মাদক মামলার বিচার নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রিতা

112

দেশজুড়ে মরণঘাতী মাদকের ভয়াবহ বিস্তার ঠেকাতে বিশেষ অভিযানের পাশাপাশি এ সংক্রান্ত অপরাধের বিচার দ্রুততম সময়ে নিষ্পত্তির জন্য নতুন আইন প্রণয়ন করা হয়। এরপরও নানা জটিলতায় পরিস্থিতির তেমন পরিবর্তন হয়নি।
নতুন আইন প্রণয়ন ও কার্যকরের পর ছয় মাসেও মামলা নিষ্পত্তির জন্য পৃথক ট্রাইব্যুনাল গঠন করা যায়নি। এতে করে মাদক মামলার বিচার নিষ্পত্তিতে যেমন দীর্ঘসূত্রতা সৃষ্টি হচ্ছে তেমনি মামলা দায়েরের তুলনায় নিষ্পত্তির হার কম হওয়ায় বাড়ছে মামলাজট। তবে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষ অভিযানে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মাদক মামলার আসামি নিহত হওয়ার ঘটনা অব্যাহত রয়েছে।
আদালত সূত্রে প্রাপ্ত সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন ১৮ হাজার মাদক মামলার মধ্যে পাঁচ বছর বা তারও আগের মামলা রয়েছে আড়াই হাজারেরও বেশি। নগরীর ১৬টি এবং জেলার ১৬টি মিলিয়ে ৩২টি থানায় প্রতিদিন গড়ে ৬০টিরও বেশি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা হচ্ছে। কিন্তু সেই হারে মামলার নিষ্পত্তি হচ্ছে না। মহানগর দায়রা জজ আদালতে মাদক আইনে বিচারাধীন মামলা রয়েছে ১১ হাজার ১৪৮টি। এর মধ্যে পাঁচবছর আগে দায়ের হওয়া ২ হাজার ৩৭৯টি মামলা এখনও নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয়নি। একই অবস্থা জেলা দায়রা জজ আদালতেও। এখানে বর্তমানে বিচারাধীন মামলা রয়েছে ৫ হাজার ২৯২টি। জেলা ও নগরী মিলিয়ে বিভিন্ন থানায় মাদক আইনের আরো অন্তত সাড়ে চার শতাধিক মামলা তদন্তাধীন রয়েছে। আর কারাগারে আটক রয়েছে দেড় হাজারের বেশি মাদক মামলার আসামি।
মহানগর আদালতের পিপি এডভোকেট মো. ফখরুদ্দিন চৌধুরী এ বিষয়ে পূর্বদেশকে বলেন, নতুন আইনে মাদকদ্রব্য সংক্রান্ত অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালের কথা বলা হলেও এখনও তা গঠন করা সম্ভব হয়নি। ট্রাইব্যুনাল হলে মাদক সংক্রান্ত বিচারাধীন সব মামলা এক জায়গায় চলে আসত। বিচার কার্যক্রমও পৃথকভাবে দৃশ্যমান হত। এখন বিভিন্ন আদালতে আগের মতই অন্য মামলার পাশাপাশি মাদক মামলারও বিচার কার্যক্রম চলছে।
সিএমপি’র অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) আমেনা বেগম বলেন, যারা মাদকের খুচরা ব্যবসায়ী তারা আসলে দ্রæততম সময়ের ব্যবধানে জামিন পেয়ে কারাগার থেকে বেরিয়ে আসে। তারপর পুনরায় মাদকের কারবারে জড়িয়ে পড়ে। সরকারের কাছে পুলিশ বিভাগ থেকে প্রস্তাবনা ছিল, মাদক ব্যবসায়ীদের যদি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল করে দ্রæততম সময়ে মামলা নিষ্পত্তির মাধ্যমে শাস্তি নিশ্চিত করা যায়, তাহলে মাদক নিয়ন্ত্রণে সুদূরপ্রসারী ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। জামিনে বেরিয়ে পুনরায় মাদকের কারবারে জড়ানোর প্রবণতা কমে আসবে।
বিভাগীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক মো. মজিবুর রহমান পাটোয়ারী বলেন, আইন অনুযায়ী পৃথক ট্রাইব্যুনাল হলে মাদক মামলাগুলো দ্রæততম সময়ে নিষ্পত্তি হত। বর্তমানে বিচারিক আদালতগুলোতে বিভিন্ন আইনে দায়ের হওয়া মামলার বাড়তি চাপ রয়েছে। মামলার সাক্ষীরা অন্য জেলায় বদলি হয়ে গেলে তাদের হাজির হওয়ার ক্ষেত্রে অনাকাক্সিক্ষত নানা জটিলতা দেখা দেয়। যার ফলে মামলার দীর্ঘসূত্রিতা বাড়তেই থাকে। আবার কারাভোগের একপর্যায়ে আসামিও জামিনে মুক্তি পেয়ে যায়। আর কারাগার থেকে বেরিয়ে পুনরায় মাদকের কারবার শুরু করে। আদালতে মাদক আইনে পাঁচ বছর বা ততোধিক সময় ধরে বিচারাধীন মামলাও রয়েছে। নানা জটিলতায় বিচার নিষ্পত্তি হচ্ছে না।
উল্লেখ্য, গত বছরের মে মাসের শুরুর দিকে ‘চলো যাই যুদ্ধে, মাদকের বিরুদ্ধে’-এমন শ্লোগান নিয়ে মাদকবিরোধী সর্বাত্মক অভিযান শুরু করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। জাতীয় নির্বাচনসহ নানা কারণে মাঝখানে কিছুদিন শিথিল থাকলেও সেই অভিযান এখনও অব্যাহত রয়েছে। ওই অভিযানে সর্বশেষ গত ১৫ জুন ইয়াবা পাচারের প্রধান রুট কক্সবাজার জেলায় র‌্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে তিনজন নিহত হয়। এক বছর অতিক্রান্ত হওয়া অভিযানে সারাদেশে কথিত বন্দুকযুদ্ধ আর নিজেদের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনায় নিহতের সংখ্যা সাড়ে তিনশ পেরিয়েছে। এরইমধ্যে গত বছরের ফেব্রæয়ারিতে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ নি¤œ আদালতে চার্জশিট দাখিল হয়েছে-এমন পর্যায়ে থাকা মাদক মামলাগুলোর বিচার ছয় মাসের মধ্যে নিষ্পত্তির নির্দেশনা দেয়। সেই আলোকে সরকার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৮ নামে নতুন আইন প্রণয়ন করে। গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর থেকে ওই আইন কার্যকর করা হয়। নতুন আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদÐ ছাড়াও দ্রæত বিচার নিষ্পত্তি করতে মাদক সংক্রান্ত অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল নামে পৃথক আদালত গঠনের কথাও বলা হয়। ওই ট্রাইব্যুনালে ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে মাদক মামলার নিষ্পত্তির বিধান রয়েছে। তবে, উচ্চ আদালতের জ্ঞাতসারে দুই দফায় আরও ৪৫ দিন সময় নিয়ে উল্লেখিত সময়ের মধ্যে এ সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তি করার সুযোগ রয়েছে।