মাদকের বাজারে আইসের বিস্তার

16

তুষার দেব

মিয়ানমারে উৎপাদিত ইয়াবার রুট ধরে কক্সবাজারের টেকনাফ-উখিয়া সীমান্ত দিয়ে দেশের মাদকের বাজারে বিস্তার লাভ করছে প্রাণঘাতী মাদক ক্রিস্টাল মেথ বা আইস। সীমান্ত দিয়ে দেশের ঢোকার পথে যেমন ভয়ঙ্কর এই আইসের চালান নিয়মিত জব্দ হচ্ছে, তেমনি রাজধানী ঢাকা এবং চট্টগ্রাম শহরেও ধরা পড়ছে দেখতে বরফের ছোট টুকরোর মত মাদকটি। মানবদেহে ইয়াবার চেয়ে বিশগুণ বেশি প্রভাব ফেলা ক্রিস্টাল মেথ এখন রীতিমত ইয়াবার রাজ্যে হানা দিয়েছে! সর্বশেষ গতকাল বুধবার ভোরেও টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের ওয়াব্রাং এলাকা থেকে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি এক কেজি ৫৫ গ্রাম ক্রিস্টাল মেথ ও ১০ হাজার ইয়াবার একটি চালান জব্দ করেছে।
মাদক নিয়ন্ত্রণে দায়িত্বরত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, সংঘবদ্ধ মাদক চোরাকারবারিরা দেশের মাদকের বাজারে ইয়াবা ছড়িয়ে দেয়ার পর সাম্প্রতিক সময়ে ক্রিস্টাল মেথ বা আইসের বাজার তৈরি করতে চাইছে। যারা ইয়াবা চোরাকারবারের সাথে জড়িত রয়েছে তাদের হাত ধরেই দেশে ঢুকছে প্রাণঘাতী মাদক আইসের চালান। গত দেড় দশকে দেশের মাদকের সা¤্রাজ্যে ইয়াবার যে একচ্ছত্র আধিপত্য গড়ে উঠেছে, সেখানে এখন নিশ্বাস ফেলতে চাইছে ক্রিস্টাল মেথ। এ কারণে সাম্প্রতিক সময়ে ইয়াবার রুট দিয়ে প্রায়ই ক্রিস্টাল মেথ বা আইসের চালান জব্দ হওয়ার ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে।বিজিবির টেকনাফ-২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল শেখ খালিদ মোহাম্মদ ইফতেখার বলেন, দুই দেশের সীমান্ত এলাকায় সক্রিয় মাদক চোরাকারবারিরা আড়ালে থেকে নানা কৌশলে ইয়াবার পাশাপাশি ক্রিস্টাল মেথের চালানও পাচার করছে। গত ছয় মাসে টেকনাফ-উখিয়া সীমান্ত দিয়ে আসা ইয়াবার চালানের সাথে ক্রিস্টাল মেথ- এর বেশ কয়েকটি চালানও জব্দ করা হয়েছে। এর মধ্যে বছরের শুরুতেই গত ১৯ জানুয়ারি টেকনাফে সীমান্তে অভিযান চালিয়ে চার কেজি একশ’ ৭৫ গ্রাম ক্রিস্টাল মেথ বা আইস এবং ৫০ হাজার ইয়াবা জব্দ করা হয়েছিল। এখন পর্যন্ত সেটিই দেশে জব্দ হওয়া আইসের সবচেয়ে বড় চালান। গত পয়লা জুলাই হ্নীলা ইউনিয়নের ওয়াব্রাং এলাকায় এক অভিযানে বেড়িবাঁধের পাশ থেকে আগেই পাচার করে আনা পাঁচ কোটি ৯০ লাখ টাকা মূল্যের এক কেজি ৬০ গ্রাম ক্রিস্টাল মেথ এবং ২০ হাজার পিস ইয়াবা জব্দ করা হয়। এর পাঁচদিনের মাথায় বুধবার ভোরে একই এলাকা থেকে জব্দ করা হয়েছে এক কেজি ৫৫ গ্রাম ক্রিস্টাল মেথ ও ১০ হাজার ইয়াবার আরেকটি চালান।
ইয়াবার সাথে একের পর এক আইসের চালান জব্দ হওয়ার কারণে মনে হচ্ছে, ইয়াবার কারবারিরা এখন দেশের মাদকের বাজারে ক্রিস্টাল মেথ বা আইসকে সহজলভ্য করার চেষ্টায় রয়েছে। বিষয়টি আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি। সীমান্তের এ পাড়ে দেশের অভ্যন্তরে সক্রিয় তালিকাভুক্ত মাদকের গডফাদারদের অনেকেই গ্রেপ্তার এড়িয়ে এলাকায় ঘোরাফেরা করছে। আড়ালে থেকে তারাই মাদক ও মুদ্রা পাচারের কারবারে অর্থলগ্নি করছে। এ কাজে তারা রোহিঙ্গাদেরও ব্যবহার করছে বলে আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে।
পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, মাদক পাচার রোধে সীমান্ত জেলা কক্সবাজারে বিগত যে কোনও সময়ের তুলনায় পুলিশি তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে। পাশাপাশি চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে পুলিশ চেকপোস্ট বসিয়ে নিয়মিত তল্লাশি অভিযান পরিচালনা করছে। এ কারণে মহাসড়কে চলাচলকারী বিভিন্ন যানবাহন থেকে ক্রিস্টাল মেথ ও ইয়াবার চালান জব্দের পরিমাণও আগের তুলনায় বেড়েছে।
মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি) চট্টগ্রাম অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক মুজিবুর রহমান পাটোয়ারী বলেন, মিয়ানমার থেকে সীমান্ত পেরিয়ে ইয়াবার চালান নিয়ে আসার রুটকেই ক্রিস্টাল মেথ বা আইস পরিবহনেও ব্যবহার করছে মাদক কারবারি চক্র। ইতিপূর্বে আইসসহ গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদেও সেরকম ইঙ্গিতই মিলেছে। এ কারণে এই রুটের বিভিন্ন পয়েন্টে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। তবে ক্রিস্টাল মেথ বা আইস উচ্চমূল্যের মাদক। এখন পর্যন্ত উচ্চবিত্ত ও অভিজাত শ্রেণির মধ্যে এটির চাহিদা রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রাণঘাতী মাদক ক্রিস্টাল মেথ বা আইসের অন্যতম প্রধান উৎপাদক দেশ হচ্ছে থাইল্যান্ড। একই সঙ্গে মিয়ানমার, ফিলিপাইন ও মালয়েশিয়াও উৎপাদন হয় ক্রিস্টাল মেথ। মূলত এই চার দেশ থেকেই এশিয়ার পাশাপাশি ইউরোপ ও আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে ক্রিস্টাল মেথ পাচার করা হয়। দেশে এখন পর্যন্ত জব্দকৃত আইসের চালানগুলো থাইল্যান্ড ও মিয়ানমার হয়ে ঢোকার তথ্য রয়েছে। অভিজাত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণির মধ্যে ক্রিস্টাল মেথের কদর বাড়ছে। ওই চাহিদাকে পুঁজি করে মিয়ানমারভিত্তিক ইয়াবা পাচারকারী সিন্ডিকেট দেশে আইসের সরবরাহ ও বাজার তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে। একসময় মিয়ানমার থেকে জল ও স্থল সীমান্ত দিয়ে কেবল ইয়াবার চালান দেশে ঢুকলেও চাহিদা বৃদ্ধির সাথে সাথে এখন একই রুট ব্যবহার করে দেশে ঢুকছে ক্রিস্টাল মেথ বা আইসের চালান। নাফ নদী দিয়ে মাছ ধরার ট্রলারে জেলের ছদ্মবেশে মাদক পাচারকারীরা সাগরে গিয়ে মিয়ানমারের মাদক চোরাকারবারিদের কাছ থেকে ইয়াবা ও আইসের চালান নিয়ে আসছে। এছাড়া উখিয়া সীমান্ত দিয়েও মিয়ানমার থেকে পাচারকারীরা সরাসরি মাদকের চালান দেশে এনে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মজুদ করছে। পরে যাত্রীবাহী বাস ও মালবাহী ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানসহ বিভিন্ন পরিবহনের মাধ্যমে চাহিদা ও সুবিধামত দেশের বিভিন্ন জায়গায় মাদকের চালান পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি আড়ালে থেকে মাদকের কারবারে অর্থ লগ্নি করছে। মাদকের চালান পাচার ও পরিবহনের কাজে এখন জেলে, পরিবহন শ্রমিক ও রোহিঙ্গাদেরই বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে।