, এমনতর ভাবনা যে লেখকের তাকে আরো পড়া দরকার… দরকারের ফেরে পড়ে আপনি অর্থাৎ সাদাত হাসান মান্টো হয়ে গেছেন বারবার পড়ুয়া বৈদেশি কথাকারদের একজন। খুব শান্তভাবে দেখে ওঠি, আপনি অদ্ভূত এক জাদুকরের নাম! মান্টো মানে, অশ্লীলতার দায়ে তুমুল জনপ্রিয় এক আসামীর প্রতিচ্ছবি, মান্টো মানে থরোথরো দ্বিধার পৃথিবী যেখানে গ্রহণ ও বর্জনের খেলা চলে প্রতিনিয়ত। সেই দেশভাগ আপনাকে কেমন যেনো নিরব করে দেয়, তা অনেকেই বলে এবং আমরাও জানি, এতোদিনকার খোলামাঠে যখন বেড়া ওঠে, যখন পড়ে যায় সীমানাচিহ্ন, সেইসাথে বিষের পেয়ালা, রক্তপ্রিয় মানুষদের আনাগোনা, তখন কেউ শান্ত থাকতে পারে না, আপনি তো শিল্পী আপনি পারেননি অথচ মেনে নিতে হয়েছিল সবকিছু। কিন্তু আর দশজন তো আপনি নন, আপনার হাতের কলম, আপনার জীবন দেখার দৃষ্টি, আপনার গল্পের জগৎ এবং যা কিছু জীবিকার জন্যে করা তার সবখানে যেনবা ছায়া ফেলতে থাকে দেশভাগের সেই বিবমিষা। পাকিস্তানে যাবার পর আপনি অন্যরকম হয়ে গেছেন, অন্যরকম থেকে বেরিয়ে আসার অবধারিত পথ শিল্পচর্চায় আপনি নিয়োজিত করেছেন নিজেকে। আমরা দেখি, দেশভাগের সেই ভয়াল, অকল্পনীয় ঘটনাপরম্পরাকে নিয়ে নির্মাণ করেছেন অসাধারণ সব গল্প। সেই গল্পের ভেতর দিয়ে আপনাকে, আপনার মানবিকবোধ ও অকপটাতাকে দেখতে পাই দারুণভাবে। উপমহাদেশের হাহাকার, রক্ত, ভাঙন, বিরহ ও আর্তিকে মোটাদাগে আপনার গল্পে যেভাবে দৃশ্যমান হয় তাতে আমাদেও বোঝার বিশেষ অসুবিধা হয় না আপনি কতোটা বিপদগ্রস্থতার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে সাতচল্লিশে। ‘টোবা টেক সিং’ গল্পটাকে আপনার উল্লেখযোগ্য কাজগুলোর একটি হিসেবে চিহ্নিত করার প্রয়াস পায় সমালোচকেরা। আমার মনে হয়, টোবা টেক সিং আসলে আপনিই দেশভাগের পর যে সময়টুকুতে পাকিস্তানে আপনি অন্যরকম ছিলেন সেই সময়ের মান্টো-ই টোবা টেক সিং! পাগলাগারদের বিভিন্ন চরিত্র ও প্রবাহমানতা নিয়ে সময়কে আপনি যেভাবে ধরেছেন, মনের কথাকে চরিত্র দিয়ে যেভাবে বলাতে পেরেছেন, তাতেই বোঝা যায় মান্টোর শক্তি। আহা টোবা টেক সিং, আহা, মান্টো! নিজের জন্মগ্রামের প্রতি পাগলের যে দরদ, যে মায়া আপনি এঁকেছেন তা অবিশ্বাস্য। তৎসময়ের শাসকদের মনোবাসনার শিকার মানুষদের নিয়ে যে রাজনীতি তা সবাই জানে কিন্তু পাগলদের প্রতিবাদের ভাষা কারো জানা ছিল না, আপনি জানতেন এবং বিশ্বাস করতেন প্রত্যেকেরই অধিকার আছে স্বভূমে থাকার। পাগল কি এমনেই বলে ‘আমি হিন্দুস্তান পাকিস্তান কোথাও থাকতে চাই না, আমি এই গাছেই থাকব।’ পাগলদের এই একটি বাক্যে আমরা তাদের মনোভাব আর ঘৃণার প্রবল দিকটি দেখতে যেনবা সম্মত হই। টোবা টেক সিং ওরফে বিষণ সিং শেষতক দেখা পায় বন্ধু ফজলুদ্দিনের। বাড়িঘর, পরিবার-পরিজনের খবর দিতে গিয়ে মেয়ে রূপ কাউরের কথা শেষ করতে পারে না আর। আমরা জানি, দেশভাগের সময়ে নারী ধর্ষণ, নারী-শিশু-যুবক হত্যা হয়েছিল বেশুমার, অবধারিতভাবে ধরে নেয়া যায় রূপ কাউর ধর্ষিত বা অপহৃত হয়েছে। ঘুরেফিরে সেই প্রশ্নে আচ্ছন্ন করে বিষণ সিং, ‘টোবা টেক সিং কোথায়?’ এমন সময় বন্ধু ফজলুদ্দিনের অবস্থা কেমন হয়েছে তা সহজেই অনুমেয় কিন্তু শিল্পী হিসেবে বিষণ সিং ও ফজলুদ্দিনের বন্ধু পেতে মিলনের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা একইসাথে সৌন্দর্য ও মহানুভবতার ফসল। পাগলদের জন্ম-বাসস্থান মিলিয়ে দুই দেশে স্থানান্তর করা হয় উপরের হুকুমে। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে আপনার গল্পে বড় হয়ে ওঠে টোবা টেক সিং এর জন্মস্থানপ্রেম। দেশভাগের করুণ পরিণতির পর যেনবা মিলনের গান রচনা করতে চেয়েছেন আপনি। গল্পের একেবারে শেষে টোবা টেক সিং এর মৃত্যু ও প্রেক্ষাপট আমাদের ব্যথিত করে, শিল্পী হিসেবে আপনার দৃষ্টির প্রখরতাকে উন্মোচন করে। গল্পটার শেষ লাইনগুলো আপনাকে পড়ে শোনাই তাহলে ‘ওদিকে হিংসা কণ্টকিত নক্ষত্রমন্ডলীর নিচে হিন্দুস্তান, এদিকে সমধিক বিদ্বিষ্ট তারকা সমাবেশের নি¤œভাগে পাকিস্তান। মাঝখানের মৃত্তিকায়, যেখানে কোনো নাম খোদাই করা নেই, টোবা টেক সিং পড়ে ছিল।’ সীমাকে অতিক্রম করে শেষপর্যন্ত টোবা টেক সিং হয়ে যান দেশভাগের কবলে পড়া বেশুমার মানুষের দল!

ইতিহাসের পাঠ এমনই ঘুরেফিরে আসে। আচ্ছা, জনাব মান্টো, আপনি যদি একাত্তরে বেঁচে থাকতেন ‘খোলো’র মতো গল্প লিখতে বসতেন? কিংবা পারতেন? আপনারা যারা পাকিস্তানি তাদের চোখে ও এদেশে আপনাদের তৎকালীন সময়ের সরকার-দানব এর সাথে ঘনিষ্ঠ অমানুষদের চোখে ‘গন্ডগোল’ কিন্তু আমাদের কাছে একাত্তর গৌরব, ত্যাগ ও অর্জনের বছর। গাঢ় সবুজের মাঝে লাল টুকটুকে একটি পতাকা পাওয়ার বছর ওটা। এক নদী রক্ত, ত্রিশ লক্ষ শহীদের আত্মত্যাগ ও তিন লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের ফয়সালা হয় ও বছরেই। আপনার ‘খোলো’ গল্প পড়ে এই অধম, যে কি না মহান মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি, সেও ভাবতে বসে আমাদের মা-বোনদের ত্যাগের ইতিহাস! অথচ আমাদের মহান লেখকেরা তো বটেই আজ লেখতে আসা তরুণ বন্ধুটিরও প্রিয় অনুষঙ্গ মুক্তিযুদ্ধ, ফলে নানা দৃষ্টিতে, নানা রেখায় আমরা একাত্তরের প্রেক্ষিত দেখতে পাই সহজেই। কিন্তু ‘খোলো’ গল্পের ‘সকিনা’র সাথে মিলিয়ে পড়ি যেন বাংলার হাজারো সকিনার জীবন। কত ‘সিরাজুদ্দিন’ বাংলার মাটিতে হাহাকার করেছিল মেয়ের ইজ্জতের