মানুষের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত হোক

30

 

সাম্প্রদায়িক অপশক্তির উত্থান এবং তাদের মানবতা বিধ্বংসী কর্মকান্ড আমাদের কাছে কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। একবিংশ শতাব্দীর এ নব্য পৃথিবীতে মানুষ মানুষকে ছাড়া অচল। প্রত্যেক ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি-গোত্র নির্বিশেষে মানুষ স্বাভাবিক বা উন্নত জীবনযাপন বা অন্যান্য জাগতিক প্রয়োজন মেটাতে একে অপরের উপর নির্ভরশীল। মহান সৃষ্টিকর্তা পৃথিবীতে বহু মতবাদ সম্বলিত ধর্মীয় বৈচিত্র্য মানুষের সামনে দিয়েছেন। সৃষ্টিকর্তা চাইলেই সকলকে এক ধর্মের অনুসারী করে দিতে পারেন কিন্তু তিনি তো তা করছেন না। অথচ কতিপয় মানুষ অসহিষ্ণু হয়ে এ ধর্মীয় বৈচিত্র্য নষ্ট করতে চায়। তাঁরা বার বার অন্যের ধর্মীয় বিশ্বাসকে অসম্মানিত করে। মানবিক অধিকারকে হরণ করে। কিন্তু পৃথিবীর সকল ধর্মের মর্মবাণীতে মানবতাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। মানবতাকে অসম্মান করার কোনো সুযোগ কোনোভাবেই মানুষের জন্য তিনি রাখেন নি। সকল ধর্মের পবিত্র মহাগ্রন্থগুলোতেও নিজ নিজ ধর্ম পালনের মাধ্যমে সকল ধর্মের মানুষকে নিয়ে সম অধিকারের ভিত্তিতে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের কথা বলা হয়েছে। অহেতুক কাউকে অসম্মান করা এবং ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করতেও নিষেধ করা হয়েছে।
একবিংশ শতাব্দীতে এসে আমরা দেখতে পাচ্ছি, পুরো দুনিয়া মানুষের হাতের মুঠোয়। তা সম্ভব হয়েছে সকল ধর্মের মানুষের পারস্পরিক মেধা-মনন-শ্রম-অর্থসহ নানাবিধ সাহায্য-সহযোগিতার কারণে, একক কোন ধর্মগোষ্ঠীর অনুসারীদের দ্বারা কিন্তু নয়। ‘মানুষ’ পরিচয়েই পুরো বিশ্বের মানুষ চাইলে সবাই এখন এক মোহনায় দাঁড়াতে পারে। মানবিক পৃথিবীর গড়ার একটি সুযোগ মানুষের সামনে রয়েছে। মানবসভ্যতার এ অগ্রগতিতে এবং মানবসৃষ্ট বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় ধর্ম-বর্ণের ঊর্ধ্বে সকল মানুষের সম্মিলিত অবদান রয়েছে এবং এ প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। বর্তমানে শুধু নিজ দেশের মানুষ নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশের মানুষের সুখ-দুঃখেরই ভাগীদার হতে হয় আমাদেরকে। তাদের বিপদে যেমন আমাদের এগুতে হয়, ঠিক তেমনি আমাদের বিপদেও তাদের এগিয়ে আসতে হয়। চলমান করোনা মহামারি তার একটি উৎকৃষ্ট প্রমাণ হিসেবে আমাদের সামনে চলমান। আমরা করোনা মহামারির যে ভ্যাকসিন গ্রহণ করছি তা কিন্তু অন্য দেশের কাছ থেকে পাচ্ছি। এ ভ্যাকসিন আমাদের তৈরি করা নয়। ভ্যাকসিন গ্রহণের ক্ষেত্রে কোন ধর্মের মানুষ বা কোন দেশে তৈরি হয়েছে তা বিবেচিত নয় আমাদের কাছে, মূল্যবান জীবন বাঁচানোই মুখ্য। অধুনা এক দেশে সাম্প্রদায়িক আগুন লাগলে, পাশের প্রতিবেশী দেশে সে আগুন ছড়িয়ে পড়ে অথবা পাশের প্রতিবেশী দেশের আগুন অপর প্রতিবেশীর ঘর জ্বালিয়ে দেয়। তাই বর্তমান দুনিয়ায় কোন দেশের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সৃষ্টি করে মানুষে মানুষে হিংসাত্মক কার্যকলাপের মাধ্যমে মানবতাকে ভূলুণ্ঠিত করার সুযোগ নেই। বর্তমান পৃথিবীতে নিজ দেশের সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষ তো বটেই, অন্য দেশের সাথে শান্তিপূর্ণ সুন্দর সম্পর্ক বজায় রাখার বিষয়টিই এখন মুখ্য। এক্ষেত্রে বৈদেশিক বিনিয়োগসহ অন্যান্য অর্থনৈতিক সুবিধা লাভেরও সুযোগ তৈরি হয়। কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের সাথে বলতে চাই, “জগৎ জুড়িয়া এক জাতি আছে/ সে জাতির নাম মানুষ জাতি।” আমাদের দেশও ধর্মীয় বৈচিত্র্যের একটি সুন্দরতম দেশ। বিভিন্ন ধর্মের মানুষের পারস্পরিক সহাবস্থানের ইতিহাসের দেশ। এ বৈচিত্র্য একদিনের নয়, যুগ যুগ ধরে তা বিদ্যমান। আমাদের সকলের উচিত সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি বজায় রেখে নিজেদের শান্তিতে রাখা এবং সমৃদ্ধ দেশ গড়তে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সচেতন ও সচেষ্ট থাকা।
সাম্প্রতিককালে শারদীয় দুর্গোৎসবের মধ্যে ও পূজা পরবর্তী সময়ে আমাদের দেশে কুমিল্লায় মহাগ্রন্থ পবিত্র কুরআন শরীফের কথিত অবমাননার অভিযোগে টানা কয়েকদিন হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর খুবই দুঃখজনক ও নিন্দাজনক সহিংস হামলা দেখতে পেয়েছি। কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় হিন্দুদের দেব-দেবীর মূর্তি ভাংচুর, হত্যা, মন্দির ও ঘর-বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়া, ভাংচুর, লুটপাট ইত্যাদি অপকর্ম সংঘটিত হতে দেখেছি। এতে করে এদেশের সনাতন ধর্মাবলম্বীরা তাদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গোৎসব পালনে বাধার মুখোমুখিসহ পুজোৎসবের সকল আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। চোখের সামনে সাম্প্রদায়িক দুর্বৃত্তদের তান্ডব প্রত্যক্ষ করেছেন। নিজেদের প্রাণ বা সম্পদ রক্ষার জন্য আহাজারি করেও কাউকে কাছে পেয়ে কেঁদে কেঁদে বুক ভাসিয়েছেন। বর্তমানে নিজের জন্মভূমিতেই আতংকে নিরাপত্তাহীনতা অনুভব এবং বিপন্নবোধ করছেন। জানমালের নিরাপত্তায় ফেস্টুন, ব্যানার ইত্যাদি নিয়ে রাস্তায় দাঁড়াচ্ছেন। যা একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশের জন্য কতটা লজ্জাকর, তাই এখন ভাবার বিষয়। বিশ্ববাসীর কাছেও বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি নেতিবাচক বার্তা পৌঁছে যাচ্ছে। বিদেশি বিনিয়োগসহ অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকান্ডেও তার প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে।
মনে রাকতে হবে, আমাদের ধর্ম বিশ্বাস আলাদা হলেও মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান ধর্মের সাধারণ মানুষ একে অন্যের সাথে পারস্পরিক সুন্দর সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ। বিভিন্ন ধর্মের পবিত্র অনুষ্ঠানগুলোতে বা অন্যান্য সামাজিক-সাংস্কৃতিক উৎসবেও সকল মানুষের পারস্পরিক সহযোগিতা বা সহাবস্থানও সুখকর। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সংঘটিত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের সৃষ্টিও অসাম্প্রদায়িক চেতনার ভিত্তিতে হয়েছে। পঁচাত্তর পরবর্তী সময় থেকে এ দুষ্ট চক্রটি সক্রিয়। তারা সাংবিধানিকভাবে সকল ধর্মের মানুষের অধিকার সমান হওয়া সত্ত্বেও এদেশের মানুষের মাঝে ধর্মীয় বিভাজন রেখা তৈরির মাধ্যমে ফায়দা লুটার চেষ্টা করে চলেছে। সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস করে আমাদের দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। ধর্মীয় উন্মাদনা তৈরি করে সময়ে সময়ে দেশের শান্ত পরিবেশকে অস্থিতিশীল করে তুলছে। বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয় অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষেরা মনে করছেন, এ সংঘবদ্ধ চক্রটি তখনই খুব বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে যখন রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশয় পায়। ২০০১ সালে নির্বাচন পরবর্তী বিভিন্ন জেলায়, ২০১২ সালে রামুতে, ২০১৬ সালে নাসিরনগরে, ২০২১ সালে সুনামগঞ্জের শাল্লাসহ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন এলাকায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর হামলার সঠিক তদন্ত ও বিচার না হওয়ার সংস্কৃতিও এবারের হামলার ক্ষেত্রে দুর্বৃত্তদের আরো বেশি সাহস যুগিয়েছে বলেও তারা মনে করছেন। এসবক্ষেত্রে কোন না কোন রাজনৈতিক দলের ক্ষমতায় যাওয়া বা ক্ষমতায় থাকার অপরাজনীতি যুক্ত থাকার অভিযোগও যথেষ্ট রয়েছে। বর্তমান সময়ের এ হামলার পরে এ ধরনের একটি নেতিবাচক বার্তাও আমরা পাচ্ছি। একই সাথে আছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দোষারোপের সংস্কৃতি। দুর্বৃত্তদের দ্বারা কোন ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পর বড় দুই দল বিএনপি ও আওয়ামীলীগ পরস্পরের গায়ে কাঁদা ছিটিয়ে নিজেদের পুত-পবিত্র প্রমাণ করার রাজনীতি করে আসছে বছরের পর বছর। এ ধরনের গতানুগতিক দায়সারা রাজনীতির কারণে ধর্মভেদ আরও বেশি উস্কে যায় দিনশেষে। তাই সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস বন্ধের জন্য বড় এ দুই দলসহ সকল রাজনৈতিক দলের ঐক্যমত দরকার। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার যথার্থ বাস্তবায়ন জরুরি। তা না হলে ভবিষ্যতে এ দেশ সংখ্যালঘু শূন্য হয়ে ধর্মীয় বৈচিত্র্য হারাবে। তাই রাজনৈতিক শুদ্ধিকরণটাও এখন সময়ের দাবি। রাজনীতি ক্ষমতাকেন্দ্রিক হলেও আদর্শ হতে হবে সত্যিকারের জনসেবা, সার্বজনীন নিরাপত্তা নিশ্চিত ও অধিকার রক্ষার শপথের আলোকে, নিজের বা গোষ্ঠীর সংকীর্ণ হীনস্বার্থে নয়। তাহলেই সুন্দর ও সাম্প্রদায়িকতামুক্ত দেশ গঠিত হবে। বাংলাদেশে ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি-গোত্র নির্বিশেষে প্রত্যেক মানুষ তার ন্যায্য অধিকার ভোগ করবে এবং আইনি সুরক্ষা পাবে- তাই কাম্য। পরিশেষে বলব, বিভিন্ন সময়ে সংখ্যালঘু হত্যা ও তাদের উপর ঘটে যাওয়া সহিংস কর্মকান্ডের সুষ্ঠু তদন্ত করে বিচারের মাধ্যমে প্রাপ্য শাস্তি নিশ্চিত করা, নির্যাতিত বা ক্ষতিগ্রস্তদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ প্রদান করা এবং দেশকে সাম্প্রদায়িকতার ছোবল থেকে রক্ষা করতে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি, যা শাসক সম্প্রদায়ের কাছে সাধারণ মানুষের দাবি।

লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক