মানুষ মানুষের জন্য সাবিকুন্নাহার শিউলি

50

 

ক’দিন আগে আমরা চারজন (শিহাব, সোহান, ওদের বাবা আর আমি) বেরিয়েছিলাম প্রয়োজনীয় কিছু পণ্য নেব স্টেডিয়াম থেকে। কিন্তু স্টেডিয়াম না গিয়ে যাওয়া হলো নিউমার্কেট! মার্কেট পৌঁছনোর বেশ কিছুটা আগে থেকেই রাস্তা প্রচুর জ্যাম। তাই আর জ্যামে বসে না থেকে সিএনজি থেকে নেমে পড়ি। তখন দুপুর ঠিক একটা বাজে। আমরা যখন হাঁটা শুরু করি এমন সময় চার জনের মাধ্যে বেশ অনেকটা দূরত্ব তৈরি হয়। প্রথমে ওদের বাবা, তারপরে শিহাব, তারপরে সোহান এবং সব শেষে আমি। আমার আর সোহানের দুরত্বও বেশ অনেকটাই। আমি সোহানের দিকে তাকিয়েই হাঁটছি, হঠাৎ পেছন থেকে একটা মালবাহী ঠেলাগাড়ি খুব দ্রুত গতিতে সোহানের দিকে এগিয়ে গেলো। গাড়িটির দিকে তাকাতেই ভয়ে আমার দূচোখ অন্ধকার হয়ে আসছে! এই বুঝি ছেলেকে পিষে দেবে! অথচ উপচেপড়া ভিড় ঠেলে ছেলের কাছে পৌঁছনোর ক্ষমতা আমার ছিল না! চিৎকার করতেও পারছি না। চোখ বন্ধ করে বললাম রক্ষা করো আল্লাহ্! রক্ষা করো! চোখ খুলে একটু এগুতেই দেখি অচেনা অজানা এক ‘মহা মানব’ নিজের দেহখানি থেঁতলে দিয়ে সোহানকে অক্ষত অবস্থায় বুকে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ডবল মাস্ক পরা সেই ভদ্রলোককে কিছু বলার আগেই আমার দিকে সোহানকে এগিয়ে দিয়ে সেই ভিড়েই তিনি হারিয়ে গেলেন! আমি সোহানকে বুকে জড়িয়ে এদিক ওদিক খুঁজেও আর তাঁর দেখা পেলাম না!! ভালো করে দেখতেও পারলাম না তাঁকে… আর জানা হলো না আমার সন্তানকে বাঁচাতে কতখানি আহত তিনি হলেন! একটা ধন্যবাদ/কৃতজ্ঞতা জানানো, সেও হলো না! মনের ক্ষত মনেই রেখে ওখান থেকে স্টেডিয়াম ফিরে এসে কেনাকাটা শেষ করে ঘরে ফিরি। সেই থেকে এখন পর্যন্ত ভেবেই যাচ্ছি কেমন আছেন তিনি? ভাবতে ভাবতেই আজ থেকে প্রায় দুবছর আগে আমাকে দেয়া প্রাণ প্রিয় একজনের একটি উপদেশ বাণী খুব মনে পড়ে যায়, তুমি তোমার সন্তানদের যতই আগলে রাখো না কেন? যা ঘটার তা তোমার চোখের সামনেই ঘটতে পারে! তাই ওদের একটু ছেড়ে দাও। নিজেদের মতো করে চলতে দাও। সেদিনের বলা সেই বাণীটি কি করে এমন সত্যি হয়ে গেলো গতকাল চোখের সামনেই…। নিজে আহত হয়ে যিনি আমার সন্তানকে নিজের বুক দিয়ে আগলে রেখে আমায় চির ঋণী করে গেলেন,দূর থেকেই আমার লিখনিতে তাঁকে স্যালুট জানাই। চাই তিনি যেখানে যে অবস্থাতেই থাকুন না কেন? আল্লাহ্ তাঁকে সুস্থতা দান করে আজীবন নিজ হেফাজতে রাখুক। পৃথিবীতে এমন মানুষের বেঁচে থাকা দরকার হাজার বছর। তাই চাই আল্লাহ্ তাকে মানব জীবনের সর্বোচ্চ আয়ু দিয়ে বাঁচিয়ে রাখুক। ‘চেনা হোক কিংবা অচেনা, আপন হোক বা পর, প্রিয় বলতে আমি তাদেরই বুঝি, যারা আমার সন্তানদের নিঃস্বার্থভাবে মমতায়/যত্নে আগলে রাখেন।’ তারাই আমার আপনের চেয়েও আরও আপন।তারাই প্রাণপ্রিয়।