মানব বিবর্তনের গবেষণায় নোবেল

10

আকতার কামাল চৌধুুরী

বিলুপ্ত হোমিনিনদের জিনোম আবিষ্কার ও মানববিবর্তন নিয়ে গবেষণার জন্য ২০২২ সালে চিকিৎসা ও মেডিসিনে নোবেল পেয়েছেন সুইডিশ বিজ্ঞানী সভান্তে প্যাবো। কাটাখালী খাল আমাদের পাশেই। একসময় এখানে প্রচুর ‘ভেধা’ মাছ (আঞ্চলিক নাম) আর ‘মধুফলা’ (পাবদা) মাছ পাওয়া যেতো। তখন আমরা ছোট। ‘ভেধা’ মাছ একদম নিরীহ, জাল থেকে পালাতে পারতো না, চেষ্টাও করতো না। মাছটি এখন বিপন্ন এ-অঞ্চলে। এ প্রজন্ম চিনবে-ও না মাছটি। অন্যদিকে ‘মধুফলা’ মাছটি কয়েকটি নদীতে তাদের বংশের অস্থিত্ব কিছুটা টিকিয়ে রাখতে পারলেও মূলত মৎস্য খামারেই বানিজ্যিক চাষ করা হচ্ছে এদের এবং ‘পাবদা’ মাছ হিসেবে শহুরে বাসিন্দাদের পাতে স্থান পাচ্ছে। খুব সুস্বাদু বলে মানুষ এই মাছটির অস্থিত্ব বাঁচিয়ে রেখেছে।
শকুন কি এখন আমাদের চোখে পড়ে? নিশ্চয়ই না।অথচ একসময় আমাদের গ্রামবাংলার আকাশ ছেয়ে রাখতো এই শকুন। এই যে ভেধা মাছ আর শকুনেরা এলাকা ছাড়া হলো, কার উপর রাগ করে? এরকম অনেক প্রজাতির প্রাণী পৃথিবীতে একসময় যাদের দাপট ছিল, ওরা এখন বিপন্ন প্রজাতির খাতায়। পৃথিবীর অনেক দাপুটে প্রাণী এভাবে বিলুপ্ত হয়ে গেছে কালের আবর্তে। ক্রমপরিবর্তনশীল পরিবেশের সাথে নিজেদের খাপখাওয়াতে না পেরে জীবনসংকটে পড়া এই প্রাণীগুলোর পক্ষে আর পরবর্তী প্রজন্ম সৃষ্টি করা সম্ভব হয়নি। শেষ পরিণতি বিলুপ্তি। প্রকৃতির এটাই নিয়ম। একসময় বিক্ষিপ্তভাবে পাওয়া বিলুপ্ত প্রজাতিগুলোর ফসিল থেকে পাওয়া হাড়গোড় বিশ্লেষণ করে বিবর্তনের ইতিহাস খোঁজার চেষ্টা হতো। প্রতœতত্ত¡ ও জীবাশ্মবিদ্যাকে কাজে লাগিয়ে বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন প্রায় তিন লাখ বছর আগে আফ্রিকায় হোমোসাপিয়েন্স অর্থাৎ আধুনিক মানুষের উৎপত্তি হয়।
জীববিজ্ঞানে জিন একটি অতি পরিচিত সংবেদনশীল শব্দ। জিন ছাড়া প্রাণের স্পন্দন অসম্ভব। উদ্ভিদ কিংবা প্রাণী কোষের এই জিন-ই বলে দেবে আপনার গায়ের রঙ, দৈর্ঘ্য, চুলের ধরন, দাঁতের সংখ্যা, পরবর্তী বংশধারার বৈশিষ্ট্য, রোগবালাই-এর আক্রমণ থেকে প্রতিরোধ ইত্যাদি ইত্যাদি। সেটা উদ্ভিদ কিংবা প্রাণী-এই জিন-ই তার পথনির্দেশিকা। আমি বলি জিন মানে প্রাকৃতিক সফ্টওয়্যার। ছাগল একটি প্রজাতি। অথচ কত উপজাতের ছাগল আছে দুনিয়ায়। সাপের মধ্যে কত ধরনের সাপ।পাখির মধ্যে কতধরনের পাখি, পিঁপড়ার মধ্যে কত ধরনের পিঁপড়া। এভাবে প্রকৃতিতে একেকটা প্রাণীর কতোটা প্রজাতি আছে তার সীমাপরিসীমা নেই। প্রতিটি ছাগলের জিনের গঠন একই, শুধু বিন্যাসের তারতম্যের কারণে এর জেনেটিক কোড আলাদা। তাই ছাগলেরও নানা জাত।একইভাবে অন্যান্য প্রাণীর বেলায়ও। মানুষও এই নিয়মের বাইরে নয়। এখন উদাহরণ দিয়ে যদি বলা হয়, ছাগলের কয়েকটি জাত প্রকৃতিতে টিকতে না পেরে ৬০/৭০ হাজার বছর আগে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়। সংগতকারণে সেই বিলুপ্ত হওয়া ছাগলের জিন প্রকৃতিতে খুঁজে পাওয়া আপতত অসম্ভবই বটে। এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন সাভান্তে প্যাবো।
তিনি প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন, এক সময় পৃথিবীতে মানুষের সদৃশ্য আরও দুটি প্রজাতি ছিল। তারা নেন্ডার্থাল ও ডেনিসোভ্যান। তারা বর্তমান মানুষের সাথে একইসময়ে বিবর্তিত হয়। বিজ্ঞানী সাভান্তে প্যাবো জানান যে,এই তিনটি প্রজাতিই একসময় এশিয়া, আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে একসাথে বসবাস করতো। এবং তাদের মধ্যে মিলনের মাধ্যমে জিনের আদানপ্রদানও ঘটে। এর ফলে নেন্ডার্থাল ও ডেনিসোভ্যান প্রজাতি থেকে কিছু জিন মানুষের দেহে প্রবেশ করে, এখনো মানুষ সেই জিনের ৪০% বহন করে চলছে। জিনের এরোপ অনুপ্রবেশ না ঘটলে মানবজাতির বার্তমান বৈশিষ্ট্য, আচার-আচরণ অন্যরকম হতে পারতো। তাঁর আবিস্কারে মানুষের সাথে নেন্ডার্থাল ও ডেনিসোভ্যানের যোগসূত্রতা একদম স্পষ্ট। মানুষের জ্ঞাতিভাই ওই দুই প্রজাতি যেমন একদম বিলুপ্ত হয়ে যায়। অন্যদিকে মানবজাতি আরও বিবর্তিত ও উন্নত ব্রেইনের অধিকারী হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে আর নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষনা করে সমস্ত প্রাণীকুলের উপর সর্দারী শুরু করেন।
কালো আফ্রিকানদের শরীরে নেন্ডার্থাল ও ডেনিসোভ্যানের জিনের অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। এই প্রজাতি দুটি আফ্রিকাতে মাইগ্রেট করার আগেই পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়। জিনোম সিকুয়েনসিংয়ের মাধ্যমে মানববিবর্তনের এই ক্রমধারার গভীর রহস্য উদঘাটনের জন্য সাভান্তে প্যাবোকে চিকিৎসা ও মেডিসিন বিভাগে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। এই আবিষ্কারের পেছনে কতো গবেষণা, কতো শ্রম, কতো গুঢ় রহস্যের নিভিড় বিশ্লেষণ-যিনি করেছেন তিনিই জানেন। এখানে আমরা আদারবেপারী একেবারে। তবুও বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে নেট দুনিয়ার উপর ভরসা করে সর্বোপরি মনের অনুসন্ধিৎসা থেকে কলম ধরার সাহস করা।
বিবর্তন কি দেখা যায়? না, এটা একজনমে দেখার বিষয় নয়।আপনার-আমার ৮০/৯০বছয়ের আয়ু আমাদের কাছে অনেক লম্বা মনে হলেও প্রকৃতির অনন্ত সময়কালের কাছে এই আয়ু এক সেকেন্ডও নয়। তাই এক সেকেন্ডে বিবর্তন বোঝাও সম্ভব নয়। অথচ এটি প্রকৃতির একটি চলমান এবং অনিবার্য প্রক্রিয়া।
আপনার সন্তান আপনার চোখের সামনেই বড়ো হচ্ছে দিনদিন। গতকাল যে উচ্চতা দেখেছিলেন আজ-ও সেই একই উচ্চতা মনে হবে আপনার। অথচ গত ২৪ ঘন্টায় আপনার সন্তানের শরীরে কোটি কোটি কোষের জন্ম হয়েছে, এমনকি একটি নির্দিষ্ট পরিমাপের বৃদ্ধিও ঘটেছে। কিন্তু এই বৃদ্ধিটা এতোটা সূ²াতিসূ² যে মানব চোখ একদিনের এই বৃদ্ধির তারতম্য অনুধাবনও করতে পারেনা। আপনি বিদেশ থেকে ৫/১০ বছর পর দেশে আসুন, তারপর নিজের সন্তানের দিকে তাকান-চোখ ধেঁধে যাবে! ও মা! আমার বাপ্টা কত্তো বড়ো হয়ে গেছে, আমার মামনি-টা আজ কত্তো বড়ো! -চেনাই যাচ্ছে না।
আপনার সন্তানের দৃশ্যমান বৃদ্ধি উপলব্ধি করার জন্য আপনাকে অন্তত ৫/১০ বছর বিরতি দিয়ে দেখতে হয়। একইভাবে আপনার বাড়ির পুকুরপাড়ের তালগাছটির বৃদ্ধিও একইভাবে দেখতে হবে। আপনার সন্তান আর তালগাছ প্রতিদিন বেড়ে উঠছিল, অথচ এদের দৈনিক বৃদ্ধিটা আপনার চোখে পড়েনি। বিবর্তনও একইরকম। বিবর্তিত পরিবেশের সাথে খাপখাওয়াতে প্রতিটি প্রাণী প্রতিমূহুর্তে বিবর্তিত হচ্ছে, অথচ তা আমাদের চোখেই পড়ে না। আপনার সন্তান আর পুকুরপাড়ের তালগাছটার বৃদ্ধি বোঝার জন্য আপনাকে যেমন ৫/১০ বছর অপেক্ষা করতে হয় তেমনি প্রাণীর বিবর্তন বুঝতেও অপেক্ষা করতে হবে অন্তত ৩০/৪০ হাজার বছর। আপনার আয়ু কতোদিন? একজনমে তাহলে কি বিবর্তন বোঝা সম্ভব?

লেখক : প্রাবন্ধিক