মানুষ চিনেছেন তো মরেছেন!

21

আকতার কামাল চৌধুরী

সেদিন অফিসে যাচ্ছি। সেদিন মানে অনেকদিন। চট্টগ্রাম নগরের উত্তর নালাপাড়া থেকে নিউমার্কেট যাবো। এক জোয়ান রিক্সা চালককে বলতেই ঈশারায় গাড়িতে উঠতে বললেন। না, কোনো দরদামের তোয়াক্কা করলেন না। গাড়ি খুব ধীরে চলছে। তাগাদা দিলাম একটু জোরে চালাতে। কোনো কাজ হলো না। মনে হচ্ছে চাইলেও জোরে চালানোর ক্ষমতা নেই এই রিক্সা চালকের। চালচলনেও রোগাক্রান্ত দেখাচ্ছে। একসময় আরও ধীর হয়ে আসে গতি। খেয়াল করলাম, গলা থেকে গোঙ্গানির শব্দ ভেসে আসছে। কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভাই, কোনো সমস্যা? অসুস্থ না কি’? ভেতর থেকে শক্তি নিয়ে দম ফেলতে ফেলতে বললেন, ‘গতরাত থেকে জ্বর’। ‘এতো জ্বর নিয়েও কেন গাড়ি নিয়ে বের হলেন’?- কৌতূহল আমার।
‘কী উপায় আছে! আমার বউকে গতকাল ডাক্তার দেখাইছিলাম। মেলা ওষুধ লিখে দিছে। হেও ৩/৪ দিন ধরে অসুস্থ। মাইয়াডার ফেডে যেন কী দলা পাকাইছে, তার অপারেশন করা লাগবো। ঘরে একমুষ্টি চাইল নাই। অন্তত এই বেলায় তাদের মুখে দুইডা দানা তো দেওয়া লাইগব। এইবার কন গায়ে জ্বর দেখানোর উপায় আছে’? বলতে বলতেই রিক্সা থামিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে রাস্তার পাশে বসে কাঁদতে লাগলেন। আমি নির্বাক রইলাম। আফসোস হচ্ছে এই হতভাগাদের জন্য। যত রাগ গিয়ে পড়তে লাগলো সৃষ্টিকর্তার উপর। তাঁর সৃষ্টির এতো দুর্বিষহ যন্ত্রণা কেন? কী অপরাধ তাদের? সৃষ্টিক‚লে কেন এতো বৈষম্য? ঘরে দুটি মানুষ অসুস্থ। নিজেও অসুস্থ, এই অসুস্থতার ভেতর অনিচ্ছা স্বত্তে¡ও নিজের শরীরকে রাস্তায় টেনে নিয়ে আসতে হলো। জীবন এরকম কেন? কেউ স্বর্ণপুরীতে সুখের সাগরে ভাসবে, আর কেউ জীবনে একরত্তি সুখের জন্য তিলে তিলে জীবন শেষ করে দেবে। কেউ সংসারের রথ টানতে টানতে নিজের রথ ক্ষয় করে দিচ্ছে। দুই কাঁধে ফোসকা পড়ে ফেটে যাচ্ছে। সৃষ্টিকর্তার এ কেমন বিচার? এটা হতে পারে না। রিক্সাচালক গা এলিয়ে রাস্তার পাশে ঠাঁই বসে আছেন। ভাড়ার কথা মুখেই আনছেন না। মাথা নিচু করে শুধু কাঁদছেন। বাম হাতটা দিয়ে চোখ ঢেকে রেখেছেন। চোখের পানি দেখানো পুরুষের জন্য বেমানান বটে। লোকটার পরিবারের প্রতি ভিষণ মায়া হতে লাগলো। মাথায় ইচ্ছে চাপছে, এই মুহূর্তে তাঁর পরিবারের জন্য নিজের সবকিছু সঁপে দিই। এখন পকেটের যে অবস্থা- সারাদিনের খরচ বাদ দিয়ে তাঁকে দু’শ টাকা দেওয়া যায়। তা-ই দিলাম। তিনিও নিঃসংকোচে নিলেন। অস্ফুটস্বরে কথা ফুটলো, ‘আমার জন্য ভাবি না, ভাবি মেয়েডার অপারেশনের খরচ নিয়ে’।
অফিসে দেরি হয়ে যাচ্ছে। বুকে পাষাণ দিয়ে বিদায় হলাম। হাঁটছি আর ভাবছি-মানুষটাকে দু’শটা টাকা দিলাম, অথচ কোথায় এতটুকু কৃতজ্ঞতাবোধ, বরং তাঁর মেয়ের অপারেশনের খরচের কথাই করুণ সুরে স্মরণ করিয়ে দিলেন। একটু খটকা লাগছে আমার। হাঁটার গতি কমিয়ে দিলাম। পেছনে ফিরে দেখি রিক্সাচালক গাড়ি উল্টো দিকে ঘুরিয়ে আবার ছুটছে উত্তর নালাপাড়ার দিকে। শুধু ছুটা নয়, এরোপ্লেনের গতিতেই ছুটা।
চোখকে বললাম, চিলের দৃষ্টিশক্তি মানুষকে মানায় না বাপু! তোমার এতো বিচরানোর কি আছে! এতে শত্রæ বাড়ে। মানুষকে বিশ্বাস করতে শেখো। অফিসে এসেও নিস্তার নেই। লোকটার আচরণে মাথা চক্কর দিচ্ছে বারবার। ধরণী দ্বিধা হও। প্রায় দুই মাস পর, একদিন বাড়ি থেকে ফিরছি। হঠাৎ চোখ গেলো কোতোয়ালি থানার পেছনের রাস্তায়। ফুটপাতে এক লোককে ঘিরে জটলা তৈরি হয়েছে। পাশেই একটা রিক্সা। কৌতুহলী হয়ে জনতার ভিড়ে মাথা ঢুকিয়ে দিয়ে যা দেখলাম তাতে আমার চক্ষু স্থির! অবাকবিস্ময়ে দেখলাম, সে-ই রিক্সা চালক, মাথা গামছা দিয়ে ঢেকে চোখে ডানহাত দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। প্রচÐ চিৎকার দিলাম, ‘এই মিয়া, তুমি না সেই-উত্তর নালাপাড়া থেকে আমাকে নিয়ে সিটি কলেজের কাছে বসে পড়েছিলে? তোমার জ্বর, বউয়ের জ্বর, মেয়ের অপারেশন এগুলো বলোনি আমাকে? আমি তোমাকে দু’শ টাকা দিইনি’? জোয়ান মরদ, এই ব্যবসা আর কতোদিন করবা?
লোকটা নিরুত্তর। সাপের মাথায় যেন পা পড়েছে। চোখ থেকে গামছা সরিয়ে আমার দিকে একপলক তাকালেন। এই চাহনিতে বিরক্তি আছে। চোখ তো নয়, যেন আগুনের গোলা; মানুষ না হলে এই আগুনের শিখায় এতোক্ষণে জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে যেতাম। এত্তোবড়ো শহরে লাখ লাখ মানুষের ভীড়ে সেই আমিইবা কেন দ্বিতীয়বার তার মুখোমুখি পড়লাম। লোকটার আফসোস একটাই-‘এই দুই মাসে এতো লোক মারা গেল, আমি কেন মরলাম না’।
খেয়াল করলাম, এই রিক্সা চালকের মতো অনেকেই আমার উপর বিরক্ত। তাদের ভাবখানা এই-‘মানুষ এতো নির্দয় হয়’! তাদের না না টিপ্পনীর তোড়ে স্থান ত্যাগ করলাম। নিজের উপর ঘৃণা হচ্ছে! শালার! কেন মানুষটাকে চিনতে গেলাম। চিনলাম তো ঠিকই ছিল; রিক্সা চালককে না চিনে তার ভেতরের মানুষটাকে কেন চিনতে গেলাম? বিপত্তি এখানেই। মানুষের আবেগ,সহানুভূতি নিয়ে এতোবড়ো প্রতারণা! প্রত্যেক মানুষের একটি কোমল মানবিক সত্তা থাকে। সেই সত্তায় আঘাত করা অপরাধ। এই নিরেট সত্যটা বুঝতে শিখেছেন? ব্যস,আপনি এখন ঘরেবাইরে অপ্রিয় একজন মানুষ, শত্রæ কিলবিল করবে চতুর্দিকে। আদর্শবান মানুষ সবার প্রিয় হতে পারে না, হয়-ও না। নিজের স্পষ্টবাদিতাই নিজের শত্রæ হয়ে দাঁড়ায়। এটাই তার চলার পথে কাঁটা বিছিয়ে দেয়। জীবনকে সঙ্গীন করে, বিষিয়ে তোলে।
সবার প্রিয় হতে চাইলে কিছু কৌশল রপ্ত করতে হয়। নির্বোধ মানুষগুলোকে বলতে হয় জ্ঞানী। নির্লজ্জ, বেহায়া, সুবিধাবাদীদের বলতে হয় চালাক। আয় ব্যক্তিত্ববান হতে চাইলে যায়গা না থাকলেও জোর করে সামনের কাতারে দাঁড়িয়ে যেতে হয়। আপনি মানুষ চিনেছেন তো কী হয়েছে! হাজারো মানুষ বসে আছে তার পেছনে তালি বাজাতে। আপনি বিষবৃক্ষ তাদের কাছে। এই বিষবৃক্ষ উপড়ে ফেলতে পারলেই যেন তারা বাঁচে। যেদিন থেকে মানুষের স্বরূপ চেনা শুরু করেছেন সেদিন থেকে আপনি একা, একদম একা। মানুষ চিনেছেন তো মরেছেন!
আপনি মরেছেন- ইন্নালিল্লাহী পড়ার মানুষও নাই। শোকে কাতর হবে না পরিবারের লোক ছাড়া। সমাজ ভাববে- যাক, বাঁচা গেলো বাবা! আপনাকে হারানোর একটা কৃত্রিম পীড়া দেখাবে বটে, ভেতরটায় ঢেউ উঠবে মুক্তির আনন্দে। কেউ কেউ কিন্তু নিরবে চোখের পানি ফেলবে, তবে এই সংখ্যাটা নেহায়েত কম। তারা অপরাধীর মতো নিজেদের লুকিয়ে রাখে।
মানুষ চেনা ভয়ানক অপরাধ! এই ‘অপরাধীরা’ একদম বিস্বাদ, আলুনি, ফ্যাকাসে। এরা বে-হজম সমাজে। মেলা-মজলিসে দাওয়াতও তেমন পান না। একেবারে পান না তা-ও নয়, পেলে আবার না-গেলেও চলে, এদের অনুপস্থিতি কোনো শূন্যতা সৃষ্টি করে না, কিন্তু আটকে থাকেনা কাওকে হতাশও করে না। এরা ঠেলে চেয়ার দখল করে না, এদের গায়ের উপর মারিয়ে অন্যরাই বরং তা দখল করে নেয়। এই প্রতিযোগিতায় এঁরা সবসময় পরাজিতই হন। অকারণেই শত্রæ গজিয়ে উঠে এঁদের চারপাশে। তাঁদের পৃথিবী ক্রমশ ছোট হয়ে আসে। চিনেও না-চেনার, বুঝেও না-বোঝার অভিনয় করে যান, ভালোই থাকবেন। বড়ো পদ-পদবি, ধন-মানের কৌলিন্য, অভিজাত পোশাক, চালচলনের লেবাস মানুষের কতো কুৎসিত চিহ্নকে ঢেকে দিয়ে ফেলে! আহা, এ এক আশ্চর্য চরিত্র মানুষের!
লেখক : প্রাবন্ধিক