মাতৃভাষার ক্ষমতা

73

ভাষার প্রচন্ড ক্ষমতা। ভাষা দিয়ে মানুষের হৃদয় জয় করা যায়। ভাষা দিয়ে মানুষের মনে প্রচন্ড আঘাত করা যায়। নম্রতা-ভদ্রতা, বিনয় প্রকাশ করা যায় ভাষা দিয়ে। মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনে নম্র ভাষায় কথা বলতে নির্দেশ দিয়েছেন। মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষের সাথে কর্কশ ভাষায় কথা বলতে নিষেধ করেছেন। নিষেধ করেছেন ভাষা দিয়ে উপহাস ও কটাক্ষ করতে। ভাষার কারণে মানুষের ঈমান চলে যেতে পারে, আবার ভাষার কারণে মানুষের ঈমান মজবুত হতে পারে। একটি বাক্য, একটি উক্তি, পংক্তি, একটি অধ্যায় একটি বইয়ের ভাষায় একটি জীবন পরিবর্তন করতে পারে। ভাষা নেই মানে আমাদের কবিতা নেই, সংগীত নেই, সংস্কৃতি নেই, ধর্ম নেই, উপন্যাস, জ্ঞানবিজ্ঞান নেই।
সাহিত্যিক আবুল ফজল তাঁর ‘একুশের সমীক্ষা’ লেখায় লিখেছেন, ‘ভাষাকে আশ্রয় করেই মানুষের মন লালিত পালিত ও বিকশিত। তার সভ্যতা-সংস্কৃতি ধর্মকর্ম সবকিছুই ভাষা-আশ্রিত, তাই ভাষার দাবি জীবনের দাবি, মনুষ্যত্বের দাবি। এ দাবির সংগ্রামে তাই মানুষ এখনো নতি স্বীকার করতে পারে না’। মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, আমি প্রত্যেক রাসুলকে তাঁর স্বজাতির ভাষাভাষি করে পাঠিয়েছি, তাদের কাছে পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য। (সূরা ইব্রাহিম, আয়াত :৪)
মহান আল্লাহ পাক প্রত্যেক জাতির কাছে তাদের মাতৃভাষায় নবী রাসুল প্রেরণ করেছেন। সমগ্র বিশ্বের মানুষের জন্য এক নবী এবং এক কিতাব ও এক ভাষা প্রেরণ করা আল্লাহ পাক পছন্দ করেননি। অর্থাৎ ভাষাগত ও জাতিগত ঐক্য আল্লাহর পছন্দ ছিল না। তিনি বৈচিত্রের সৌন্দর্য পছন্দ করেছিলেন।
ইসলামের প্রচার প্রসার বিশ্বাস করলে সব ভাষা শিক্ষা কর্তব্য মনে করতে হবে। ভাষা না শিখলে ইসলামের দুনিয়াব্যাপী এত প্রচার প্রসার হতো না। ইসলাম যে বিশ্বজনীন ধর্ম, কোন অঞ্চলের নয়, ইসলাম যে ভাষাগত জাতীয়তার উর্ধ্বে তা প্রমাণ করতে হলে সকল ভাষাকে সম্মান করতে হবে, শিখতে হবে। তাই প্রিয় নবী হয়রত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনারবের ভাষা শিখতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। সব ভাষা শিখা তাঁর নির্দেশ মানেই ইবাদত।
আল্লাহর নবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দোভাষী নিয়োগ করতেন। সবদেশের সব ভাষার প্রতি গুরুত্বারোপ করে তিনি যায়িদ ইবনে সাবেবত (রা.) কে বিদেশি ভাষা শিক্ষা করে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা বুঝে তাদের চিঠিপত্র পড়া, লিখা ও ভাব বিনিময় করার নির্দেশ দিয়েছেন। (যাতে ইসলামের দাওয়াত সহজতর হয়) (বোখারী শরীফ)
মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবিসিনিয়ার একদল সাহাবী প্রেরণের পূর্বে সে দেশের ভাষা আয়ত্ব করার জন্য অত্যন্ত মেধাবী সাহাবী হয়রত জাফর ইবনে আবু তালিব (রা.) কে পাঠিয়েছিলেন। পারস্যদেশ থেকে এক প্রতিনিধিদল তাঁর দরবারে এসে ইসলাম গ্রহণ করেন। দেশে ফেরার পূর্বে কোরআনের কিছু অংশ ‘ফার্সি’ ভাষায় অনুবাদ করার অনুমতি প্রার্থনা করলে তিনি তা অনুমোদন করেন। অথচ এই ফার্সি ভাষা ইসলাম প্রচারের আগে ছিল মূর্তিপুজারীদের ভাষা। এখন দ্বিতীয় মুসলিম ভাষা।
প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাতৃভাষা নিয়ে গর্ববোধ করতেন। তিনি ইরশাদ করেন, আমি আরবদের মধ্যে সর্বাধিক বিশুদ্ধ ভাষাভাষি কোরাইশ বংশের লোক। মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনে ঘোষণা রেছেন, কোরআন আরবীতে নাজিল করা হয়েছে (মাতৃভাষায়) যাতে তোমরা বুঝতে পার।
মাতৃভাষায় কথা বলতে কোন বিদ্যালয়ে যেতে হয় না, গ্রামার শিখতে হয় না, ভাষার কঠিন নিয়ম নীতি মানতে হয় না। মাতৃভাষা মায়ের ভাষা, সম্মানের ভাষা, মায়ের নামে ভাষা, মায়ের নামে মাতৃভূমি। মাতৃভাষা ও মাতৃভূমিকে সম্মান করে ‘মা’কে সম্মান করা। কেউ মাতৃভাষা ও মাতৃভূমিকে ভালো না বেসে ‘মা’ কে কোন দিন ভালবাসতে পারবে না।
স্বামী বিবেকানন্দ একবার বিদেশ ভূমিতে ‘ভারত মাতা’ ‘ভারত মাতা’ বলে নিজের জন্মভূমির প্রশংসা করেছিলেন। একজন ইংরেজ দাঁড়িয়ে বললেন, স্বামীজী! আপনি কোন জাতি গোষ্ঠীর নন, পৃথিবীর সম্পদ। বড় মাপের মানুষ। কেন আপনি ‘ভারত মাতা’ ‘ভারত মাতা’ বলছেন ? স্বামীজী বললেন, ‘ যে নিজের মাতাকে সম্মান করতে পারে না সে অপরের মা কে সম্মান করবে কী ভাবে ?’
পিতৃভূমি, পিতৃভাষা হয় না। পৃথিবীর কোন ভাষায় ‘মা’ শব্দটি নাক চিপে উচ্চারণ করা যায় না। যারা উচ্চারণ করা যায়। মা আমাদের নিশ্বাসে, প্রশ্বাসে, অস্তিত্বে। মাতৃভাষাও তাই।
পৃথিবীর সব জাতি ইংরেজী ভাষা শিখে প্রথম ভাষা হিসেবে নয়, দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে। সব জাতি উন্নতির শিখরে পৌঁছেছে মাতৃভাষার মাধ্যমে। দুঃখের বিষয়, আজ আমরা সঠিক বাংলা জানি না। ইংরেজিও জানি না। ইংরেজি ভাষা শেখা আমাদের প্রয়োজন, কিন্তু তাদের ভাষা না শিখে তাঁদের সংস্কৃতি গ্রহণ করে ইংরেজ হতে চাই। ইংরেজদের সংস্কৃতি গ্রহণ করি কিন্তু তাদের ভদ্রতা শিষ্টাচার গ্রহণ করিনি। বিপ্লবী কবি মাইকে মধুসুদন দত্ত মাতৃভাষা, ভূমি, ধর্ম সব ত্যাগ করে ইংরেজ হতে গিয়েছিলেন কিন্তু ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছিলেন।
মাতৃভাষা আমাদের মর্যাদার প্রতীক। পৃথিবীতে ৩ হাজার ভাষা আছে, তার মধ্যে প্রধান ১০টি ভাষার একটি হলো বাংলা। দক্ষিণ এশিয়ায় ৪জন নোবেল প্রাইজ বিজয়ীর মধ্যে ৩জনই বাঙালি। বৃক্ষের প্রাণ আছে তা আবিষ্কার করেছেন জগদিশচন্দ্র বসু। তিনি বাঙালি। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, সত্যাজিৎ, রবীন্দ্রনাথ, বঙ্গবন্ধু, নজরুল বাঙালির সম্পদ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতি সংঘে প্রথম বাংলা ভাষায় বক্তব্য রেখে বাংলাকে মর্যাদার আসনে বসিয়েছেন। তিনি ১৯৫২ সালে চীনে এশিয়া শান্তি সম্মেলনে বাংলায় বক্তব্য দিয়ে খ্যাতি অর্জন করেন। ভোতা বাঙালি হলেও আমাদের আছে অহংকার করার মত অনেক কিছু। ভাষা একটি জাতি গঠন করতে পারে, একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম দিতে পারে, এটা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।
একুশের দিনটিকে ফুলের খাঁচায় বন্দী না রেখে চিন্তা চেতনায় বিজ্ঞানের ভাষায় পরিণত করতে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়াই একুশের প্রতি শ্রদ্ধা ভালোবাসা। একুশের দাবি কোন ভাষার বিরোধী ছিল না। উর্দু ভাষারও নয়। একুশের দাবি বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার। বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার। ভারতের মধ্যে একুশটি রাষ্ট্রীয় ভাষা আাছে। পাকিস্তানে তিন ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা করার দাবি ছিল।
একুশের মাতৃভাষার মাধ্যমে বিশ্ব জ্ঞানের ভান্ডারে প্রবেশ করাও একুশের চেতনা। আমাদের একুশের চেতনা নিয়ে একুশের জ্ঞান বিজ্ঞান প্রযুক্তির ভান্ডারে প্রবেশ করতে হবে। পৃথিবী বিখ্যাত ম্যাগাজিন ‘টাইম’ প্রচ্ছদ করেছে, ‘একুশ শতকের সম্পদ কী ? সোনার খনি নয়, ডায়মন্ডের খনি নয়, বিমানের ফ্যাক্টরী নয়, একুশ শতকের সম্পদ হলো ‘জ্ঞান’। একুশের পথ ধরে আমাদেরকে একুশ শতকের সম্পদ অর্জন করতে হবে। একুশ শতকের প্রতিযোগিতায় নামতে হবে। পৃথিবীতে যারা বড় হয়েছে প্রতিযোগিতা করে বড় হয়েছে, প্রতিহিংসা করে নয়। আগে প্রতিযোগিতা হতো একটি অঞ্চলে, এখন টিকে থাকতে হলে সারা পৃথিবীর সাথে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে হবে। কারণ একুশ শতকে জ্ঞান বিজ্ঞান, প্রযুক্তির বাজার একটি, দুটি নেই। অর্থনৈতিক বাজার একটি।

লেখক : কলাম লেখক ও রাজনীতিক