মানবিক

31

শামসুদ্দীন শিশির

বিকেল থেকেই সৈকতকে হাসপাতালের ইনটেন্সিভ কেয়ার ইউনিটে থাকতে হচ্ছে। সৈকতের এক সহকর্মীর হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। কর্মস্থলে তিনি একাই থাকেন। পরিবারের সদস্য বলতে এখানে সহকর্মীরাই। শীতের বিকেলে ঠান্ডা জলে স্নান করতে গিয়েই যত বিপত্তি। এক মগ ঠান্ডা জল মাথায় ঢেলে দ্বিতীয় মগ আর নিতে পারেননি সাথে সাথেই ঢলে পড়লেন। একা একা থাকার কারণে রান্না বান্নাও নিজে নিজেই করতেন। বৈদ্যুতিক চুলায় ভাতের হাঁড়ি তুলে গরম জলে চাল ছেড়ে স্নানে গেছেন। এরই মধ্যে মাড় শুকিয়ে সিদ্ধ হওয়া ভাত পুড়ে চারিদিকে পোড়া গন্ধ ছড়িয়ে পড়ায় খোঁজ শুরু হলো। খুঁজে পাওয়া গেলো আমেজ (ছদ্মনাম) স্যারের চুলায় দেওয়া ভাত পুড়ে গেছে। কিন্তু আমেজ স্যার কোথায়? উনাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। টু শব্দটিও নেই পুরো তল­াটে। অনেক খুঁজে দেখা গেলো স্নান ঘরের দরজা বন্ধ। অফিসের এক কর্মচারী স্নান ঘরের উপরে উঠে দেখলেন তিনি একদিকে হেলে পড়ে আছেন। বহু কষ্টে স্নান ঘরে নেমে দরজা খুলে স্যারকে ভেজা কাপড়েই ধরাধরি করে দপ্তরের গাড়িতে তুলে হাসপাতালের ইমার্জেন্সি তে নেয়া হলো।
ডিউটি ডক্টর রোগীর অবস্থা জেনে আই সি ইউতে রেফার করলেন। সে কারণেই সৈকতের আই সি ইউতে অবস্থান। পুরো ওয়ার্ড জুড়ে ডাক্তার, চেক আপ, ওষুধ খাওয়ানো, স্যালাইন দেওয়া এই সব নিয়ে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। এর মধ্যে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। সৈকতের হঠাৎ চোখ গেলো স্ট্রেচারে শুয়ে থাকা এক ভদ্রলোকের দিকে কয়েকজন ডাক্তার উনাকে খুব ভালো ভাবে দেখছেন। দীর্ঘদেহী
ভদ্রলোক এই শীতের সন্ধ্যায় ঘেমে নেয়ে একাকার। ডাক্তার মশাইয়ের হাতে একখানা প্রেসক্রিপশন। তিনি খুঁজছেন রোগীর স্বজন। ভদ্রলোক শুয়ে শুয়ে কাঁদছেন। আমি সামনে এগুতেই ইশারায় ডাকলেন। কাছে যেতেই বললেন দাদা আমাকে বাঁচান। এখানে আমার কেউ নেই। ডাক্তার মশাইয়ের কাছে সৈকত জানতে চাইলো কী সাহায্য প্রয়োজন উনার। ডাক্তার মশাই বললেন এক্ষুনি এই ওষুধ গুলো আনতে হবে
নয়তো রোগীকে বাঁচানো যাবে না।
প্রেসক্রিপশন হাতে নিয়ে সৈকত রাস্তার পাশের দোকানে ওষুধ নিতে গেলো। সব ওষুধের দাম হলো ছয়শত পঞ্চাশ টাকা। কিন্তু সৈকতের কাছে তখন এতো টাকা নেই। পাঁচশত টাকা আছে। সৈকত বিনয়ের সাথে দোকানীকে সমস্যার কথা জানালো।এবং পরের দিন একশো পঞ্চাশ টাকা দিয়ে যাবে বলে প্রতিশ্রæতিবদ্ধ হলো। সৈকত দোকানীর মহানুভবতায় অভিভূত হলো। দৌড়ে গিয়ে ডাক্তার মশাইয়ের হাতে ওষুধ গুলো দিলো। ডাক্তার মশাই বললেন, এখনও মানুষ আছেন, মানবিকতা আছে। ওষুধ সেবনের পর অজয় (ছদ্মনাম) বাবু ধীরে ধীরে সেরে উঠলেন। সৈকত অজয় বাবু থেকে নিকটাত্মীয়ের মোবাইল নাম্বার নিয়ে উনার অসুস্থতার কথা, হাসপাতালের ঠিকানা, বেড নাম্বার জানিয়ে দিলেন। ক’দিন পর অজয় বাবু সুস্থতাবোধ করায় সৈকত উনার থেকে জেনে নিলেন তিনি কোথায় কাজ করেন। কীভাবে তিনি অসুস্থ হলেন।জানালেন তিনি ডাক বিভাগে কাজ করেন। অফিস শেষে সিটি বাসে বাড়ি যাচ্ছিলেন পথেই হার্ট অ্যাটাক। বাসের যাত্রীরা হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিলেন। অজয় বাবু বাস যাত্রীদের প্রতিও কৃতজ্ঞতা জানালেন।
এদিকে আমেজ স্যারের অবস্থাও দিন দিন উন্নতির দিকে। মাসখানেক ডাক্তার মশাইয়ের তত্ত¡াবধানে থাকতে হবে।সৈকত কোনো না কোনো বেলায় আমেজ স্যারের হাসপাতাল ডিউটি করে। ডাক্তার মশাইয়ের দেয়া খাবার মেন্যু অনুযায়ী কখনো নরম ভাত, কখনো স্যুপ,যখন যা প্রয়োজন যোগাড়ের দায়িত্ব সৈকতের। যদিও একদিন পরই আমেজ স্যারের পরিবারের সদস্যরা এসে পৌঁছে গেছেন। কিন্তু অচেনা শহরে কোথায় কী পাওয়া যায় তাতো উনারা জানেন না। তাই সব দায়িত্ব সৈকতের উপরই বর্তেছে।
সৈকত দাপ্তরিক কাজ শেষে প্রতিদিন হাসপাতালে আসে। নিজের রোগীর পাশাপাশি অন্যদেরও খোঁজ খবর নিয়ে থাকে। সবার প্রতি কেমন একটা মায়া পড়ে গেছে সৈকতের। অজয় বাবুর মতো আর কারো সাহায্যের প্রয়োজন আছে কিনা খবর নেয়। মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখতে সৈকতের ভীষণ ভালো লাগে। মানুষের জন্য কাজ করার মধ্যদিয়ে সৈকত আনন্দ খুঁজে পায়। সৈকতের মনে একটি কথাই অনুরণিত হয় “মানুষ মানুষের জন্যে”।
আমেজ স্যার সুস্থ হওয়ার পর পুনরায় কর্মস্থলে ফিরে এলেন। উনার ফেরার আনন্দ কর্মকর্তা কর্মচারী সকলেই ভাগাভাগি করে নেয়। ডাক্তার মশাই সারা জীবনের জন্য স্যারকে লম্বা একটা তালিকা ধরিয়ে দিলেন। আমৃত্যু খাওয়া দাওয়া চলাফেরার এই নিয়মেই মেনে চলতে হবে। আমেজ স্যার, অজয় বাবুরা সুস্থ থাকুক। সৈকতের মতো মানুষের জন্ম সমাজে আরও আরও হোক এ প্রত্যাশাই রইলো।
(একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে। শুধু চরিত্র গুলোতে ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে)