‘মাইক এজাহার’ স্বাধীনতা সংগ্রাম ও আওয়ামী লীগের কিংবদন্তী

137

 

আওয়ামী লীগের প্রথম প্রজন্মের প্রায় সব নেতা বা কর্মী যাই বলি না কেন, ইহলোক থেকে বিদায় নিয়েছেন। যিনি জমরাজকে ফাঁকি দিয়ে ইহজগতে বিচরণ করে চলেছেন, তিনি হাজি এজাহার মিঞা। বয়সে তাঁর চেয়েও জ্যেষ্ঠ সীতাকুন্ডের ডা. এখলাসউদ্দিন ও রাঙ্গুনিয়া থানার পোমরা নিবাসী চেয়ারম্যান জহির। কিন্তু তাঁরা আওয়ামী লীগে এসেছেন ষাটের দশকে। সেজন্য এজাহার মিঞাই একমেবাদ্বিতীয়াম। আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়। আওয়ামী লীগই স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা করে এবং পরবর্তীকালে ধাপে ধাপে সেই সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যায়। চূড়ান্ত পরিণতিতে ৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। এজাহার মিঞার আপন খালাতো ভাই ছিলেন এম এ আজিজ ও চান্দগাঁওয়ের ইউনুস খান। তাঁরা ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুন পুরাতন ঢাকার টিকাটুলীতে রোজ গার্ডেন হলে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা-সম্মেলনে যোগদান করেছিলেন। রোজ গার্ডেন সম্মেলন থেকে এসে এম এ আজিজ চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের কমিটি গঠন করার উদ্যোগ নেন। তিনি, জহুর আহমদ চৌধুরী, মওলানা আবদুর রহমান চৌধুরী, সালারে জিলা শহীদ শেখ মোজাফ্ফর আহমদ, মওলানা আবু তাহের প্রমুখের চেষ্টায় চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগ গঠিত হয়। সালারে জিলা শহীদ শেখ মোজাফ্ফর আহমদ সভাপতি ও এম এ আজিজ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
এজাহার মিঞা তখন ১৩ বছর বয়সী দুরন্ত বালক। বড় ভাই এম এ আজিজ তাঁর হিরো। এম এ আজিজকে ছায়ার মত অনুসরণ করেন। এম এ আজিজ যেখানে যান, কখনো লুকিয়ে চুরিয়ে কখনোবা প্রকাশ্যে তাঁকে অনুসরণ করতেন। এভাবে এজাহার মিঞা আওয়ামী লীগের বলয়ে এসে পড়েন। সেই থেকে এজাহার মিঞা আওয়ামী লীগই করেছেন, আর কোনো দল করেননি। স্বাধীনতা সংগ্রামকে বেগবান করার জন্য আওয়ামী লীগ ৪৯ থেকে ৭১ এর মার্চ পর্যন্ত বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে মানুষকে উজ্জীবিত করে তোলার চেষ্টা চালায়। আওয়ামী লীগের এসমস্ত কর্মসূচিতে এজাহার মিঞা প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। সেজন্য তাঁকে একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী আখ্যা দেয়াই সমীচীন।
এজাহার মিঞা ৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করেছেন। চট্টগ্রামে ভাষা আন্দোলনে আওয়ামী লীগের ভূমিকা ছিলো অত্যন্ত গৌরবোজ্জ্বল। জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এম এ আজিজ তো সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহŸায়কই ছিলেন। শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জহুর আহমদ চৌধুরী ভাষা আন্দোলনের শীর্ষ নেতা ছিলেন। ভাষা আন্দোলনের সমর্থনে যত জনসভা কিংবা পথসভা হয়েছিলো, তার প্রায় সবগুলোতেই সভাপতিত্ব করতেন জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ মোজাফ্ফর আহমদ। ভাষা আন্দোলনের অন্যতম বিশিষ্ট সংগঠক ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা ডা. আনোয়ার হোসেন। তাদের সঙ্গে বিভিন্ন কর্মসূচিতে এজাহার মিঞা অংশ নিতেন, তিনি ভাষা আন্দোলনের কর্মী ছিলেন। ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমিনকে জুতা মেরেছিলেন ও পচা ডিম নিক্ষেপ করেছিলেন। ভাষা আন্দোলনের পরে নুরুল আমিনের বিরুদ্ধে ছাত্র হত্যার অভিযোগ উঠে এবং তিনি সর্বসাধারণের নিন্দা ও ঘৃণার পাত্র হয়ে উঠেন। সেরকম বিরূপ পরিস্থিতিতে চট্টগ্রামে জনসভা করতে এসেছিলেন নুরুল আমিন। লালদিঘি ময়দানে জনসভা হচ্ছিলো। জনসভা শুরু হতে না হতে চারিদিক থেকে জুতা ও ডিম নিক্ষিপ্ত হতে থাকে। এজাহার মিঞাও সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন এবং নুরুল আমিনকে জুতা ও ডিম নিক্ষেপ করেছিলেন সেকথা আগেই বলেছি। এঘটনার পরে রমেশ শীল একটি গান লিখে নুরুল আমিনের হেনস্তা হওয়ার ঘটনাকে রসঘন ভাষায় পরিবেশন করেছিলেন। এজাহার মিঞা সেই গান বহু সভায় গেয়েছেন এবং ৮৫ বছর বয়সেও পুরোগান আজো তিনি গেয়ে শুনাতে পারেন। সেই ঐতিহাসিক গানটি হলো-
প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমিন চট্টগ্রাম সফর /শোনরে ভাই আজগুবী খবর/ শনিবারে ১টার পরে লালদিঘিতে মিটিং করে/প্রধানমন্ত্রী বলি যারে নুরুল আমিন ভাই/ হঠাৎ চললো ছিঁড়া জুতা/ বৃষ্টির মতো পড়তে লাগলো/ পঁচা আÐা /উড়তে লাগলো কালো ঝাÐা/ মন্ত্রীজির চোখের ওপর/ শোনরে ভাই আজগুবী খবর।/ কয়েদীদের গাড়ি পাইয়া/নুরুল আমিন গেল ধাইয়া/ জনতা বিক্ষোভ করে করে গালাগালিতে/ দুঃখের কথা বলি/ মুসলিম লীগের কাÐ দেখে/ জীবন উঠে জ্বলি।/ ফরিদপুরের মোহন মিয়া ৭৬ জন/ মেম্বার নিয়া/ অনাস্থা প্রস্তাব আনিয়া/ সভাই ধরে তুলি রে/ দুঃখের কথা বলি/ মুসলিম লীগের কাÐ/দেখে জীবন উঠে জ্বলি। শোন আর এক কথা/ লীগের নেতা মনসুরাবাদে/ ১ হাজার লোক উচ্ছেদ করেন/ ইটখোলা বাঁচাইতে। ৫৩ সাল থেকে আওয়ামী লীগের সমস্ত কর্মকাÐে তা জনসভা হোক, কিংবা মিছিল কিংবা হরতাল যাই হোক না কেন, তাতে এজাহার মিঞার সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিলো। এজাহার মিঞার হাতিয়ার ছিলো একটি মাইক। ৫৪ সালে এম এ আজিজের নির্বাচনী কর্মকাÐে এজাহার মিঞা তাঁর মাইক দিয়ে ব্যাপক প্রচারণা চালান। পতেঙ্গা থেকে সীতাকুন্ড পর্যন্ত সমস্ত নির্বাচনী এলাকায় তিনি গান গেয়ে গেয়ে চারণের বেশে ঘুরে বেড়ান। ছোটবেলা থেকেই তাঁর গান গাওয়ার অভ্যাস। একটু বড় হলে এম এ আজিজের মাধ্যমে কবিয়াল স¤্রাট রমেশ শীলের সঙ্গে পরিচয় হয়। রমেশ শীলের কাছ থেকে তিনি গান রচনা ও পরিবেশনের কলাকৌশল শেখেন। ১৯৬৬ সালের ২৫ ফেব্রæয়ারি বঙ্গবন্ধু চট্টগ্রামের লালদিঘি ময়দানে তাঁর ঐতিহাসিক ৬ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। সেদিন যে জনসভা হয়েছিলো, তার মঞ্চ তৈরি করেছিলেন পটিয়ার চাচা খালেক ও এজাহার মিঞা। ৬৬ সালের ৭ জুন ৬ দফা বাস্তবায়নের দাবিতে আওয়ামী লীগের ডাকে সারাদেশে হরতাল পালিত হয়েছিলো। পুলিশের গুলি চালানোর কারণে হরতাল রক্তাক্ত রূপ পরিগ্রহ করেছিলো। অনেকে হতাহত হয়েছিলো। চট্টগ্রামে হরতাল সফল করার জন্য এজাহার মিঞার মাইক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলো।
হালিশহরে বিহারী অধ্যুষিত একটি কলোনী ছিলো। ৭ জুনের হরতালের প্রচারের জন্য বিভিন্ন জায়গায় মাইক দিয়ে প্রচারণা চালানো হলেও বিহারী কলোনীতে প্রচার করতে কেউ যেতে রাজি হচ্ছিলো না। তখন এজাহার মিঞাই সাহস করে এম এ আজিজ ও জহুর আহমদ চৌধুরীর সামনে বলেছিলেন ‘আমি যাব’। ভাসাানীর মাইক দিয়ে আমি পাবলিসিটি করবো। তাঁর কথা শুনে জহুর আহমদ চৌধুরী তাঁকে ৫০ টা টাকা দিয়েছিলেন।
৬ দফার জনসভার ও ৭ জুনের হরতালের জন্য পতেঙ্গা থেকে মিরসরাই পর্যন্ত ৪টি মাইক দিয়ে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয়েছিলো। একটি মাইক নিয়ে বের হয়েছিলেন এজাহার মিঞা, আরেকটি মধ্যম হালিশহরের ভাগিনা কালু, সল্টগোলার মুক্তিযোদ্ধা এনামুল হক চৌধুরী ও মধ্যম হালিশহরের নুরুল আলম (বন্দর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি) একটি করে মাইক নিয়ে প্রচার করেছিলেন।
এজাহার মিঞা ৬ দফার বইও বিলি এবং বিক্রি করেছিলেন। বইয়ের দাম ছিলো ৪ আনা। শেখ আহমদও এজাহার মিঞার সঙ্গে ৬ দফার বই বিতরণে অংশ নিয়েছিলেন। এজাহার মিঞা মিটিং-মিছিলেও যোগ দিতেন এবং গানে ও ¯েøাগানে রাজপথ মুখরিত করে তুলতেন। ৭০ সালে এম এ আজিজের নির্বাচনে পোস্টার লাগানো, বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত দলীয় অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ ও লিফলেট বিতরণ থেকে সবকাজই করেছিলেন এজাহার মিঞা। তখন আওয়ামী লীগের তেমন কোন অফিস ছিলো না। চায়ের দোকানই ছিলো অফিস। চায়ের দোকান- ভিত্তিক আওয়ামী লীগ অফিসের একটি তালিকা দেন এজাহার মিঞা। এগুলি এখন ইতিহাসের বিষয়বস্তু। মধ্যম হালিশহরে আব্দুর রাজ্জাকের চায়ের দোকান, চৌচালার বাদশার চায়ের দোকান, ওমরশাহ পাড়া সুলতান আজিজ সওদাগরের চায়ের দোকান, পতেঙ্গা আলীর চায়ের দোকান, আনন্দ বাজার মোহাম্মদ শরীফ সওদাগরের চায়ের দোকান, ফকির হাটের বোচা মিঞার চায়ের দোকান, বক্সির হাটে ছমদিয়া চায়ের দোকান, মধ্যম হালিশহরের শুক্কুরের চায়ের দোকান, চাঁন্দার পাড়া আমিরুজ্জামা সারেং এর চায়ের দোকান ছিলো আওয়ামী লীগের অফিস।
৭১ সালের ২৪ মার্চ বন্দরে সোয়াত জাহাজ অবরোধেও জনগণকে সামিল করতে এজাহার মিঞা তাঁর মাইক দিয়ে ব্যাপক প্রচার চালিয়েছিলেন। কুরুক্ষেত্রে ছিলো এক পিতামহ ভীস্ম, একালের যদু বংশ আওয়ামী লীগেরও পিতামহ সদৃশ এজাহার মিঞা। তাঁর পৈত্রিক নাম এজাহার মিঞা, কিন্তু সে নামে তাঁকে কেউ চেনে না। তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য বলতে হবে ‘মাইক এজাহার’ ।
এজাহার মিয়ার বাড়ি মধ্যম হালিশহর। তিনি হালিশহরের প্রবাদপুরুষ এম এ আজিজের খালাতো ভাই। এম এ আজিজ আওয়ামী লীগ করার কারণে তাঁর নিজ ভাই এবং খালতো ভাইয়েরা সবাই তাঁকে অনুসরণ করে আওয়ামী লীগের পতাকাতলে সমবেত হয়। তিনি যেমন চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা, তেমনি তাঁর ছোট ভাই এম এ হালিম ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি মধ্য পঞ্চাশ পর্যন্ত চট্টগ্রাম জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন।
এজাহার মিয়ার মাইক ব্যবসায়ী হওয়ার একটি ইতিহাস আছে। সে ইতিহাস বলছি। বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনের পূর্ববর্তী কোনো এক সময় আওয়ামী লীগ সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সাংগঠনিক সফরে চট্টগ্রামে এসেছেন। ১২০ নং আন্দরকিল্লায় ছিলো আওয়ামী লীগের অফিস। চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগ সম্পাদক এম এ আজিজ দুপুরে দলীয় সভাপতিকে নিয়ে খাওয়া দাওয়ার পর তাঁকে নিয়েই আওয়ামী লীগ অফিসে আসেন। আওয়ামী লীগ অফিসে দুটি কামরা- সামনে বড় কামরা, পেছনে একটি ছোট কামরা ছিলো, সেখানে এম এ আজিজ ঘুমাতেন। সেদিন মওলানা ভাসানীও তাঁর সঙ্গে সেখানে ঘুমাচ্ছিলেন। সামনের কামরায় এজাহার মিয়া ও কবিয়াল স¤্রাট রমেশ শীল। বিকেলে মওলানা ভাসানী লালদিঘি ময়দানে জনসভায় বক্তৃতা করবেন। তাঁর জনসভায় কবিগান পরিবেশনের জন্য রমেশ শীলকে আমন্ত্রণ জানিয়ে আনা হয়েছে। এজাহার মিয়ার সঙ্গে তাঁর কথা হচ্ছিলো, এক পর্যায়ে রমেশ শীল এজাহার মিয়াকে বললেন, আমি মুখে মুখে তোমাকে একটি রচনা করে দিচ্ছি। তুমি গানটা গাইবে। তাতে মওলানা সাহেবের ঘুম ভেঙে গেলে তিনি খুশি হয়ে যায় যদি তোমাকে ৫টি টাকা দেন, তাহলে তুমি তা’ থেকে আমাকে চা খাওয়াবে কিনা বল। আমার খুব চায়ের তেষ্টা পেয়েছে। এজাহার মিয়া রাজি। রমেশ শীল সেদিন যে গানটি রচনা করেছিলেন সেটি হলোÑ
রাজবন্দীদের দুঃখের কথা/ পাইলে মাইনষেরে কইও/ তারা কি জেলের কথা জানে/ পঁচা চইলের ডাইলের পানি/ ভাসানীর পরানে ন টানে/তারা কি জেলের খবর জানে/ লেদা পোকের ডাইলের পানি/শেখ মুজিবের পরানে ন মানে/ তারা কি জেলের খবর জানে।
এজাহার মিয়ার সুরেলা গলা ছিলো। তিনি সুর করে গানটি গাওয়ার পর সত্যিই মওলানা সাহেবের ঘুম ভেঙে যায়। তিনি এজাহার মিয়াকে ৫টি টাকা দিয়ে বললেন, বালক, তুমি আমার কাছে আর কি চাও। তখন এজাহার মিয়া বললেন ‘কলের বাজা’। মওলানা সাহেব বুঝতে না পেরে এম এ আজিজকে জিজ্ঞেস করেন কলের বাজা কি। কলের বাজা মানে যে গ্রামোফোন সেটা এম এ আজিজ ঠিকই বুঝেছিলেন। কিন্তু তিনি বুদ্ধি করে মওলানা সাহেবকে বলেছিলেন, হুজুর, ও আসলে একটি মাইক চায়। কলের বাজা মানে ও সেটাই বুঝাচ্ছে। মাইক পেলে ভাষা আন্দোলন ও দলীয় প্রপাগাÐা চালাতে সুবিধা হবে। মাইক তো সঙ্গে সঙ্গে পাওয়া যায় না। মওলানা ভাসানী তিন মাস পর কলকাতা থেকে মাইক কিনে এনে সেটি এজাহার মিয়ার কাছে পাঠান।
এজাহার মিয়া মাইক দিয়ে আওয়ামী লীগের প্রচার কাজ চালাতেন। পরে তিনি মাইকটিকে ব্যবসায়িক ভিত্তিতে ব্যবহার শুরু করেন। কিন্তু কখনো মুসলিম লীগকে মাইক ভাড়া দেননি। মাইকের চাহিদা বাড়তে থাকলে তিনি সল্টগোলা ক্রসিংয়ে মঞ্জু মিয়ার দোকানে তাঁর মাইক রেখে ভাড়া দিতে থাকেন। তাঁর মাইক ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
আওয়ামী রাজনীতির গঠনকালে মাইকের প্রয়োজন ছিলো। কারণ মাইক একটি প্রচারযন্ত্র এবং আওয়ামী লীগের অগ্রসরমান অগ্রযাত্রায় যিনি ঐ প্রচারযন্ত্র নিয়ে অংশগ্রহণ করেন তিনিই হয়ে গেলেন ‘মাইক এজাহার’। মাইক তখন আরো অনেকের ছিলো , কিন্তু তাদের মাইক আওয়ামী লীগের সেবায় নিবেদিত হয়নি। শুধু একা এজাহারই তাঁর কাছে থাকা মাইকটি আওয়ামী লীগকে উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁকে আওয়ামী লীগের মুখপাত্র বললেও বাড়িয়ে বলা হবে না। তাঁর মাইকই আওয়ামী লীগের মুখপাত্র । মওলানা ভাসানী যেদিন তাঁকে মাইক উপহার দিলেন, সেদিনই এজাহার মিয়ার বিধাতা তাঁর ভাগ্য নির্ধারণ করেছিলেন মাইকের সঙ্গে। মাইককে অবলম্বন করেই তিনি জীবিকা নির্বাহের পথ খুঁজে পেলেন। জীবনে আর কিছু করলেন না। মাইকই হলো তাঁর ভাগ্যল²ী।
ভাসানীর এক মাইক থেকে এজাহার মিয়া তিনটি মাইকের মালিক হন। বাড়ি থেকেই মাইকের ব্যবসা করতেন। পরে সল্টগোলা ক্রসিং এ মঞ্জু মিয়ার ক্যান্টিনে মাইক রেখে ব্যবসা করেন। ব্যবসা করেছেন ঠিকই, কিন্তু সবার সঙ্গে ব্যবসা করেননি। মুসলিম লীগকে কখনো মাইক ভাড়া দেননি। এজাহার মিয়া মূলত আওয়ামী লীগের জন্যই মাইক ব্যবসা আরম্ভ করেছিলেন। কারণ তাঁর বদ্দা আজিজ মিঞা চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করেছেন। বদ্দার দলকে সহযোগিতা করাই ছিলো তাঁর লক্ষ্য। এম এ আজিজ যেমন তাঁর খালাতো ভাই, তাঁর ভাই মজিদ মিয়া, হালিম সাহেব, ইউনুস মিয়াও তাঁর খালাতো ভাই। চান্দগাঁওর ইউনুস মিয়া, যাঁর আন্দরকিল্লায় ফার্নিচারের দোকান ছিলো, তিনিও তাঁর খালাতো ভাই। সব খালাতো ভাই আওয়ামী লীগ করতেন। এজাহার মিয়াও তাঁদের দেখাদেখি আওয়ামী লীগ করতেন মনের আনন্দে। আওয়ামী লীগের জন্য আজিজ মিয়ার পরিবারের অবদান অপরিসীম।
