মানবিক সম্পর্কের উন্নয়ন ছাড়া ব্যক্তিত্বের বিকাশ সম্ভব নয়

28

 

গত কিছুদিন থেকে নারী আর মদের সংবাদ দেখতে দেখতে চোখ পরিশ্রান্ত। অর্থ আর বিত্তের প্রাচুর্য আমাদের সমাজের কিছু উচ্চবিত্ত মানুষের কাছে নারী সংগ লাভের বড় সহায়ক। মানুষের জীবনের চেয়ে নিজের ক্ষণিক আনন্দ এত বড় হয়ে উঠল, তা নিয়ে ভাববার জন্য কিছু সময় কি আমরা ব্যয় করেছি? যুগের প্রয়োজনে সরকার বিভিন্ন ধরণের আইন প্রণয়ন ও সংশোধন করবেন। আমাদের ব্যক্তিগত জীবন ও সামাজিক জীবনে আইনের চমৎকার ব্যবহার চাই। আইনগুলোকে মানুষের জীবনের প্রয়োজন ও দায়িত্ববোধের সাথে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করতে হবে। আমরা আইন মানব কারণ, আইন মানুষের কল্যাণের জন্য প্রণীত, আইনের উদ্দেশ্য হল মানুষের নিরাপত্তা বিধান, মানুষের সুস্থ ও স্বাভাবিক অস্তিত্বকে লালন পালন করা। আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রাখার দায়িত্ববোধ একজন অশিক্ষিত গাড়ি চালকের খুব একটা নাও থাকতে পারে। কিন্তু যখন দেখা যায় একজন শিক্ষিত গাড়ি মালিকের মধ্যে দায়িত্ববোধের অভাব তখন খুব খারাপ লাগে। বিভিন্ন ঘটনাগুলো নিয়ে বেশকিছু প্রতিবাদ দেখতে পাই। একটা প্রতিবাদ শেষ হতে না হতেই আরেকটি প্রতিবাদের মিছিলে যোগ দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে হয়। প্রতিনিয়ত কিছু মানুষের ব্যক্তিত্বের চরম অবনতির নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সমাজে।
আমাদের ব্যক্তিত্বের উপর অন্যজনের কাছে গ্রহণযোগ্যতা নির্ভর করে। আর অন্যের কাছে গ্রহণযোগ্যতার উপর ব্যক্তি জীবনের সাফল্য অনেকাংশেই নির্ভর করে বিধায় ব্যক্তিত্ব নিয়ে যুগ যুগ ধরে মানুষের এতো চিন্তা-ভাবনা। সবার মধ্যে এটা দেখতে পাওয়া যায় না। একজন মানুষের সৌন্দর্য বিকশিত হয় তার রুচিসম্মত ব্যক্তিত্ব প্রকাশের মাধ্যমে। মনবিজ্ঞানে ব্যক্তিত্ব হচ্ছে, কোনো একজনের মানসিক প্রক্রিয়া ও আচরণের এমন এক স্বতন্ত্র ধরন, যা কেবল তার মধ্যেই বিদ্যমান থাকবে। যা তাকে অন্যদের কাছ থেকে সেই ব্যক্তিকে আলাদা করবে। প্রতিনিয়ত যা বলি, যা করি, যা অনুভব করি, যা ভাবি, যা আশা করি, যা বিশ্বাস করি তার মাধ্যমে ব্যক্তিত্ব প্রকাশ পায়।
নিন্দা করা অথবা কাউকে অপবাদ দেওয়া এগুলো কিছু কিছু মানুষের চরিত্রের একটা অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই নিন্দার কথা শুনে অনেকে ভেঙে পড়েন। কারো নিন্দা অথবা অপবাদে মন খারাপ করে ভেঙে পড়বেন না, অবশ্যই নিজের পথে অবিচল থাকবেন। সামনে এগিয়ে যেতে হবে। আপনার চলার পথে কেউ কেউ মিথ্যা অপবাদ দিতে পারে। আপনি সমাজে যদি ভালো কিছু করতে চান খুব সহজ ভাবে করতে পারবেননা। বিভিন্ন ধরনের বাধা আপনাকে তাড়া করে বেড়াবে। কে কি বলেছেন তা চিন্তা করার দরকার নাই। কেউ মিথ্যা অপবাদ দিলেই ভেঙে পড়বেন না। হয়তো এটা আপনার দীর্ঘমেয়াদী কল্যাণের জন্যই হচ্ছে। তাই অবশ্যই আমাদের নিজের ভালোর জন্যই অন্যের সমালোচনা করা বা অন্যকে মিথ্যা অপবাদ দেওয়ার মতো মারাত্মক চক্রান্ত থেকে বিরত থাকা উচিত। না হলে আমাদের ভালোটুকুও চলে যেতে পারে। এসব ব্যাপারে আমাদের সাবধান থাকা অতি জরুরি। আর সবসময় চিন্তায়, কথায় ও কাজে সৎ হতে হবে এবং অবশ্যই আমাদের জিহŸাকে সংযত করে চলতে হবে; অর্থাৎ ভেবে চিন্তে কথা বলতে হবে।
সততা আর ভালবাসা দিয়ে নিজের ব্যক্তিত্ব প্রকাশ করতে হবে যেখানে কোনো নিন্দা থাকবেনা, মিথ্যা সমালোচনা থাকবেনা। আমাদের ব্যক্তিত্ব প্রকাশ করার জন্য এই বাজে অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে। সততা বা সত্যবাদিতার মাধ্যমেই একজন মানুষের ব্যক্তিত্ব প্রকাশ পায়। ব্যক্তিত্ব ছাড়া মানুষের সৌন্দর্য ম্লান। অনেক সময় দেখা যায় পোশাকে বেশ আধুনিক মানুষেরা বাজে চিন্তা ভাবনা প্রকাশ করতে দেখা যায়। ব্যক্তিত্ব মানুষের সুন্দর মর্জিত ভাষায় ফুটে উঠে। ব্যক্তিত্ব সহনশীল আচরণের মাধ্যমে ফুটে উঠে।ব্যক্তিত্ব ধরে রাখতে আমাদের আচার – আচারণ হতে হবে মার্জিত ও স্বাভাবিক। মানুষের মুখের চেহারার মাঝে যে ব্যক্তিত্ব লুকিয়ে আছে তা শুধু বিজ্ঞানীরা কেনো আমাদের গুরুজনেরা এমনকি ছোট ছোট বাচ্চারাও বেশ নির্ভুলভাবেই বলতে পারবে বলেই আমার ধারণা। তাই চলুন সব রকমের নিন্দা এবং মিথ্যা অপবাদ দেওয়া থেকে বিরত থাকি এবং সুন্দর সমাজ নির্মাণে সবাই সচেষ্ট থাকি।
মানবিক সম্পর্কের উন্নয়ন ছাড়া ব্যক্তিত্বের উন্নয়ন অসম্ভব। ব্যক্তিত্বকে ভেতর থেকে জাগিয়ে তোলার শ্রেষ্ঠ উপায় হলো নিজের কাছে নিজে সৎ থাকা। আপনি যা নন, তা হওয়ার চেষ্টা করবেন না। নতুন কারো সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর যদি তাদের সঙ্গে আপনার বিষয়ে মিল না থাকে, তবে ঘাবড়ানোর কিছু নেই। তাদের সঙ্গে হালকা কথাবার্তা চালাতে হবে। সব সময় মানুষের সঙ্গে বিনয় ও সুন্দর ব্যবহার করার চেষ্টা করতে হবে। অন্যকে ছোট করে অথবা অসম্মান করে কথা বলা মারাত্মক মানসিক ব্যাধি। চট করে কারও সঙ্গে রেগে কথা বলবেন না। আধুনিক সভ্য সমাজে এটি জঘন্য-ঘৃণ্য কাজ হিসেবে গণ্য করা হয়। অন্যের দোষ না খুঁজে গুণগুলো বের করুন। সেগুলো নিজের চরিত্রের সঙ্গে মেলান। দেখবেন আপনার দোষগুলো আস্তে আস্তে মিলে যাচ্ছে। তাই সতর্ক হোন। না হলে নিশ্চিত থাকুন, সামনে বন্ধুহীন হওয়ার নিশ্চিত সম্ভাবনা রয়েছে।
আমরা অনেকে আছি রাগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারিনা। কেউ কেউ আছেন যখন-তখন রেগে যান। এ ধরনের আচরণ ব্যক্তিত্ব নষ্ট করতে পারে। সুতরাং রাগ নিয়ন্ত্রণে রেখে ঠান্ডা মাথায় যে কোনো পরিস্থিতি সামাল দিতে চেষ্টা করুন। একজন মানুষ সবজান্তা হতে পারে না। সব বিষয়ে তাকে জানতে হবে এমন কোনো নিয়মও নেই। সুতরাং আড্ডা বা যেকোনো রকম আলোচনায় সব বিষয়ে মত দিতে যাবেন না। যে বিষয়ে আপনার জানা নেই, সেটা স্বীকার করে সে বিষয়ে মতামত দেওয়া থেকে বিরত থাকুন। অহেতুক অজানা বিষয়ে মতামত দিতে গিয়ে অন্যের কাছে হাসির পাত্র হবেন না। শারীরিক ভাষা ঠিক রাখার চেষ্টা করতে হবে।
ইভটিজিং নামে নারী নির্যাতনের বিষয়টি আজকের দিনে অনেক সচেতন মানুষের চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাস্তার বখাটে তরুণ, কতিপয় সহপাঠী থেকে শুরু করে কিছু শিক্ষক, নেতা পরিচয়দানকারী কিছু লোক, এবং লেখাপড়া জানা অনেকেই এখন নারীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নির্যাতনকারী হয়ে উঠেছেন। ইভটিজারদের নিয়ন্ত্রণ করতে সরকার নানা রকম আইন করেছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও এ ব্যাপারে তৎপর। হঠাৎ কেন তরুণ সমাজের একটা অংশ ইভটিজার হয়ে উঠল তা অবশ্যই চিন্তার কথা। অপরাধীকে শাস্তি দেয়ার পাশাপাশি এগুলোর কারণ অন্বেষন করা দরকার, প্রয়োজনে যথাযথ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। একটা সময় ছিল বাবা মা দেখতেন, তার সন্তানটি কার সাথে মিশছে, কী বই পড়ছে,কিন্তু এখন মোবাইল ফোন এবং ইন্টারনেটের অবাধ তথ্য প্রবাহে কী আছে তা মা বাবার জানার মধ্যে অনেক সময় থাকেনা। আমরা জানি তথ্য প্রবাহের সব তথ্যই খুব সৎ বা আদর্শবাদী বা সুস্থ ধারার তথ্য নয়।
ভাল এবং মন্দ দুটোরই প্রাধান্য প্রবল। আমাদের খেয়াল রাখতে হবে সুন্দর ব্যক্তিত্ব প্রকাশের জন্য নিজেদের মার্জিত চাহিদা, রুচি ও মূল্যবোধ অনুযায়ী জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ নির্বাচন করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। আমরা অনেক শক্তিধর হতে পারি। শক্তি দিয়ে অনেক মানুষের চিন্তাধারাকে দমন করা যেতে পারে। নিজের নির্লজ্জ ব্যবহার দিয়ে আরেকজনের মনে আঘাত দিতে পারি। কিন্তু সবকিছুর একটা হিসাব নিকাশ থাকবেই। এই ছোট জীবনে অনেক মানুষ দেখেছি যাদের বয়স শেষে নিজের ক্ষমতা, প্রতিপত্তি আর দেখা যায়না। আত্মীয় পরিজনকে আর কাছে পাওয়া যাবেনা। তাই চারদিকে এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে যাতে সবাই আপন করে নিতে পারে। নিজের ব্যক্তিত্ব ঠিক রেখে আগামী প্রজন্মের জন্য একটা বাসযোগ্য পৃথিবী নির্মাণে সবার ভূমিকা থাকতে হবে।

লেখক: প্রাবন্ধিক