বাঁচানোর জন্যে, কত জনের পায়ে পড়েছিল, কত দিকে রেখেছিল সর্তক দৃষ্টি! অথচ আপনাদের পাষন্ডরা অমানবিক বিষক্রিয়া প্রয়োগ করেছিল এদেশের মা-বোনদের উপর। কত যুবক ‘মুক্তি’ হয়ে কতদিকে দিয়েছিল নির্ভরতার পরিবেশ, বাগানে, নদীতে, ডোবায় পড়েছিল কত ‘সকিনা’র মৃত-অর্ধমৃত-জীবন্মৃত দেহ! যুদ্ধ মানেই কি নিরহের উপর অত্যাচার? শোষক মানেই কি নিরাপরাধের জীবন নিয়ে খেলা? এমনতর অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে বাঙালির চেয়ে আর বেশি কে গেছে? যুবকদের খুঁজে আনা ‘সাকিনা’ কেমন করে ধর্ষিতা হয়ে যায় আশ্রয়দেয়াদের কাছে! প্রায় লাশ হয়ে যাওয়া মেয়েটির একটুখানি কম্পন দেখে পিতা সিরাজুদ্দিনের যে হৃদয়-আকুতি, ডাক্তারের নিষ্ঠা সবটা মিলেই যেন যুদ্ধের সময়! প্রিয় মান্টো, আপনার প্রয়াণের প্রায় ষোল বছর পর আপনার গল্পের চেয়েও ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল আপনার দেশের সরকার। সমগ্র পাকিস্তানের মানুষের গণরায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ক্ষমতা না দিয়ে, গণমানুষের কথা না-শুনে সেদিনের সরকার যে গোয়ার্তুমি করেছিল, যেভাবে মানুষের অপমান করেছিল, ন্যায্য দাবি না-মেনে যেভাবে গণহত্যা চালিয়েছিল তা আপনি দেখলে আরো বড় ক্যানভাসে ধরতেন আমি নিশ্চিত। আমরা জানি, শিল্পীমাত্রই সংবেদনশীল, তিনি সত্য ও সুন্দরের পক্ষে তার কলম সবসময় স্বপ্ন আঁকে গণমানুষের। আচ্ছা, আপনাদের দেশে এখনো নাকি শিক্ষালয়ে পড়ানো হয়, জিন্নাহ দুই দেশের জাতির পিতা! কথাটা কি সত্য! সত্য হলে, আপনার দেশের কর্তৃপক্ষ এত আহাম্মক হয় কী করে? আপনাদের সাথে ‘বড়র পিরিত বালির বাঁধ’ জেনে একাত্তরেই তো আমরা ছিন্ন করেছি প্রতারণামূলক সম্পর্ক। বিশ্বমানচিত্র দেখুন স্বাধীন বাংলাদেশকে দেখতে পাবেন! সেই সাথে, এটাও আপনাদের জানা উচিত, বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু। প্লিজ, এভাবে ভুল শেখাবেন না বাচ্চাদের, জাতি হিসেবে অবশ্য পাকিস্তানিদের অহম কেমন তা বিশ্ববাসী জানে! সে যাক, আপনার সাথে আমাদের সম্পর্ক শিল্পের, আপনার গল্প নিয়ে এখানেও কথা হয়, বিস্তর ঘোরলাগাও আছে।

আপনি বোধহয় ইতোমধ্যেই জেনে গেছেন, আপনার সাথে আমার প্রথম পরিচয়ে সূত্রধরের কথা। ওই যে আপনার ‘ঠান্ডা মাংস’ একটা গল্প আছে না ওটাই আমাকে চিনিয়েছে সাদাত হাসান মান্টো’কে। সেই ঘোর কি ভুলা যায়? প্রথম পরিচয়, প্রথম দেখা সবসময় উপভোগ্য হয় না সত্যি কিন্তু তার রেশ থেকে দীর্ঘদিন। জানি আপনার লেখায় অনেকেই অশ্লীলতার সন্ধান পায়, দোষও দেয়। ‘ঠান্ডা মাংস’-এ কি অভিযোগ করার পর্যায়ে পড়ে? জীবন তো এমনই এখানে কল্পনাতীত ঘটনা ঘটে, স্বাভাবিকতাও হারিয়ে যায় অথচ। এমন অনিশ্চিত মানবজীবনের নানা দিক নিয়ে কাজ করাই তো শিল্পীর কাজ! প্রিয় মান্টো, আপনি নারী-পুরুষের যৌনজীবনকে স্বাভাবিকভাবে দেখার শিক্ষা পেয়েছেন আপনার জীবন থেকে, কিন্তু অনেকেই যে তেতুঁলভাব নিয়ে দিন কাটায়! আহা, ঈশ্বর সিংকে কুলবন্ত বিশ্বাস করে না না-করার রীতিতেই আমরা অভ্যস্থ অবশ্য। স্বামী-স্ত্রীর জীবনের যৌনক্রিয়াকে আপনি গল্পে এনেছেন স্বাভাবিক ও সুস্থির ক্রিয়া হিসেবে আমরা আরো দেখতে পাই, স্বামী-স্ত্রীর কথোপকথনে যেন উঠে আসে দেশভাগের তাবত চিত্র। এমনতর গল্পের ভেতর দিয়ে আমরা মানবজীবনের ইতিবাচকতা বটেই নেতিবাচকতাও দেখতে পাই মারাত্মকভাবে। দেশভাগের সেই কালে লুটপাট, ধর্ষণ, হত্যা ছিল নৈমত্তিক ব্যাপার। ঈশ্বর সিং ছয়জনকে খুন করে এক তরুণীকে নিয়ে আসে নিজের মতো করে সঙ্গ পাবার প্রত্যাশায়। অথচ সে ছিল কি না মৃত! কুলবন্ত ঈশ্বরের স্ত্রী হিসেবে স্বামীর অক্ষমতা তো দেখতে পাবার কথা বিছানায়ই একেও কি আমরা মান্টোর অশ্লীলতা হিসেবে ধরে নেব? কৌতূহলী মেয়েলোকের যে স্বভাব তার ষোলআনাই ছিল কুলবন্তের অথচ প্রাণের সাথী ঈশ্বরকে এক কোঁপে কাটতেও দ্বিধা করে না! রক্তাক্ত ঈশ্বরের মুখ দিয়ে সব কথা বলিয়ে আপনি আমাদের জানিয়ে দেন, গল্প এভাবেই হয়… বেচারি কুলবন্তু, রক্তাক্ত ঈশ্বরের হাতে যখন হাত রাখে, সে-ও যেন অনুভব করে, ঈশ্বরের কামনার সেই মৃত তরুণীর শরীর! মান্টো, আপনি এত নিষ্ঠুর, এত খেলা আপনি জানেন!

পর সমাচার এই, আপনার আনেক গল্পই আমার পাঠমুগ্ধতাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে কেমন একটা অধিকার নিয়ে। ‘কালো সায়োর’, ‘মানহীনা’, ‘তামাশা’, ‘জানকী’, ‘গন্ধ’ আরো কত গল্প! আসলে এভাবেই, একজন মান্টো অধিকার দেন আমাদের হৃদয়ে, কাছাকাছি হয়ে যান যাপনের। আচ্ছা জনাব মান্টো, আপনার পড়ার রুটিনটা কেমন? এত এত জীবন আপনি কিভাবে দেখতে পেতেন? আপনি কি মানুষের হৃদয়ে বসবাস করে তারই হৃদয়ে থাকা কুকুরটির সন্ধানে থাকতেন? গল্পকারেরা কি এমনই? আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করার ইচ্ছে আমাদের মোটেই নেই। তাছাড়া, আপনি নিশ্চয়ই গল্পের কিংবা নাটকের অথবা জীবনভাবনার কোন নতুন প্রজেক্ট নিয়ে মগ্ন আছেন। বিশ্বাস করি, আপনার ঠিকানায় ঠিক সময়েই পেয়ে যাবেন পত্রটি। বর্তমান বাংলাদেশ স্যাটেলাইটক্লাবের সদস্য, নানামুখি অর্জনে আমরা এখন বিশ্বের অনেক কুলিন সভার কর্তাব্যক্তি, ফলে আপনার গল্পভঙ্গির মতো, আপনার বয়ানশৈলীর স্মার্টনেসের মতো বাংলাদেশের চাঁটগা থেকে নির্দ্বিধায় গ্রহণ করতে পারেন অধম-হৃদয়ের নিরন্তর ভালোবাসা।

ইতি
আপনার গল্পমুগ্ধ একজন