মানবিক সমাজের প্রত্যাশা

24

কামরুল হাসান বাদল

কথাটি হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন, ‘আপনি যখন একটি ভুল করেন তার মানে আপনি মানুষ, আর ভুল করার পর যদি অনুতপ্ত হন তখন আপনি ভালো মানুষ।’ হুবহু না হলেও তার কথার মমার্থটি এমনই।
মানুষ মাত্রই ভুল করবে, খুবই স্বাভাবিক। অপরাধও করবে এটাও স্বাভাবিক। সে ভুল করার পর যদি সে অনুতপ্ত হয় তখন বুঝে নিতে হবে একদিন সে শুধরে যাবে। তেমনি যতক্ষণ পর্যন্ত একটি সমাজ বা রাষ্ট্রে একটি মানুষ ভুল করে, অপরাধ করে পরে লজ্জিত হয়, অনুতপ্ত হয় ততক্ষণ সে সমাজ বা রাষ্ট্রকে সভ্য বলা যাবে, মানুষের বাসযোগ্য বলা যাবে। আর যদি তার উল্টোটি ঘটে অর্থাৎ ভুল করে, অপরাধ করে লজ্জিত বা অনুতপ্ত হওয়ার পরিবর্তে সে ভুল ও অপরাধকে ‘জায়েজ’ করার চেষ্টা করে এবং এই জায়েজের কাজটি করার জন্য সমাজের অনেকে এগিয়ে আসে তখন ভাবতে হবে সে সমাজ বা রাষ্ট্র অসভ্য। সেটি মানুষের বাসযোগ্য নয়।
বিষয়টি আরও ভয়ানক, অমানবিক ও বিপজ্জনক হয়ে ওঠে যখন সে ভুল, অপরাধ ও অপকর্মকে ঢাকা দিতে ধর্মকে ব্যবহার করা হয়।
সা¤প্রতিক সময়ে এই প্রবণতাগুলো অত্যন্ত প্রকট হয়ে উঠেছে। মানুষের সাধারণ বিবেকবোধও যেন হারিয়ে যেতে বসেছে। প্রতিদিন এমন সংবাদ দেখতে দেখতে, পড়তে পড়তে, শুনতে শুনতে সুস্থ মানুষও অসুস্থ হয়ে পড়ছে। এর থেকে পরিত্রাণের পথ কী তাও আমরা খুঁজে বের করতে পারছি না।
দিনদিন সমাজে অমানবিক আচরণের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। নারী ও শিশুরাই বেশি আক্রান্ত হচ্ছে এই ধরনের নিষ্ঠুরতায়। প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও ধর্ষণ, অনাচার, বলাৎকার ও নিষ্ঠুরতার ঘটনা ঘটছে। আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিশুরা নিরাপদ নয়, শিক্ষার্থীরা নিরাপদ নয়। মাদ্রাসা, যেখানে দ্বীনি শিক্ষা দেওয়া হয় সেখানেও শিক্ষার্থীরা নিরাপদ নয় এমনকি মসজিদ সেখানেও ঘটছে অপরাধ।
আমাদের আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে নিয়ে বিষোদগার করে এসেছে এক ধরনের মানুষ। তাদের ভাষায় সেখানে নির্লজ্জতা, বেহায়াপনার শিক্ষা দেওয়া হয়। সেখানে শিক্ষালাভ করে শিক্ষার্থীরা উচ্ছন্নে যাচ্ছে। কিন্তু এখন প্রকাশ হচ্ছে যারা দেশের আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে দিনের পর দিন বিষোদগার করে তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই শিক্ষার্থীরা নিরাপদ নয় বরং তাদের প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী নিগৃহীত হওয়ার ঘটনাই বেশি।
নৈতিক শিক্ষা যারা দেন বলে দাবি করেন, ধর্মীয় শিক্ষা দেন বলে যারা দাবি করেন তারাই যখন অনৈতিক কাজ করেন, অধর্মের কাজ করেন তখন ভাবতে হবে সমাজ ঠিক পথে নেই। রাষ্ট্র ঠিক পথে নেই। সে সমাজ ও রাষ্ট্রের মানুষ ঠিক নেই।
অন্য এক বিপদের মধ্যেও আছি। এসব অনিয়ম নিয়ে বলতে গেলে, লিখতে গেলে একশ্রেণির মানুষ তা ইসলামবিরোধী মনোভাব বলে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষকে উসকে দিতে চেষ্টা করে। এরা আমাদের আশেপাশে থাকে। এরা বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাÐে অংশও কিন্তু অন্তরে এরা জঙ্গিবাদকেই লালন করে।
একটি উদ্দেশ্য নিয়ে এ ব্যক্তিরা এমন কাজ করে থাকেন। তারা ধর্মের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আপনাকে বিব্রত করবে। উত্ত্যক্ত করবে আর এরূপ করতে করতে আপনি অসতর্কভাবে যদি কোনো বেফাঁস কথা বলে ফেলেন তখন তারা আপনাকে নাস্তিক, মুরতাদ বলে ফাঁসিয়ে দেবে, রটিয়ে দেবে। ব্যস এরপর এদেশে বাস করা আপনার পক্ষে কঠিন হয়ে উঠবে।
মানুষকে বলা হয় সৃষ্টির সেরা জীব। তার কারণ হলো মানুষের চিন্তাশক্তি আছে। ভাব বিনিময়ের জন্য ভাষার ব্যবহার জানে। তা দিয়ে মানুষ পৃথিবীর প্রায় সমস্ত প্রাণিকে বশ করতে পেরেছে। এই মানুষেরও একটি সীমাবদ্ধতা আছে যা আর কোনো প্রাণির নেই। এই একটি ক্ষেত্রে মানুষ নিরুপায়। (মাফ করবেন এই প্রসঙ্গটি আমার আগের বেশ কয়েকটি লেখায় উল্লেখ করেছি। অনেক পাঠক অন্যত্র শুনে ও পড়ে থাকবেন।) মানুষ ছাড়া অন্য কোনো প্রাণির বাচ্চাকে লালন-পালন করতে হয় না। তাদেরকে আনুষ্ঠানিক শিক্ষাও দিতে হয় না। বাঘের বাচ্চা বাঘই হয়, বাঘ হয়ে ওঠার জন্য বা শিকার ধরার জন্য তাকে শিক্ষা দিতে হয় না। তেমনি করে গরুর বাচ্চা গরু হয়। হরিণের বাচ্চা হরিণ হয়, সাপের বাচ্চা সাপ হয়। ময়ুরের কোনো ছানাকে পেখম দোলানোর শিক্ষা দিতে হয় না। শুধু মানুষকে দিতে হয়। মানুষের বাচ্চাকে মানুষ হয়ে উঠবার শিক্ষা দিতে হয়। তাকে হাঁটা-চলা শেখাতে হয়, কথাবলা শেখাতে হয়, সামাজিক রীতিনীতির শিক্ষা দিতে হয় এবং শিক্ষার জন্য শিক্ষায়তনে পাঠাতে হয়। এরপরও আমৃত্যু মানুষকে মানুষ হয়ে থাকার জন্য নিরন্তর প্রচেষ্টা জারি রাখতে হয়। এরমধ্যে যখন ব্যত্যয় ঘটে, চ্ছেদ পড়ে তখনই কেউ কেউ মানুষ থেকে অমানুষে পরিণত হয়, মানুষ দানব হয়ে ওঠে। তাই মানুষকে মানুষ হয়ে থাকবার জন্য আমৃত্যু প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়। এই মানুষ হয়ে উঠবার, মানুষ হয়ে থাকবার প্রেরণাটি দেয় মানুষের শুভবোধ। শিক্ষা থেকে আহরিত প্রজ্ঞা, উদার চিন্তা এবং সংস্কৃতিচর্চাই মানুষের মনে শুভবোধের উদয় করে। সেটি গোষ্ঠীবদ্ধ চিন্তা ও সা¤প্রদায়িক শিক্ষার মাধ্যমে সম্ভব নয়। যে কারণে দেখা যায় ধর্মের প্রভাব কম এমন সমাজ ও রাষ্ট্রে দুর্নীতি-অনিয়ম কম। কারণ সে সমাজে মানুষ পরিচালিত হয় বিবেক ও মনুষ্যত্ব দ্বারা। কাউকে তুষ্ট করার প্রতিযোগিতা সেখানে নেই। বর্তমানে সমাজে ধার্মিকের সংখ্যা বেড়েছে। সেটা সব ধর্মের। মসজিদে নামাজির সংখ্যা, মন্দিরে পূজারীর সংখ্যা অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেড়েছে। আচার-আচরণে মানুষের অনেক পরিবর্তন এসেছে। এতে কেউ নাখোশ হচ্ছে না কিন্তু তার ফলে সমাজ বা রাষ্ট্রে তো ঘুষ-দুর্নীতি, নকল-ভেজাল, ধর্ষণ-বলাৎকার, ছিনতাই-রাহাজানি কমে যাওয়ার কথা। সেটা না কমে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কেন? তাহলে কি আমাদের সকলকিছুই মেকি? লোকদেখানো? ধর্মীয় আচার কি তবে নিজের কুৎসিত রূপটাকে আড়াল করার চেষ্টা? এইসব ভÐামি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। বেরিয়ে আসতে হলে সমাজের সকল স্তরে সততা, ন্যায় ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। পোশাক-আশাকে ধার্মিক না সেজে মনে-প্রাণে ধার্মিক হতে হবে।
মাৎস্যন্যায় বলে একটি যুগ ছিল বাংলায় সপ্তম শতকের মাঝামাঝি থেকে প্রায় একশ বছর সময়টি ছিল ব্যাপক অরাজকতাপূর্ণ। সমাজে কোনো সুশাসন বা ন্যায়পরায়নতা ছিল না। মাছেদের জগতে যেমন বড় মাছগুলো ছোটমাছদের গিলে খায় তেমনি করে সমাজে বড় ও সবলরা ছোট ও দুর্বলদের খেয়ে ফেলতো অর্থাৎ শোষণ-ত্রাসন চালাতো। সে সময়টিকে ইতিহাসবিদরা মাৎস্যন্যায় বলে।
সমাজে কমবেশি এখনো সে প্রথা উপস্থিত আছে। সবলরা এখনো দুর্বলের প্রতি অন্যায় ও অবিচার করে। সেটি কখনো ক্ষমতার দাপটে, কখনো সবল বা সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার সুযোগে। এটা না করাই হলো মানবতা। এখন মানবিক হওয়ার আহŸান ছাড়িয়ে বলা হচ্ছে প্রাণবিক হতে। অর্থাৎ প্রাণ আছে এমন সবকিছুর প্রতি সদয় হওয়া। মানুষ ভেবে নিয়েছে পৃথিবীটা শুধু মানুষের। আসলে পৃথিবীটা শুধু মানুষের নয়। গাছপালা, লতাপাতা, পশুপাখি, কীটপতঙ্গ, সবার। মানুষ যদি ভালো থাকতে চায় তাহলে এদের সবাইকে নিয়ে ভালো থাকতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট