মাইজভাণ্ডারী ত্বরিকার প্রচার-প্রসারে হযরত গোলামুর রহমান বাবাভাÐারী (ক.)

7

মোঃ নুরুল আবছার

সমস্ত প্রশংসা সর্বশক্তিমান আল্লাহর, যিনি সমগ্র জগতের সৃষ্টিকর্তা ও পরম দয়ালু। আর লাখো দরুদ ও সালাম পেশ করছি আকায়ে নামেদার তাজেদারে মদিনা দোজাহানের সর্দ্দার হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সাঃ) এর পাক চরনে, যাকে সৃষ্টি না করলে সৃষ্টিকুলের কোন কিছুই আল্লাহ সৃষ্টি করতো না। আল্লাহ জি¦ন ও ইনসানকে সৃষ্টি করেছেন আল্লাহর ইবাদত বন্দেগী করার জন্য। সে মোতাবেক বিভিন্ন নবী রাসুলের মাঝে আসমানী কিতাব নাজিলের মাধ্যমে মানব জাতিকে হেদায়েতের পথ দেখানো হয়েছে। সর্বশেষে আল্কোরান নাযিল হয় সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সাঃ) এর উপর। আল্লাহর রাসুল আল্কোরানের ইসলামের বানী সমগ্র বিশে^র আনাচে কানাচে পৌঁছে দিয়ে ইসলাম ধর্মকে সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্মে রূপান্তরিত করে নবুয়ত প্রতিষ্ঠিত করেন। আল্লাহর কোরান ও রাসুলের হাদিস সমগ্র মানব জাতির জন্য দুনিয়া ও আখেরাতের মুক্তির দিক নির্দেশনা দেয়। মহান রাব্বুল আলামীন শ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মদ মোস্তফা (সাঃ) এর পর্দা নেওয়ার মাধ্যমে নবুয়তের যুগের পরিসমাপ্তি ঘটায়ে বেলায়েত যুগের সূচনা করেন। এই বেলায়েতের উত্তরাধিকারী হচ্ছে আওলাদে রাসুল তথা আউলিয়ায়ে কামেলিনগণ। যারা আল্লাহ ও রাসুল (সাঃ) এর গুণে গুণান্বিত। এই ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামের প্রসার ঘটে আউলিয়ায়ে কেরামের মাধ্যমে। হযরত খাজা মাইনুদ্দীন চিশতী (রঃ) তার মধ্যে অন্যতম। পরবর্তীতে অনেক সুফী দরবেশের আগমন ঘটে ইসলাম প্রচারে। তার মধ্যে গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারীর আগমনে বাংলার জমিন ধন্য হয়।
সন ১২৮৪ হিজরী ১২ই জমাদিউছানী, বাংলা ১২৭০ সনের ২৭শে আশ্বিন রোজ সোমবার আল্লাহর অফুরন্ত নেয়ামতের ভাণ্ডার বাবা ভাণ্ডারী পৃথিবীর জমিনে সোবহে সাদিকে শুভ জন্মের পর তার প্রতি প্রথম কৃপার নজর দিয়াছিলেন গাউছুল আজম শাহ আহম্মদউল্লাহ কেবলায়ে আলম। উল্লেখ্য বাবা ভাণ্ডারীর শুভ বেলাদতের কিছুকাল আগে হযরত গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারী (কঃ) হযরত বাবা ভাণ্ডারীর মাতা ছাহেবাকে বলেছিলেন ‘আপনি পীরানে পীর ছাহেবের মা’। হযরত কেবলার পাকজবানের এই বানী বেলায়তের অতি উচ্চ স্তরে বাবাভাণ্ডারীকে অধিষ্ঠিত করার ইঙ্গিত বহন করে। শুভ বেলাদতের সপ্তম দিবসে আকিকার পবিত্র অনুষ্ঠান মালা শেষে বাবা ভাণ্ডারীর আব্বাজান শাহ সুফি মাওলানা ছৈয়দ আবদুল করিম আল হাসানী (রঃ) নতুন সুবাসিত কাপড়ে জড়িয়ে স্বীয় নূরের পুতুলকে নিয়ে হাজির হলেন আপন বড় ভাই হযরত কেবলার দরবারে। হযরত আকদছ সদ্য জাত শিশু বাবা ভাণ্ডারীকে প্রথম দেখাতে কোলে তুলে নিলেন, দয়ার নজর দিয়ে কালাম করলেন, “ইয়ে হামারে বাগকা গোলে গোলাব হ্যায়, হযরত ইউছুফ কা চেহারা ইছমে আয়া হ্যায়, উছকো আজিজ রাখহো, মাইনে উছকো নাম গোলামুর রহমান রাখহা”, অর্থাৎ এ শিশু আমার বাগানের শ্রেষ্ঠ গোলাপ ফুল। হযরত ইউছুফ (আঃ) এর রূপ তার মধ্যে বিকশিত, তাকে যতœ করবে, আমি তার নাম রাখলাম গোলামুর রহমান।
জন্মের পর থেকে শিশুকাল বাল্যকাল যৌবনকাল কোন কালেই তাকে দুনিয়ার মোহমায়া আকৃষ্ট করতে পারেনি সর্ববিষয়ে যিনি তাকে আকৃষ্ট করে মায়ার জালে আবদ্ধ করে রেখেছিলেন তিনি হযরত আকদছ শাহ আহম্মদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী (কঃ)। গাউছুল আজম বাবা ভাণ্ডারী দশ বছর বয়স হতেই নামাজ, রোজা, কোরান তেলোয়াত ইত্যাদি শরয়ী ইবাদত সম্পাদন করার পর যে কাজটি বেশী পছন্দ করতেন তা হল হযরত কেবলার খেদমতে দাখিল হওয়া। জাগতিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জ্ঞান অর্জন করার চেয়েও তিনি হযরত কেবলার আধ্যাত্ব ইউনিভার্সিটিতে জ্ঞান অর্জন করা শ্রেষ্ঠ মনে করলেন। অপর দিকে হযরত গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারী (কঃ) ও চেয়েছিলেন তার বাগানের শ্রেষ্ঠতম গোলাপ বাবা ভাণ্ডারী প্রাতিষ্ঠানিক লেখা-পড়ার পর্ব চুকিয়ে পরিপূর্ণ ভাবে তার আধ্যাত্মিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়ে যাক। তাই জমাতে উলা শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষা দেবার অনুমতি চাইলে হযরত আক্দছ বলেছিলেন। হ্যাঁ বাচা তাহার এমতেহান হইয়া গিয়াছে। আমি তাহাকে নাজিরহাট আশরাফ খলিফার দোকানে খাইয়্যা মসজিদে থাকতে বলি, পরবর্তীতে অনুমতি নিয়া পরীক্ষা দিতে গেলেও দুটো পরীক্ষা দেওয়ার পর তার পক্ষে আর পরীক্ষার হলে থাকা সম্ভব হলো না। প্রেমাম্পদের প্রেমের টানে ফিরে আসতে হলো মাইজভাÐার দরবার শরীফে। দরবার শরীফে এসে হযরত কেবলার পদযুগল ধরে কাঁদতে লাগলেন। হযরত কেবলা নিজ হাতে শরবত পান করালেন। তিনি জজবা হালত হতে সুলকী হালে ফিরে আসলেন এবং সেদিন হতে সব কিছু ছেড়ে দিয়ে শুধু হযরত কেবলার খেতদমত করা এবং ইবাদত, রিয়াজতে, মশগুল হয়ে পড়লেন। আর সে দিনে হতে যে কেউ তাকে লেখা পড়া করতে বলতে, তিনি তাদেরকে বলতেন শত কিতাবের পাতা আগুনে নিক্ষেপ করে জ্বালিয়ে দাও। নিজ চেহারা বা মনকে প্রিয়তম খোদা তালার দিকে রজু করে দাও।
হযরত আকদছ (কঃ)’র সান্নিধ্যে থেকে হযরত বাবা ভাÐারী সর্বোচ্চ বেলায়তী ক্ষমতা অর্জনে সমর্থ হন, ছোট বেলা থেকে হযরত বাবা ভাণ্ডারী গভীর ধ্যানে নিমগ্ন থাকতেন, হযরত বাব ভাণ্ডারী যখন মাঠে গরু ছাগল চরাতে যেতেন তখন তিনি সেগুলোকে বলতেন কারো ফসল নষ্ট করিস না।