এজাহার মিয়া শুধু মাইক ভাড়া দিতেন না। তিনি মাইকে আওয়ামী লীগের মিটিং মিছিলের পাবলিসিটি করতেন, আবার গানও গাইতেন। কথায় কথায় বললেন, পঞ্চাশ, ষাটের দশকে আওয়ামী লীগ শুধু আন্দোলন, মিটিং মিছিলের জন্য জনপ্রিয় হয়নি। গানের জন্যও আওয়ামী লীগ মানুষের মন জয় করতে পেরেছিলো। সেইসব হৃদয়গ্রাহী গানের কারণে আওয়ামী লীগ মানুষের মরমে পৌঁছতে পেরেছিলো, হৃদয়ে ঠাঁই করে নিতে পেরেছিলো। তখন একদল গায়ক সৃষ্টি হয়েছিলো, যারা মাঠে ময়দানে আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য গান পরিবেশন করতো। তাঁরা পেশাদার শিল্পী নন, প্রশিক্ষিত গায়ক নন, বাংলার আকাশ-বাতাস থেকে মেঠো সুর সংগ্রহ করে নিজেরা কথার মালা গেঁথে চারণ কবির মতো সুরেলা কণ্ঠে মন মাতানো গানে চট্টগ্রাম মুখরিত করে তুলতেন। এই অশিক্ষিত চারণ কবির দলে ছিলেন পতেঙ্গার আলী মুন্সি, বাংলাবাজারের বজল মিঞা, আজাদীর সাংবাদিক ওবায়দুল হক, স›দ্বীপের রফিক ও মোহাম্মদ শাহ বাঙালি এবং আতুরার ডিপোর বদন মিয়া দীদারি। ঘোড়ার গাড়িতে করে তাঁরা গান গেয়ে রাস্তার দু’পাশের মানুষকে মাতিয়ে তুলতেন। কবিয়াল রমেশ শীল ছিলেন তাঁদের কাব্যগুরু। তাঁরা কবিতার ছন্দের মিল আর গানের সুরের ঝংকারে মানুষের হৃদয়তন্ত্রীতে ঝংকার তুলতেন।
১৯৫৩ সালে মওলানা ভাসানী চট্টগ্রামে এসেছেন। চট্টগ্রামের নেতাদেরকে নিয়ে তিনি হালিশহর থেকে হেঁটে পতেঙ্গা যান। পথে পথে বিভিন্ন দোকানে কর্মীদের পাঠিয়ে জিনিসের দাম যাচাই করতে বলেন। বিশেষ করে নারিকেল তেল, গোলমরিচ, হলুদের দাম জিজ্ঞেস করতে বলেন। পরে আরেকদিন হালিশহর থেকে হেঁটে হেঁটে পতেঙ্গা যাওয়ার সময় কর্মীদের মধ্যে যারা গান গাইতে পারতো তিনি তাদেরকে বলেন তোমরা গান গাও, তখন তারা এই গানটি গেয়ে গেয়ে রাজপথ মুখরিত করে তুলেছিলো। গানটি হলো-
প্রথমে আল্লার নাম করিয়া স্মরণ/ দ্বিতীয় করিয়া নবীর কদম চুম্বন/ কবিতা রচনা করি বিপদ ভারি/ স্বাধীন পাকিস্তানে হাহাকার করে/ দেশের হিন্দু মুসলমানে/ স্বাধীন দেশের নাগরিক/ কইরল শেষ/ মুসলিম লীগের গুণ / ১৬ টাকা পরিবারে খাবাইল নুন/ ৭ টাকা হইল দেশের/ কারো ফের/দেশের লোকে খায়/ গোলমরিচ ৩২ টাকা/ বাজারে বিকায়/ নারকেল তেল ৭ টাকাতে/ মা বোনেরা মাথায় দিতে নারে/ জবাকুসুম ভৃঙ্গরাজ এমএলএ-দের ঘরে/ সুগন্ধির ছড়াছড়ি লজ্জায় মরি/ কাপড় কারো নাই/ কাফন ছাড়া মুর্দা গাড়ন/ হবে কি উপায় / মেয়েরা শরমে মরে/ পুকুর পাড়ে পানি আনতে/ না যায়/ পরনেতে ছিড়া তেনা/ শরীর দেখা যায়
পুরুষের লুঙ্গি ধূতি/ ধরেছে কি কুড়ি টাকা জোড়া/ কুকির মুল্লুক না যায়ে ভাই/ বাচনি আর মরা
উলঙ্গ সারা দেশ …।
৬ দফা আন্দোলনের সময় এজাহার মিয়ারা নিম্নবর্ণিত গানটি গেয়ে মানুষকে সচেতন করে তুলেছিলেন-
৬ দফা ত তোমার আমার/ শেখ মুজিবের কিছু না।
আইলরে ভাই জনগণের/ ৬ দফার জমানা \
মাইনষে হাসে আÐা মারে/ কার বিলাইয়ে খায়।
বঙ্গবন্ধু ৬ দফা দি/ বিলাই ধইর ত চায় \
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা