মানবতাবাদী মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী স্মরণে

45

 

যুগে যুগে এই পৃথিবীতে অনেক প্রতিভার জন্ম হয়েছে এবং হবে। যাঁদের জীবনেতিহাস গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট বলা যায় স্বদেশপ্রেম, মানবকল্যাণ, বিপ্লবী, পরোপকারী ত্যাগচেতনা, প্রাজ্ঞজীবন সত্যিই অসাধারণ জ্ঞানসাধনা এবং অধ্যাবসায় ছিল অতুলনীয়। এগুলো অর্জনের পেছনে যে মহাশক্তি সদা-সর্বদা কাজ করে তা হলো বহুমুখী প্রজ্ঞাশক্তি, ভাষাজ্ঞান। মানুষ ও মানুষের জীবনকে মহিমান্বিত ও প্রতিষ্ঠিত করতে হলে প্রজ্ঞাশক্তি অদ্বিতীয় সম্পদ। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী একজন কিংবদন্তীতুল্য সাংবাদিক ও সাহিত্যিক ছিলেন। আমরা সহজে অতীতকে ভুলে যায়। যে জাতি অতীতকে স্মরণে রাখে না সে জাতি মৃতবৎ। ভালো কিছু আশা করা যায় না। কিন্তু তিনি একজন সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী মানুষ ছিলেন যিনি নিরবে-নিভৃতে পরাধীন জাতিকে জাগাতে কার্যকর ভূমিকা রেখেছিলেন। এটাই তাঁর বড় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। আত্মপ্রচার বিমুখ মাওলানা ছিলেন একাধারে আদর্শ শিক্ষক, নিষ্ঠাবান সাংবাদিক, মননশীল গবেষক, মেহনতি মানুষের দরদীবন্ধু, শিক্ষানুরাগী, সংগঠক, জাতীয়তাবাদী চেতনার অনন্য ব্যক্তি, সাহসী, বীর্যবান একজন বিপ্লবী হিসেবে পরিচিত।
চট্টগ্রাম এমন একটি নাম যার প্রতিটি ধূলিকণায় বিপ্লবীদের ভাবাদর্শের লালন ভূমি হিসেবে প্রতিভাত। এক কথায়-স্মরণাতীতকাল থেকে চট্টগ্রামকে একটি বিপ্লবতীর্থ বলা যায়। যিনি বা যারা নেতৃত্বে দিয়েছেন তারা বীর বাঙালি নামে খ্যাত। এ বীর প্রসবিনী চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী চন্দনাইশে ২২ আগষ্ট ১৮৭৫ সালে সম্ভ্রান্ত এক পরিবারে মাওলানা জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা সুপÐিত মুন্সী মতিউল্লা। যিনি আরবি, ফারসি ভাষায় বিদগ্ধ পÐিত ছিলেন। আলোকিত পরিবারের সন্তান মাওলানা পিতার হাতেই আরবি, ফারসি ভাষা ও সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন। তৎকালীন সময়ে এদেশে আধুনিক শিক্ষা এবং ধর্মীয় শিক্ষার তেমন সুযোগ ছিল না। কিন্তু মাওলানা পিতার আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে ১৮৯৫ সালে পশ্চিমবঙ্গের মাদ্রাসা থেকে সর্বোচ্চ পাঠ গ্রহণ করে স্বীয় অধ্যাবসায়গুণে মেধাবী ও কৃতি ছাত্রের পরিচয় দিয়েছিলেন। যখন তাঁর এই প্রতিভার স্ফুরণ ঘটেছিল তখন গ্রামের ছেলে-মেয়েদের উচ্চ-শিক্ষার তেমন অনেকটা সুযোগ ছিল না বললেই চলে। তাছাড়াও তিনি স্বাধীন জীবিকার উদ্দেশ্যে মোক্তারশি পরীক্ষা দেওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিলেন। জ্ঞানান্বেষী সুন্দর ও মানবিক চেতনা মানুষকে বহুমুখী প্রতিভায় উন্নীত করে। তাঁর অর্জন ও অভিজ্ঞতাগুণে রংপুর হারাগাছি সিনিয়র মাদ্রাসায় সুপারিন্টেন্ডেটরূপে কর্মজীবন শুরু করেন। তাঁর অসাধারণ প্রতিভাগুণে সেখানে থেকে সীতাকুন্ডের সিনিয়র মাদ্রাসার অধ্যক্ষ পদে নিযুক্ত হন। তখন থেকে শুরু হয় তাঁর সাহিত্যসাধনা ও লেখালেখি। শুরুতেই চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশ করেন ‘মাসিক ইসলামাবাদ’।
চট্টগ্রামের আর এক নাম ছিল ‘ইসলামাবাদ’। সেই ঐতিহ্যকে সামনে রেখে স্বীয় প্রতিভার স্ফুরণ নানাভাবে বিকশিত হয়। তিনি আরবি, ফারসি ও উর্দু ভাষায় সমান দক্ষ ছিলেন। মাতৃভাষা বাংলা চর্চায় উৎকর্ষতা নিজস্ব প্রচেষ্টায় হয়েছিল। সে সময়ে মিসর থেকে প্রকাশিত ‘আল-মিনার, আল ইহরাম এবং আল বিলাদে আরবি ভাষায় গবেষণামূলক প্রবন্ধ লিখে সুধী মহলে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি তখন থেকে উর্দু ভাষায় কলাম লিখতেন নিয়মিত। এমন কি ফারসি দৈনিক হাবলুল মতিনে ফারসি ভাষায়, দিল্লী ও লখনৌর বিভিন্ন উর্দু পত্রিকায় তার গুরুত্বপূর্ণ লেখা বের হতো। যে সময়ে তার লেখালেখির জগতে প্রবেশ সেই সময়ে হাতেগুণা কতজন এ জাতীয় প্রতিভার অধিকারী ছিলেন বলাই বাহুল্য। তখন তিনি বঙ্গদেশের ক্ষুদ্রগÐি ছেড়ে তৎকালীন ভারতের প্রাচীন রাজধানী হিসেবে পরিচিত কলিকাতা যাত্রা করেন। স্মরণাতীত কাল থেকে কলিকাতায় ভাষা-সাহিত্যের চর্চা ছিল অত্যন্ত আন্তরিক ও গভীর। অতঃপর মাওলানা ইসলামাবাদী সাংবাদিকতা পেশা গ্রহণ করেন। তিনি প্রথমে মাসিক আল এসলাম সম্পাদনা করে বাংলার পশ্চাদপদ সমাজকে বাংলা সাহিত্যের প্রতি অগ্রণী করতে প্রয়াসী হন। ১৯১১ সালে তিনি বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ, সাপ্তাহিক ‘দি-মুসলমান’ এর সম্পাদক মৌলভী মুজিবুর রহমান, শেখ আব্দুর রহিম, মুনশী মোহাম্মদ, রেয়াজউদ্দীন আহমদ, শান্তিপুরের কবি মোজাম্মেল হক, কোনিপুর সম্পাদক মোহাম্মদ রওশান আলী চৌধুরী প্রমুখ তৎকালীন বিশিষ্ট সাহিত্যিক-সাংবাদিকবৃন্দ। সভায় সম্মতিক্রমে মৌলভী আব্দুল করিম ও মৌলভী মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে সমিতির যথাক্রমে প্রথম সভাপতি সম্পাদক নির্বাচন করা হয়। ইতোপূর্বে তিনি ১৯০৩ সালে কলিকাতায় সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজিকে নিয়ে প্রকাশ করেন সাপ্তাহিক ছোলতান। এ পত্রিকা সম্পাদনার মাধ্যমে শুরু হয় মাওলানার সাংবাদিক জীবন। পরে সাপ্তাহিক ছোলতান দৈনিকে রূপান্তরিত হয়। ভালো কাজে শতবাধা। তিনিও সেই পরিস্থিতির শিকার হয়েছিলেন। কিন্তু ব্যক্তিত্ব ও প্রতিভা যদি স্বকীয় হয় তাহলে তাঁকে দমিয়ে রাখা যায় না। সেখান থেকে বের হয়ে এসে তিনি দৈনিক আমির প্রকাশ করেন। তাও অর্থনৈতিক সমস্যার দরুণ বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। তৎকালীন সময়ে ফরাসি ভাষায় প্রকাশিত দৈনিক সংবাদপত্র ‘হাবলুল মতিন’ বহুল প্রচারিত সংবাদপত্র।
মাওলানা ইসলামাবাদী হাবলুল মতিনের বাংলা সংস্করণের সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করতেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে কতটুকু জ্ঞানের গভীরতা বিদ্যমান থাকলে সেই সময়ে এই গুরুদায়িত্ব পালন করা যায়, তা সত্যিই প্রশংসার দাবী রাখে। এ জন্য তাকে বলা হয় বাংলায় প্রকাশিত পত্রিকার প্রথম মুসলিম সম্পাদক। এ পত্রিকাগুলোর মাধ্যমে তিনি অবিভক্ত বাংলার মুসলমানদের মাঝে মুসলিম চেতনাকে জাগ্রত করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট অবদান রেখেছিলেন যা স্মরণে রাখার মতো। এক কথায় তিনি ইসলামী শিক্ষা-সংস্কৃতিতে পিছিয়ে পড়া মুসলমানদেরকে উদ্ধুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এতে তাঁর অসাধারণ স্বজাতি প্রেমের পরিচয় মেলে। সমাজ ও দেশ সেবা ছাড়া জীবনে আর কিছুই করণীয় ছিল না তাঁর। সমাজকে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন একেবারে নিচের ধাপ থেকে যেখানে রয়েছে দেশের শিক্ষা চেতনার উন্মেষ আর দেশের অর্থনীতির অগ্রগতি। দেশ ও জাতির ভাগ্য পরিবর্তন ঘটাতে শিক্ষা ও অর্থনৈতিক জাগরণ হলো মূলমন্ত্র। তিনি সদা-সর্বদা বলতেন মুসলমানরা যদি কর্মকার, কুম্ভকার, গোয়ালা, ময়রা ব্যবসায় সম্পৃক্ত হয় তাতে জীবন-জীবিকার সমস্যা কোথায় বরং নিজের অর্থনৈতিক সংকট নিজেরাই কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবে। তাঁর আন্তরিক প্রচেষ্টা ও স্বজাতিপ্রেম ছিল সত্যিই অপূর্ব। বিশ্বায়নের যুগে তাঁর মতো জনদরদী ও সেবক অতি দুর্লভ। মাওলানা ইসলামাবাদী সাংবাদিকতা জগতে একজন কিংবদন্তিতুল্য বিরল প্রতিভা এবং স্বদেশপ্রেমী চেতনার অনন্য একজন বিপ্লবী ব্যক্তি ছিলেন। তদুপরি মানবতাবাদী জনসেবক হিসেবে কদম মোবারক মুসলিম এতিমখানা নিরাশ্রয়ের আশ্রয় স্থান, সেখানে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীবন বাঁচানো, শিক্ষার আলো বঞ্চিতদেরকে দীপ্তিমান এবং সুনাগরিক হিসেবে গঠন করার যে অবদান তা বিষ্ময়কর বিষয়। নিরব জ্ঞান সাধক তিনি সুলেখক হিসেবে মুসলিম সাহিত্য জগতে যা সৃষ্টি করেছেন তা সুধী মহলে অমর কীর্তি হয়ে আছে এবং থাকবে যুগে যুগে। ব্যক্তিগতভাবে হতবাক হয়ে যাই এত সংগ্রাম ও কষ্টের ফাঁকে ফাঁকে কয়েকটি অমূল্য গ্রন্থ প্রণয়ন সত্যিই তাঁর ক্ষুরধার লেখনীর বহিঃপ্রকাশ যা আজও দেদীপ্যমান, অন্য কিছুর জন্য তিনি বেঁচে না থাকলেও লিখিত গ্রন্থাবলি তাঁকে অমর করে রাখবে। একজন মানুষকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন ও মর্যাদার আসনে সমাসীন করতে হলে তাঁর প্রতিভা সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জন বিশেষ প্রয়োজন। সেদিক থেকে তিনি একজন অনন্য প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তাঁর প্রণীত গ্রন্থ ছাড়াও বহুগুরুত্বপূর্ণ রচনা এখনো অপ্রকাশিত থেকে গেছে। আর কিছু কিছু রচনা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ হলেও সব রচনাগুলো একত্রিত করে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করা প্রয়োজন। তখনই তার প্রতি যথার্থ সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা সার্থক হবে। (১) ভারতে মুসলমান সভ্যতা (২) নেজাম উদ্দিন আউলিয়া (৩) তুরস্কের সোলতান (৪) ভারতে ইসলাম প্রচার (৫) মুসলমানদের অভ্যুত্থান (৬) সমাজ সংস্কার (৭) ভূগোল শাস্ত্রে মুসলমান (৮) খগোল শাস্ত্রে মুসলমান (৯) কনস্টানটিনোপোল (১০) আওরঙ্গজেব (১১) মোসলেম বীরাঙ্গনা (১২) কোরানে স্বাধীনতার বাণী (১৩) ইসলামের উপদেশ (১৪) ইসলামের পুণ্য কথা প্রভৃতি। মানুষ জন্মসূত্রে কিছু প্রতিভা নিয়ে জন্মালেও পরিপূর্ণ প্রভিতা জন্মের পর অর্জন করতে হয় অনুষ্ঠান ও অনুশীলনে। সেদিক থেকে অনন্য ও একক বলা যায়। তাঁর মতো স্বজাতিপ্রেমী এবং মানবহিতৈষী বর্তমান সময়ে অতি বিরল।

লেখক: অধ্যাপক, পালি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়