হযরত বাবা ভাণ্ডারীর এ নির্দেশ গরু-ছাগল অক্ষরে অক্ষরে পালন করত। কারো ফসলে মুখ, দিত না। পশু পাখীরা তার কথা শুনত। এটা নিঃসন্দেহে হযরত বাবা ভাণ্ডারীর শ্রেষ্ঠ বেলায়তী ক্ষমতার নির্দশন।
বাহারুল উলুম আল্লামা ছৈয়দ আবদুল গণী কাঞ্চনপুরী (রঃ) যে ধারনা পোষন করতেন তার রচিত অমূল্য গ্রন্থ “আয়নায়ে বারী” কিতাবে তার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়াছেন।
খলিফারে গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারী বাহারুল উলুম আল্লামা ছৈয়দ আবদুল গণী কাঞ্চনপুরী (রঃ) এর অভিব্যক্তি নিম্নরূপ। তিনি গাউছুল আজম বাবা ভাণ্ডারী (কঃ) কে গাউছুল আজম মাইজভাÐারীভাণ্ডারী (কঃ) এর ঐ গাউছিয়তের মকামে অধিষ্ঠিত বলে তার কালামে অকপটে বর্ণনা দিয়াছেন এবং হযরত গাউছুল আজম (কঃ) এর পর্দা গ্রহণের পর তার খলিফাগণ হযরত বাবা ভাণ্ডারী(কঃ) এর সংস্পর্শে এসে গাউছিয়তের নেয়ামত সমূহ অর্জন করেছেন। তাই হযরত গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারী (কঃ) এর অন্যান্য খলিফাগণ বাবা ভাণ্ডারী কেব্লাকে “পীর ভাই” এর দৃষ্টিতে না দেখে হযরতের স্থলাভিষিক্ত পীরান’দের পীর’রূপে দেখেছেন। তাই তাদের যত শ্রদ্ধা সজিদা ও ভক্তির ডালি বাবা ভাণ্ডারী কেবলা (কঃ) এর কদমে দিয়াছেন।
রূমীয়ে বাঙ্গাল আল্লামা বজলুল করিম মন্দাকীনি (রঃ) ও গাউছুল আজম বাবা ভাণ্ডারী (কঃ) এর অবস্থাকে মাইজভাণ্ডারী পরিমণ্ডলে কতটুকু এবং তিনি যে গাউছিয়ত ও কুতুবিয়াত এ দু পদের পদবান এবং তার শানে ন্যূনতম কপটতা থাকলে সে পাক্কা নাফরমান, বেঈমান, রাজদ্রোহী ও অজ্ঞান বলে তার সুনিপুন লেখনীতে উল্লেখ করেছেন।
২৩ বৎসর বছর বয়সে হযরত বাবা ভাণ্ডারী বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেও দুনিয়াবী কর্মকাণ্ডে তিনি মনোনিবেশ করতে পারলেন না। ক্রমান্বয়ে তিনি খোদার রহস্যালোকে অবগাহন করে স্রষ্ঠার নৈকট্য, লাভে আগ্রহী হয়ে উঠলেন্ খোদার রহস্য উপলব্ধি করার জন্য গভীর অরন্যে, বনজঙ্গল, পাহাড়-পর্বতে বঙ্গোপসাগরের বেলা ভূমিতে বছরের পর বছর কঠোর রেয়াজত করে খোদারী রহস্য আত্মস্থ করলেন। লাভ করলেন বেলায়তের সর্বোচ্চ মকাম।
মানবতার কল্যাণে, দুঃখ দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের দুঃখ লাগবে প্রকাশ করলেন অসংখ্য কারামত, পরিশুদ্ধ করলেন মানুষকে, খোদার নৈকট্য লাভে ধন্য করলেন অসংখ্য অগনিত পাপী তাপী দিশেহারা মানব। দয়ার নজরে কতযে খোদা প্রেমিককে আউলিয়া বানাইয়া দিয়াছে তার কোন পারিসংখ্যান নাই।
এই পবিত্র খোমরোজ শরীফের উছিলায় হযরত গাউছুল আযম বাবা ভাণ্ডারীর রহমত, ফয়েজ, বরকত আমাদের সকলের উপর বর্ষিত হোক। আমিন।

লেখক : প্রাবন্ধিক