মানবসম্পদ : পরিপ্রেক্ষিত বাংলাদেশ

39

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

এটি সর্বজনবিদিত; যে কোন জাতিরাষ্ট্রের টেকসই আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন মূল্যায়নে দক্ষ জনগোষ্ঠী প্রণিধানযোগ্য নিয়ামক হিসেবে বিবেচিত। মুক্তির মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু তাঁর নেতৃত্বে দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতাকে অর্থবহ করার উদ্দেশ্যে সূচনালগ্ন থেকেই মানবসম্পদ উন্নয়নে প্রয়োগিক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে তাঁর আজীবন লালিত স্বপ্ন ও সংগ্রামের অমিত ফসল স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন ও যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ বিনির্মাণে ‘এসো দেশ গড়ি’ প্রত্যয়কে অবিচল ধারণ করেই মানবসম্পদ উন্নয়নে সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেন। সুপরিকল্পিত কর্মকৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে নিরলস মেধা-নিষ্ঠার সমন্বয়ে প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি কারিগরি-ধর্মীয়-নৈতিক শিক্ষাকে একীভূত করে আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক গুনগত শিক্ষার মানদন্ডকেই মানবসম্পদ উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু রূপে চিহ্নিত করা হয়।
সচেতন মহল সম্যক অবগত আছেন যে, মানবসম্পদ উন্নয়নের মৌলিক অনুষঙ্গ হচ্ছে উদ্দিষ্ট সমাজের সমৃদ্ধ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি বিশ্বখ্যাত মহাকাশ বিজ্ঞানী শিক্ষা-জ্ঞানার্জনে তাঁর অর্জিত অভিজ্ঞতা ও দর্শন থেকে উচ্চারিত মহামূল্যবান বাণীগুলো বর্তমান সময়ের জন্য অত্যন্ত প্রযোজ্য। ‘একটি ভালো বই একশো ভালো বন্ধুর সমান, কিন্তু একজন ভালো বন্ধু একটি লাইব্রেরির সমান। সফলতার গল্প পড়ো না, কারণ তা থেকে তুমি শুধু গল্পটাই পাবে। ব্যর্থতার গল্প পড়ো, তাহলে সফল হওয়ার কিছু উপায় পাবে। তুমি যদি সূর্যের মতো আলো ছড়াতে চাও, তাহলে আগে সূর্যের মতো পুড়তে শেখো। উদার ব্যক্তিরা ধর্মকে ব্যবহার করে বন্ধুত্বের হাত বাড়ান, কিন্তু সংকীর্ণমনস্করা ধর্মকে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। জীবন ও সময় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। জীবন শেখায় সময়কে ভালোভাবে ব্যবহার করতে আর সময় শেখায় জীবনের মূল্য দিতে।’ উল্লেখ্য প্রয়োজনীয় বার্তাগুলো নিত্যদিনের জীবনযাপনে কতটুকু মনুষ্যত্ব-সৃজন-মননশীল মূল্য সংযোজন করে প্রকৃত মানবিক মানবসম্পদ রূপান্তরে অনবদ্য অনুষঙ্গ বিবেচ্য তা ভেবে দেখার আবশ্যকতা অত্যধিক।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২১ সূত্রমতে বর্তমান সরকারের উন্নয়ন এজেন্ডার মূল লক্ষ্য হচ্ছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি মানবসম্পদ উন্নয়ন। লক্ষ্য পূরণে সরকার ২০২০-২১ অর্থবছরে আর্থ-সামাজিক খাতে ২৩.৭৫ শতাংশ হারে বাজেট বরাদ্দের মাধ্যমে মানবসম্পদ উন্নয়নের বিভিন্ন খাত তথা শিক্ষা ও প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ, নারী ও শিশু, সমাজকল্যাণ, যুব ও ক্রীড়া উন্নয়ন, সংস্কৃতি, শ্রম ও কর্মসংস্থান ইত্যাদি খাতে পর্যাপ্ত অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এর আলোকে মানসম্মত দক্ষ-যোগ্য মানবসম্পদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বহুবিধ কর্মসূচির মধ্যে অন্যতম ছিল মহিলা শিক্ষক নিয়োগ, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি, প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা, উপবৃত্তি ও ছাত্র-শিক্ষক সংযোগ ঘণ্টা বৃদ্ধি। স্বাস্থ্য-পুষ্টি ও জনসংখ্যা খাতে সরকারের নেয়া অগ্রাধিকারভিত্তিক বিভিন্ন কর্মকান্ডের ফলে দেশে প্রজনন ও মৃত্যু হার হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি, নবজাতক শিশু ও মাতৃ মৃত্যু হ্রাসে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির জন্য নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই এ সংক্রান্ত সহস্রাব্দ উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। বর্তমান সরকার স্বাস্থ্যখাত সংক্রান্ত এসডিজি অর্জনের লক্ষ্যে নিরলস কর্ম সম্পাদন করে যাচ্ছে। করোনা ভাইরাস এর বিস্তার রোধ ও নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি কোভিড-১৯ মহামারি থেকে জনজীবন সুরক্ষায় সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির আওতায় দেশের নাগরিকদের গণটিকা প্রদান করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যানের তথ্যমতে, ২৭ জানুয়ারি থেকে ৯ ডিসেম্বর ২০২১ পর্যন্ত সারাদেশে টিকা নিয়েছেন ১০ কোটি ৮৩ লাখ ৩০ হাজার ৭১৯ জন। তন্মধ্যে প্রথম ডোজের টিকা নিয়েছেন ৬ কোটি ৬২ লাখ ৮৭ হাজার ৩৯৬ জন ও দ্বিতীয় ডোজের টিকা নিয়েছেন ৪ কোটি ২০ লাখ ৪৩ হাজার ৩২৩ জন।
বিগত ও সমসাময়িক বাজেট বিশ্লেষণ মানবসম্পদ উন্নয়নের সঠিক চিত্র যথাযোগ্য অনুধাবনের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। মানবসম্পদ উন্নয়নে শিক্ষা, স্বাস্থ্যখাতসহ সামাজিক খাতসমূহে অধিক বিনিয়োগের অপরিহার্যতায় সরকার সংশ্লিষ্ট খাতে বাজেট বরাদ্দ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি করেছে। খাতগুলোকে পূর্ণতাদান ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ কার্যকরণে ২০২০-২১ অর্থবছরে মানবসম্পদ উন্নয়নে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল মোট বাজেটের প্রায় ২৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ। বিপরীতে ২০২১-২২ অর্থবছরে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৮৪৭ কোটি ( মোট বাজেটের ২৫.৮১ শতাংশ)। জাতিসংঘের মানবউন্নয়ন প্রতিবেদন ২০২০ অনুযায়ী মানব উন্নয়ন সূচকে বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৩ তম যা ২০১৬, ২০১৭ ও ২০১৮ সালে ছিল যথাক্রমে ১৪২, ১৩৯ ও ১৩৬ তম। মানবসম্পদ উন্নয়ন সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহের মধ্যে নেপাল, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের অবস্থান বাংলাদেশের নিম্নতর পর্যায়ে হলেও ভারত, শ্রীলংকা, মালদ্বীপ, ভূটান এর অবস্থান এখনো বাংলাদেশের উর্ধ্বে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো’র সর্বশেষ ২০১৬-১৭ শ্রমশক্তি জরিপ অনুসারে দেশে ১৫ বছরের উর্ধ্বে অর্থনৈতিকভাবে কর্মক্ষম মোট শ্রমশক্তি ৬ দশমিক ৩৫ কোটি। বিপুল সংখ্যক কর্মক্ষম এই জনসম্পদকে যথাযথভাবে ব্যবহার করে জনভিত্তিক লভ্যাংশ আহরণে সরকারের নানামুখী উদ্যোগ অত্যন্ত প্রশংসনীয়। মানবসম্পদ উন্নয়নের নিরন্তর প্রয়াসে সুবিধাবঞ্চিত ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনমান পরিবর্তনে বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ অবশ্যই সরকারের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ।
শিক্ষা ও প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ, নারী ও শিশু, সমাজকল্যাণ, যুব ও ক্রীড়া উন্নয়ন, সংস্কৃতি, শ্রম ও কর্মসংস্থান মানবসম্পদ উন্নয়নের অন্যতম চাবিকাঠি হিসেবে এসব খাতসমূহের বাজেট বরাদ্দ শুধু বৃদ্ধি করলে চলবে না, সংশ্লিষ্ট কর্মসূচি সমূহের যথাযথ বাস্তবায়ন ও কাঙ্খিত ফলাফল সম্পর্কে বিস্তৃত ধারণা অতীব প্রয়োজন। এর জন্য নিয়মিত পর্যবেক্ষন ও মূল্যায়ন এবং ধারাবাহিকতা ব্যাহত হওয়ার প্রতিবন্ধকতাসমূহ চিহ্নিত করতে হবে। সুখের বিষয় হচ্ছে বিগত বছরের তুলনায় এটি বৃদ্ধি পেয়ে চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে সংশ্লিষ্ট খাতসমূহে মোট বাজেটের ২৯.৪ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল হলেও জাতীয় বাজেটে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাত উন্নয়নে বরাদ্দ বাড়ানোর মাধ্যমে বাস্তবসম্মত কর্মসূচি প্রতিপালনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার স্তরে লিঙ্গ বৈষম্যের তুলনামূলক ব্যবধান নিম্নমুখী হলেও প্রজনন হার হ্রাস, শিশু ও মাতৃ মৃত্যুহার হ্রাস, যক্ষা ও এইডস এর বিস্তার রোধ, গড় আয়ু বৃদ্ধি ইত্যাদির ক্ষেত্রে উর্ধ্বমূখী অগ্রগতি শুধু দেশে নয়; বিশ্বপরিমন্ডলেও দেশ ও সরকার বিপুলভাবে প্রশংসিত। সৃজনশীল, কর্মমুখী, বিজ্ঞানধর্মী, উৎপাদন সহায়ক শিক্ষায় শিক্ষিত জনগোষ্ঠী তৈরী করার জন্য অধিকতর মনোযোগ আকর্ষণের দাবী রাখে। জনমুখী উন্নয়ন ও প্রগতিতে নেতৃত্বদানের উপযোগী মননশীল, যুক্তিবাদী, নীতিবান, অসাম্প্রদায়িক, কুসংস্কারমুক্ত, পরমতসহিষ্ণু, দেশপ্রেমিক এবং মানবিক নাগরিক যথার্থ অর্থে গড়ে তোলা না গেলে ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সংকটমুখী হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।
এটি নিঃসন্দেহে সমাদৃত যে, নিরক্ষরতা দূরীকরণে প্রাথমিক শিক্ষার প্রতি সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করে ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রাথমিক শিক্ষা খাতে মোট ২৬ হাজার ৩১৪ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’ তথা “Inclusive and equitable quality education and ensuring life long learning for all” এর সফল বাস্তবায়নে গ্রহণীয় উদ্যোগ যেমন উপবৃত্তি প্রকল্প, চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি (পিইডিপি-৪), রিচিং আউট অব স্কুল চিলড্রেন (রস্ক) প্রকল্প, দারিদ্রপীড়িত এলাকায় স্কুল ফিডিং কর্মসূচি, চাহিদাভিত্তিক সরকারি ও নতুন জাতীয়করণকৃত প্রাথমিক বিদ্যালয় উন্নয়ন কেন্দ্র (১ম পর্যায়) এবং ৬৪ জেলায় মৌলিক স্বাক্ষরতা প্রকল্পসহ অনেক প্রকল্প বাস্তবায়ন অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে মোট প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল ৪৯,৫৩৯টি। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শতকরা ৬০ ভাগ মহিলা শিক্ষক নিয়োগের বিধি প্রবর্তনের ফলে মহিলা শিক্ষকের হার ১৯৯১ সালের ২১.০৯ শতাংশ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৬৪.৫২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। ২০২০ সালের তথ্যানুযায়ী এই সংখ্যা ছিল ১,৩৩,০০২টি (ব্রাক সেন্টার, শিশু কল্যাণ ও মাদ্রাস/মসজিদ ভিত্তিক কেন্দ্র/কওমি মাদ্রাসাসহ মোট ২৫ ধরনের বিদ্যালয়)। প্রাথমিক শিক্ষায় ছাত্রী ভর্তির সংখ্যা ও হার ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। তুলনামূলক পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, ১৯৯১ সালে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তির অনুপাত ছিল ৫৫ ঃ ৪৫ যা ২০২০ সালে ৪৯ ঃ ৫১ এ উন্নীত হয়েছে। ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর হারও ক্রমাগত হ্রাস পেয়ে ২০২০ সালে ১৮.৮ শতাংশে নেমে এসেছে যা ২০১৫ সালে ছিল ২০.৪ শতাংশ।
বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বিগত এক দশকে আশাতীত পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। উচ্চশিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণ ও গুণগতমান বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকার বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। দেশের প্রতি জেলাতে একটি করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের মধ্য দিয়ে বর্তমান পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৪৯টিতে উন্নীত হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একাডেমিক কার্যক্রম চালু আছে যথাক্রমে ৪৬টি ও ৯৮টিতে। উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার উৎকর্ষতায় ইউজিসি কর্তৃক ‘স্ট্রাটেজিক প্লান ফর হায়ার এডুকেশন ইন বাংলাদেশ: ২০১৮-২০৩০’ প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ অপরিমেয় একাডেমিক প্রণোদনায় উজ্জ্বীবিত। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ অনুযায়ী প্রত্যেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার মান নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে International Quality Assurance Cell (IQAC) গঠন করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের আইসিটি কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আইসিটি সেল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তি সম্পৃক্ত করে একটি দক্ষ ও যুগোপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে শিক্ষার সকল স্তরে ICT Education Master Plan প্রণয়ন করা হয়েছে। মাধ্যমিক স্তরে কম্পিউটার শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
মানবসম্পদ উন্নয়নে অন্যতম খাত হচ্ছে স্বাস্থ্য। ২০৩০ সালের মধ্যে দেশে সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা অর্জনের লক্ষ্যকে
অগ্রাধিকার দিয়ে ‘স্বাস্থ্যখাতে অর্থায়নের কৌশলপত্র: ২০১২-২০৩২’ প্রণয়ন করা হয়েছে। এই কৌশলপত্রের আলোকে দারিদ্রসীমার নীচে বসবাসকারীদের চিকিৎসা সেবার অর্থায়ন কৌশলের অংশ হিসেবে ‘স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচি (এসএসকে) প্রণীত হয়েছে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর নিজ অর্থ ব্যয়ে হাসপাতালভিত্তিক সেবা গ্রহণে আর্থিক প্রতিবন্ধকতা এবং তাদেরকে আর্থিক বিপর্যয় থেকে রক্ষার উদ্দেশ্যে জানুয়ারি ২০১৭-জুন ২০২৩ সাল মেয়াদে পরিচালিত পাইলট কার্যক্রমে প্রতিটি কার্ডধারী পরিবার হাসপাতালে আন্তঃবিভাগীয় সেবা গ্রহণকালে ৭৮টি রোগের জন্য রোগ নির্ণয় ও ঔষধসহ যাবতীয় চিকিৎসা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে প্রদান করা হচ্ছে। কোভিড-১৯ মোকাবেলায় স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংক ও এশিয়ান ইনফ্রাস্টাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি) এর অর্থায়নে চলমান COVID-19 Emergency Response and Pandemic Preparedness প্রকল্পের মাধ্যমে টিকা ক্রয়, অক্সিজেন লাইন স্থাপন, আইসিইউ/সিসিইউ স্থাপন ও অন্যান্য কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে।
দেশবাসীসহ সমগ্রবিশ্ব অবগত আছেন ২০১৫-২০২১ ছয় বছরে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) কর্তৃক দুটি ত্রিবার্ষিক পরিশুদ্ধ মূল্যায়নে বাংলাদেশ এ বছরের ২৬ ফেব্রæয়ারি স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়। এই উত্তরণের পিছনে মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা এই তিনটি প্রধান সূচককেই প্রধান্য দেওয়া হয়। এর দুটি সূচকে সক্ষমতা অর্জনের শর্তে উন্নয়ন অবস্থান নির্ধারণ করা হলেও; মহান ¯্রষ্টার অপার কৃপায় এবং বঙ্গকন্যা দেশরতœ শেখ হাসিনা সরকারের অপ্রতিরোধ্য অগ্রগতিতে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার অভিযাত্রার সাফল্য হিসেবে তিনটি সূচকেই বাংলাদেশ অগ্রগণ্য অবস্থান নিশ্চিতে সক্ষম হয়। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিলের (ইকোসক) সামষ্টিক পর্যালোচনায় মাথাপিছু আয়ের সীমারেখা হচ্ছে কমপক্ষে ১ হাজার ২ শত ৩০ মার্কিন ডলার। অত্যন্ত সৌভাগ্যের বিষয় হচ্ছে এই, বর্তমান বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় হচ্ছে ২ হাজার ৫ শত ৫৩ মার্কিন ডলার। মানবসম্পদ উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতার সূচকে যথাক্রমে প্রয়োজনীয় ৬৬ ও ৩২ বা তার চেয়ে কম শতাংশের বিপরীতে বাংলাদেশের অর্জন ছিল ৭২.৯ এবং ২৪.৮ শতাংশ। ২৬ নভেম্বর ২০২১ গণমাধ্যম সূত্রমতে, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৬তম বৈঠকের ৪০তম প্লেনারি সভায় আনুষ্ঠানিক অনুমোদনের মধ্য দিয়ে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে এখন বাংলাদেশের চূড়ান্তভাবে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটল। সাধারণত স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের ক্ষেত্রে প্রস্তুতির জন্য তিন বছর সময় দেওয়া হলেও করোনা মহামারীতে বিপর্যস্ত অর্থনীতি বিবেচনায় পাঁচ বছর প্রস্তুতির সময় পাওয়া গেল।
বস্তুতপক্ষে মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর আত্মত্যাগ-আত্মমর্যাদা-আত্মসমালোচনা-আত্মপ্রত্যয়ের আদর্শ পরিপূর্ণ আত্মস্থ করে অর্থ-ক্ষমতা-আধিপত্য-দুর্বৃত্তায়নের হিংস্র প্রবৃত্তি পরিহারে গণতান্ত্রিক-অসাম্প্রদায়িক শোষণমুক্ত মানবিক সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় সোনার মানুষ সৃজনে মানবসম্পদ উন্নয়নের কোন বিকল্প নেই। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য প্রশাসনের সর্বোচ্চ থেকে নিম্নতর পর্যায় পর্যন্ত মেধা-যোগ্যতা-দক্ষতা-সততা-স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতায় পরিপুষ্ট হয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ-কর্তাব্যক্তিদের যৌক্তিক-যৌগিক ইতিবাচক প্রয়াস-রসায়ন অবশ্যই সুষ্ঠু ও সুস্থ সমাজ প্রতিষ্ঠায় সহায়ক ভূমিকা রাখবে। সরকার প্রধান মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অকুতোভয় নেতৃত্বে দেশকে প্রাগ্রসর সমাজে পরিণত করার অদমনীয় সংকল্প কখনোই পরাভূত হবে না – সমগ্র দেশবাসীর মতো আমিও দৃঢ়ভাবে তা বিশ্বাস করি।

লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য চ.বি