মানবসেবা ইসলামের অপরূপ সৌন্দর্যের এক অনন্য উদাহরণ

48

 

ইসলাম মানবতার ধর্ম। মানুষের প্রতি দয়া, স্নেহ, ভালোবাসা, আন্তরিকতা, মমতাবোধ, সহমর্মিতা ও সহানুভূতি ইসলামের অপরূপ সৌন্দর্যের অনন্য দৃষ্টান্ত। সৃষ্টির প্রতি রহমত স্বরূপ আল্লাহ তা‘আলা প্রেরণ করেছেন তাঁর প্রিয় হাবীব রহমাতুল্লিল আলামিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন, হে হাবীব! আমি আপনাকে সৃষ্টি জগতের রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছি (সূরা আম্বিয়া ১০৭)
তাই আমাদের প্রিয় নবীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অন্যতম দিক ছিল সৃষ্টির সেবা করা এবং অন্যের ব্যথায় সমব্যথী হয়ে অভাবী ও বিপদগ্রস্তদের প্রতি সহানুভূতির হাত প্রসারিত করা। তিনি বারবার তাগিদ দিয়ে বলেছেন, “তোমরা সৃষ্টির প্রতি অনুগ্রহ করো, তাহলে তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করা হবে।” (বুখারী)
তিনি আরও এরশাদ করেন, “আল্লাহ তা‘আলা মানুষের প্রতি দয়া প্রদর্শনকারীর উপর দয়া করেন। তোমরা জগৎবাসীর প্রতি দয়া ও অনুগ্রহ করো, তাহলে আসমানের মালিকও তোমাদের প্রতি দয়া ও অনুগ্রহ করবেন।” ( তিরমিযী-১৯২৪)
মূলত আল্লাহ তাআলা মুসলিম জাতিকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে আসীন করেছেন একমাত্র মানবতার কল্যাণের জন্যই। আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন, “তোমরাই হলে সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মত, তোমাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে মানবজাতির কল্যাণের জন্য। (সূরা আলে ইমরান-১১০)
মানুষের প্রয়োজনে মানুষের পাশে থেকে তার প্রয়োজন পূরণ করার নামই হল মানবসেবা। ক্ষুধার্তকে খাদ্য দেয়া, বস্ত্রহীনকে বস্ত্র দেয়া, গৃহহীকে গৃহের ব্যবস্থা করা, বন্যার্তদের ত্রাণ সহযোগিতা দেয়া, বিধবা ও হতদরিদ্রদের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করা ইত্যাদির নাম হল মানবসেবা। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, “আল্লাহ তা‘আলা ওই ব্যক্তির প্রয়োজন পূরণ করবেন যে তার ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণ করবে। যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের কোন সমস্যা সমাধান করলো, কেয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা ওই ব্যক্তির সমস্যাগুলো সমাধান করে দেবেন। আর যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের দোষ-ত্রæটি গোপন রাখবে, আল্লাহ তাআলাও কেয়ামত দিবসে ওই ব্যক্তির দোষ-ত্রæটি গোপন রাখবেন।” (মুসলিম-২৬৯৯)
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও ইরশাদ করেন, “কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের উদ্দেশ্য করে বলবেন, হে আদম সন্তান, আমি অসুস্থ ছিলাম কিন্তু তুমি আমার সেবা-শুশ্রƒষা করনি। তখন বন্দা বলবে, হে আমার রব, আপনিতো বিশ্ব জাহানের প্রতিপালক। আমি কীভাবে আপনার সেবা করব? তিনি বলবেন, তুমি কি জানতে না যে, আমার অমুক বান্দা অসুস্থ হয়েছিল, অথচ তুমি তাকে দেখতে যাওনি। তুমি কি জানো না, যদি তুমি তার সেবা করতে তাহলে আমার সেবা করা হত এবং তুমি তার কাছে আমাকে পেতে।
হে আদম সন্তান, আমি তোমার কাছে আহার চেয়েছিলাম, অথচ তুমি আমাকে আহার করাও নি। বান্দা বলবে, হে আমার রব, তুমি তো বিশ্বপালনকর্তা, তোমাকে আমি কীভাবে আহার করাবো? তিনি বলবেন, তুমি কি জানো না যে, আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে খাবার চেয়েছিল। অথচ তাকে তুমি খাদ্য দাও নি। তুমি কি জানো না যে, তাকে যদি তুমি আহার করাতে তাহলে আমাকেই আহার করা হত এবং আজ তা প্রাপ্ত হতে।
হে আদম সন্তান, তোমার কাছে আমি পানি চেয়েছিলাম। অথচ তুমি আমাকে পানি দাও নি। বান্দা বলবে, হে আমার প্রভু, তুমি তো রাব্বুল আলামীন, তোমাকে কীভাবে আমি পানি পান করাবো? তিনি বলবেন, তোমার কাছে আমার অমুক বান্দা পানি চেয়েছিল। কিন্তু তুমি তাকে পানি পান করাও নি। তাকে যদি পান করাতে তবে নিশ্চয় আজ তা পেতে।’ (মুসলিম-৬৭২১)
আমাদের মনে রাখতে হবে, আল্লাহ তা‘আলা যা সম্পদ আমাদেরকে দিয়েছেন তা শুধু আমাদের নিজেদের ভোগ করার জন্য দেন নি; বরং এতে গরিব, মিসকিন ও অভাবীদেরও হক রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন, “আর তাদের ধন-সম্পদে রয়েছে প্রার্থী ও বঞ্চিতদের হক।”(আয যারিয়াত-১৯)
প্রিয় নবীজি স্বীয় নবুয়তের দায়িত্ব গ্রহণের পূর্বেও কিছু কল্যাণকামী সচেতন যুবকদের নিয়ে গঠন করেছিলেন ‘হিলফুল ফুযুল’ নামক মানবিক সংগঠন। যে সংগঠনের মূল উদ্দেশ্যই ছিল নিঃস্ব, অসহায়, দুর্বল, মজলুম এবং দুস্থ মানবতার সেবায় এগিয়ে আসা।
সর্বপ্রথম ওহী নাযিল হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কিছুটা ভয় অনুভব করলেন, তখন হযরত খাদীজা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা প্রিয় নবীকে আশ্ব^স্ত করতে গিয়ে বলেছিলেন: “কখনো নয়, আল্লাহর শপথ, আল্লাহ আপনাকে কখনো অপমানিত করবেন না। কারণ, আপনি আত্মীয়দের প্রতি দয়াশীল, পীড়িত ও অক্ষমদের ব্যয়ভার বহন করেন, নিঃস্বদের জন্য উপার্জন করেন, আপনি অতিথিপরায়ন এবং সত্যিকার বিপদাপদে সদা সাহায্যকারী।’ [বুখারী: ০৩; মুসলিম: ৪২২]
অভুক্ত ব্যক্তিকে আহার্য দেয়ার প্রতি উৎসাহ প্রদান করতে গিয়ে রাসূল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, “মানুষের কল্যাণ সংশ্লিষ্ট যত কাজ আছে, তার মধ্যে সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম হচ্ছে দরিদ্র ও ক্ষুধার্তকে খাবার দান করা।” (হাদিস-১২)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: ‘বিধবা ও অসহায়কে সাহায্যকারী ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারীর সমতুল্য।’ (বর্ণনাকারী বলেন,) আমার ধারণা তিনি আরও বলেন, এবং সে ওই সালাত আদায়কারীর ন্যায় যার ক্লান্তি নেই এবং ওই সিয়াম পালনকারীর ন্যায় যার সিয়ামে বিরাম নেই।’ [বুখারী: ৬০০৭; মুসলিম: ৭৬৫৯]
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন, “ওই ব্যক্তি পরিপূর্ণ মুমিন নয়, যে তৃপ্তি সহকারে আহার করে আর তার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত থাকে।” (মুসতাদরাক)
অনাহারীর কষ্টের ভাগীদার হতে এবং জনমদুখী বান্দার দুঃখে সমব্যথী হতে আল্লাহ তা‘আলা রমযানের সিয়াম ফরয করেছেন। দুঃখীর অভাব মোচনে যাকাত ফরয ও সাদাক্বাতুল ফিতর ওয়াজিব করেছেন। একই উদ্দেশ্যে সালাত, সিয়ামের ফিদইয়া এবং কসমের কাফফারাসহ নানা আর্থিক বিধি-বিধান প্রবর্তন করেছেন।
মানুষ সামাজিক জীব হওয়ায় একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। মানুষের এই নির্ভরশীলতাই মানুষকে জানিয়ে দিতে চায় যে, তুমি অন্যের সেবার ওপর নির্ভরশীল। ধনী-গরিব, নারী-পুরুষ সবাইকে কারো না কারো সেবা গ্রহণ করতেই হবে। জন্মের সূচনায়ই মানুষ অন্যের সেবায় নির্ভর করে বেড়ে ওঠে। অনুরূপভাবে জীবনের শেষ বেলায় কাফন-দাফনের সময়ও মানুষ পুরোপুরি অন্যের ওপর নির্ভরশীল। মানুষের এই পারস্পরিক নির্ভরশীলতা মানুষকে একে অপরের সেবা করার শিক্ষা দিতে চায়।
পবিত্র কোরআন ও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিসে যতগুলো সৎকর্মের নির্দেশ রয়েছে তম্মধ্যে দুর্গত, বিপন্ন ও অভাবী মানুষের সাহায্য-সহযোগিতা করা, অর্থ, খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ইত্যাদি নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী দিয়ে সহায়তা করার কথা বলা হয়েছে। এগুলো অত্যধিক সাওয়াবের কাজ ও এই ব্যয় আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় বলেই বিবেচিত করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা কোরআনে পাকে এরশাদ করেন, “যারা আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে তাদের উপমা হচ্ছে একটি শষ্যবীজের ন্যায়, যা সাতটি শীষ উৎপাদন করে এবং প্রত্যেক শীষের এক‘শ দানা। আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাকে বহুগুণে দান করেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।’ (সুরা বাকারা, আয়াত -২৬১)
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন, “দানশীল ব্যক্তি আল্লাহর সন্নিকটে, জান্নাতের কাছাকাছি এবং মানুষের নিকটবর্তী। আর কৃপণ ব্যক্তি আল্লাহ থেকে দূরে, মানুষ থেকে দূরে এবং জাহান্নামের কাছাকাছি।’ (তিরমিযি)
সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে অভাব থাকার পরও তাঁরা অন্যকে প্রধান্য দিতেন। সাহাবি হযরত ওমর বিন খাত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু যখন খলিফা ছিলেন, গমের বস্তা কাঁধে করে অভাবীদের ঘরে পৌঁছে দেন। এরকম অসংখ্য দৃষ্টান্ত ইসলামের ইতিহাসে বিরাজমান। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা তাঁদের ভূয়সী প্রশংসা করে বলেছেন, “আর তারা আল্লাহকে ভালোবেসে খাদ্য দান করে মিসকিন, এতিম ও বন্দীদের। তারা বলে, শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আমরা তোমাদের খাদ্য দান করেছি, তোমাদের কাছে আমরা এর জন্য কোনো বিনিময় চাই না এবং কোনো কৃতজ্ঞতাও না।” (সূরা : দাহর, আয়াত : ৮-৯)
আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন, ‘তারা তাদের খাবারের প্রতি ভালোবাসা থাকা সত্তে¡ও সে খাবার অসহায়, এতিম এবং বন্দীদের খাওয়ায়। ’ (সুরা : দাহার, আয়াত : ৮)
এই আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা অসহায়, মিসকিন ও বন্দীদের খাবার দান করাকে মুমিনদের বৈশিষ্ট্য বলে উল্লেখ করেছেন। অন্য এক আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা কাফিরদের মন্দ স্বভাব বর্ণনা করে বলেন, কাফিরদের যে কয়টা মন্দ স্বভাব আছে, সেগুলোর মধ্যে একটি হলো, ‘সে মিসকিনকে খাবার খাওয়ানোর ব্যাপারে মানুষকে উৎসাহিত করে না। ’ (সুরা: মাউন: ৩)

লেখক: বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ, সাদার্ন
বিশ্ববিদ্যালয়, খতীব, মুসাফিরখানা জামে মসজিদ