মাতৃহারা সন্তানের কান্নার ভাষা

115

সম্প্রতি কক্সবাজার জেলার ঈদগাঁওয়ের জঙ্গল খুটাখালীতে এক মা-হাতির মৃত্যু হয়। লোকালয়ের কাছাকাছি পড়ে থাকা মৃত মায়ের পাশে তার বাচ্চা হাতির আর্তি, আকুতি এবং ছুঁয়ে দেখার সচিত্র প্রতিবেদন দেশের প্রায় সকল সংবাদ মাধ্যমে ছাপা হয়। সংবাদটি সামাজিক মাধ্যমেও ভাইরাল হয়। যা দেশের সকল হৃদয়বান মানুষের বিবেক স্পর্শ করেছে। সাম্প্রতিককালে দক্ষিণ চট্টগ্রামে হাতির আক্রমণে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পরও এ সংবাদটি মানুষের নজর কাড়ে। বাচ্চা বাতিটি মৃত মায়ের শরীর ছুঁয়ে আছড়ে পড়ার দৃশ্য এবং সংবাদটি সত্যি বেদনাবিধূর। সংবাদে প্রকাশ বাচ্চাটির চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছিল। এই পৃথিবীর সকল মাতৃহারা সন্তানের কান্নার ভাষা এক। সে মানুষ আর বন্যপ্রাণীর যাই হোক না কেন! মা এবং সন্তানের সম্পর্কটি স্পর্শকাতর। যার হারায় সে বোঝে মাতৃবেদনা। মৃত মা ও বাচ্চা হাতিকে যারা দেখতে ভিড় করেছিলÑতাদের চোখেও নেমে আসে পানি। বাঙালির মতো এমন উৎসুক্য প্রিয় জাতি খুব কম আছে। আবার বাংলার পলিমাটির মতো তাদের মন ও নরম। তাই বাচ্চাটির কর্মকাণ্ডে তাদের চোখে নেমে আসে পানি বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা। জানা যায় যে, মা হাতিটির দেহে বেশ কয়েকটি গুলির চিহ্ন রয়েছে। গ্রামবাসীর ধারণা করছেন কে বা কারা কয়েকদিন আগে হাতিটিকে গুলি করেছিল। অসহ্য যন্ত্রণা ও বিনা চিকিৎসায় তার মৃত্যু হয়েছে। (সূত্র দৈনিক আজাদী, পূর্বদেশ, প্রথম আলো, জানুয়ারি ৫)। এখানে স্মরণযোগ্য যে, এর আগে বিদ্যুতের ফাঁদ, চোরাঘাতকের আঘাতে বেশকয়েকটি হাতির মৃত্যু সংবাদ জানা যায়। অনেকে মনে করেন যে, এভাবে মারা যেতে যেতে এক সময় বাংলাদেশের হাতি বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের সীমান্তে মিয়ানমার। বাংলাদেশের এই সীমান্তের ১৯৩ কিলোমিটারজুড়ে মিয়ানমার স্থল মাইন পুঁতেছে। আর মাইন বিস্ফোরণে বেশকয়েকটি হাতি মারা যাওয়ার সংবাদ পাওয়া যায়। অগত্যা চুনতি অভয়ারণ্যে থাকা হাতির পাল মিয়ানমার সীমান্ত পথে না গিয়ে প্রাণ বাঁচাতে ভিন্ন চলাচলের পথ খুঁজছে। উল্লেখযোগ্য যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম কক্সবাজার ও মিয়ানমরের সীমান্ত এলাকা ছিল হাতির পালের এই এলাকা বাধাগ্রস্ত হওয়ায় হাতির পাল চট্টগ্রামের আনোয়ারার বরুমছড়ার পাশ দিয়ে বাঁশখালীর নতুন করিডোর হয়ে চুনতিতে চলাফেরা করতে শুরু করে। আর একটি অংশ দোহাজারীর লালটিয়া-গড়দুয়ারা হয়ে চলাচল করছে বোয়ালখালীর পাহাড়ে। আগে চুনতি অভয়ারণ্যের প্রায় ৫০টি বন্য হাতি মিয়ানমারের ১২টি করিডোরে চলাচল করতো। তারা চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙামাটি ও মিয়ানমারের পাহাড়ে ঘুরে ফিরে থাকতো, প্রজনন কতো। বলা যায়, এটা ছিল তাদের নিরাপদ আবাস স্থল। রোহিঙ্গা সমস্যার উদ্ভবের ফলে এবং মাইন পুঁতে রাখা তারা বিপদে পড়ে। আর বর্তমানে তারা যে নতন করিডোরে চলাফেরা করছে, সেখানে ঘনবসতি এবং মানুষের চলাচল, ব্যবসা ও কৃষির এলাকা যার ফলে হাতির পালের সাথে প্রায়শ সংঘর্ষ লেগে যাচ্ছে। এতেকরে হতাহত যেমন বাড়ছে তেমনি সহায় সম্পদের ক্ষতিও হচ্ছে। মারা পড়ছে অসহায় মানুষ এবং হাতি উভয়েই।
এদঞ্চলের হাতিগুলো অভ্যাস হলো তারা ঘুরে ফিরে থাকে। বছরের নিদির্ষ্ট সময় তারা মিয়ানমারের গিয়ে থাকে। আবার কক্সবাজারের টেকনাফ কিংবা চুনতির অভয়ারণ্যে ফিরে এসে থাকে। সেখান থেকে আবার পার্বত্য এলাকা চলে যায়।
হাতির পাল একবার হাঁটা শুরু করলে৭০ থেকে ৮০ কিলোমিটার পর্যন্ত হাঁটে। মিয়ানমারের কাঁটাতারের বেড়া ও মাইন পোঁতার কারণে হাতির পাল সে পথ পরিহার করছে। কারণ তারা সেপথে যেতে বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। বাধ্য হয়ে তারা দেশের অভ্যন্তরে নতুন করিডোর তৈরি করেছে। কিন্তু এই বিকল্প পথও নিরাপদ নয়। এখানে প্রায়শ মানুষের সাথে সংঘর্ষ হচ্ছে। এছাড়া এখানে প্রচুর খাবারও নেই। যার ফলে হাতির পাল মানুষের কৃষিজমি, বাড়িঘরে খাদ্যের জন্য হানা দেয়। উল্লেখযোগ্য যে একটি হাতি গড়ে ৭০ থেকে ৮০ বছর বাঁচে। এরা গড়ে ২০০ থেকে ৪০০ কেজি খাদ্য দিনে গ্রহণ করে। বর্তমানে তারা যে নতুন করিডোরে চলাচল করছেÑ সেখানে পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্য না থাকায় তারা আচরণে হিংস্র হয়ে উঠছে।
রোহিঙ্গাদের কারণে কক্সবাজার, উখিয়া এবং টেকনাফের প্রায় ৭/১০ হাজার একর বন্যাঞ্চল ধ্বংস করা হয়েছে। অন্যদিকে কক্সবাজার পর্যন্ত নতুন রেলপথ তৈরির জন্য সংরক্ষিত বনাঞ্চলে হাত দিতে হয়েছে। এসকল কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে হাতির জীবনচক্র। প্রায় ৮ হাজার হেক্টরের চুনতি বনাঞ্চল চট্টগ্রাম কক্সবাজার মহাসড়কের পাশে অবস্থিত। বনের সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও বিপন্ন বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য ১৯৮৬ খৃঃ চুনতি অভয়ারণ্য প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই বনে ১২০০ প্রজাতির উদ্ভিদ দেখা মেলে। যার মধ্যে ৪৫ প্রজাতির উঁচু গাছও আছে। এছাড়া ১৭৮ প্রজাতির জীবজন্তু ও ১৩৭ প্রজাতির পাখি দেখা যেত। নানা প্রতিক‚লতার কারণে এদের সংখ্যা কমে আসলে কমে আসছে হাতির সংখ্যাও।
বাংলাদেশের কক্সবাজার, বান্দরবন ও রাঙামাটি এবং মিয়ানমারের এলাকায় বিচরণ করতো চুনতির হাতির পাল। কক্সবাজারের দক্ষিণ বন বিভাগের উখিয়া-ধুমধুম , তুলাবাগান-পাথের ছড়া, নাইক্ষ্যংছড়ি-রাজারকুল নিয়ে তিনটি করিডোর। কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগে আছে পাঁচটি করিডোর; তা হলো গমারিয়া ঘোনা-রাজঘাট, তুলাতুলি-বিটঘর, ঘন্টাখালিÑমেগা-কচ্ছপিয়া, খাশিয়াখালী- চাইরাখালী, খাশিয়াখালী-মানিকপুর। চট্টগ্রাম আঞ্চলের চুনতি-সাতঘর, লালুটিয়া-গড়দুয়ারা, সুখবিলাস-কোদালা, নারিচ্ছা-কোদালা নিয়ে চারটি করিডোর। তবে চুনতি অভয়ারণ্যের একটি অংশ বাঁশখালী, লোহাগাড়া ও সাতকানিয়া উপজেলা নিয়ে গঠিত।
সীমান্তে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা মাইন পোঁতার প্রতিবাদ করছে বাংলাদেশ। মিয়ানমার তাদের সীমান্তে ২০১৭ সাল থেকে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার পাশাপাশি মাইন পোঁতা শুরু করে। খবরটি প্রকাশ হয় আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম রয়টার্সে। যার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশিসহ অনেক রোহিঙ্গার মৃত্যুর সংবাদ জানা যায়। এছাড়াও বন্য পশু ও গৃহপালিত পশুর হতাহতের সংবাদ প্রতিনিয়ত সংবাদপত্রে আসছে। বন্যপশুর মধ্যে হাতি উল্লেখযোগ্য।
এমতাবস্থায় একথা সত্য বলে প্রমাণিত হয় যে, সংরক্ষিত বনাঞ্চল কমে যাওয়া এবং মিয়ানমার সীমান্তের অসন্তোষ বাংলাদেশের বাস্তবতন্ত্র ঝুঁকির সম্মুখীন। একটি হাতির বাচ্চার কান্না আজ আমাদের মনকে স্পর্শ করছে। ঠিক একইভাবে মানব সন্তান মারা/বা আহত হওয়ার সংবাদ আমাদের বিচলিত হয়ত করছে। কিন্তু এমন একদিন আসবে আমাদের এ নিয়ে পস্তাতে হবে। অতএব বন্যপশু আর মানবগোষ্ঠি যেই হোক না কেন, সকলের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান এবং বাঁচার সুযোগ করা আবশ্যক। মানবতার আদালতে বন্যপশু বিচার চাইতে পারে না। তাই বলে কী তাদের জন্য আমাদের করণীয় কিছু থাকবে না ? মহান আল্লাহ তাঁর সৃষ্টি জগতে মানব জাতিকে সর্বশ্রেষ্ঠ হিসাবে সৃষ্টি করেছেন। সেহেতু জগতের সকল সদস্যদের দেখভাল করার দায়িত্ব বর্তায় মানুষের উপর। আসুন জগতের সকলকে বাঁচার সুযোগ করে দিন।

লেখক : কবি, নিসর্গী ও ব্যাংক নির্বাহী (অব.)