মহীয়সী নারী জওশন আরা রহমান

62

 

বিশ শতকের দু’তিন দশক পর্যন্ত চট্টগ্রামের নারীজীবন ছিলো পর্দার ঘেরাটোপে ঢাকা। মুসলিম সমাজ সম্পর্কেই এটা বিশেষভাবে প্রযোজ্য। তবে হিন্দু, বৌদ্ধ সমাজও যে খুব একটা এগিয়ে ছিলো তা’ নয়। শিক্ষার কথা যদি ধরি, তাহলে দেখবো নারীকে শিক্ষার জন্য যোগ্যই মনে করা হতো না। তখন বাল্যকালে মেয়েদের বিয়ে হয়ে যেত। এমনকি আমাদের কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী মৃণালিনী দেবীও কবির সঙ্গে বিয়ের সময় একজন অল্পবয়স্ক বালিকাই ছিলেন। সমাজ মনে করতো নারীর শেষ গন্তব্য যখন স্বামীগৃহ, তখন এত লেখাপড়া শিখে আর কাজ কি। চট্টগ্রাম কলেজে তখনো সহশিক্ষা চালু হয়নি। জননায়ক যাত্রামোহন সেন তাঁর স্ত্রী বিয়োগের পর পরলোকগত শ্বশুরের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে ডা. খাস্তগীর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বটে, কিন্তু তাতে ক’জনই বা ছাত্রী। হিন্দু-বৌদ্ধ পরিবার থেকেই ছাত্রী আসতো বেশি, এই সময় আমরা বিপ্লবী কন্যা প্রীতিলতা ও কল্পনা দত্তের সাক্ষাৎ পাই। মুসলিম পরিবার থেকে আগত তিনজন ছাত্রীর নাম পাচ্ছি। খান বাহাদুর আবদুল আজিজ বিএ’র নাতনি, নজরুল-খ্যাত নাহার-বাহারের নাহার অর্থাৎ শামসুন্নাহার মাহমুদ আসতেন রেয়াজুদ্দিন বাজার ‘আজিজ মঞ্জিল’ থেকে; খান বাহাদুর আবদুর রহমান দোভাষের কন্যা আমেনা ও জামেনা আসতেন ফিরিঙ্গীবাজার পৈতৃক বাসভবন থেকে পারিবারিক কারে করে। বিশ শতকের চতুর্থ দশক থেকে নারীজীবনের উন্নতি ঘটতে থাকে। এই সময় বাঁশখালীর নভেরা আহমদের সাক্ষাৎ মেলে, যিনি উত্তরকালে একজন ভাস্কর্য শিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
পঞ্চাশের দশকে আমরা পাই সাতকানিয়া থানার চুনতী গ্রামের একজন ছাত্রী, তাঁর নাম জওশন আরা রহমান। চুনতী গ্রামটা প্রসিদ্ধ। বলা হয়, গ্রামের শতকরা ৯৯ জন মানুষ শিক্ষিত। কবি সুফিয়া কামাল এই গাঁয়েরই বধূ। জওশন আরা রহমানের জীবনকে দিয়ে আমরা চট্টগ্রামের নারীজাতির অগ্রগমনের একটি ইতিবৃত্ত পেতে পারি। উনিশ শতকে চট্টগ্রামের সাতকানিয়া থানার চুনতী গ্রামের একটি আলোকপ্রাপ্ত পরিবারে জওশন আরা রহমানের জন্ম। শুকুর আলী মুন্সেফ পরিবারের স্থাপয়িতা। জওশন আরা রহমান তাঁর নাতনি। শুকুর আলী মুন্সেফের নামে চট্টগ্রাম মহানগরের রুমঘাটা গলিতে একটি উপগলি রয়েছে। জওশন আরা রহমানের পিতা মাহবুবুর রহমান ছিলেন বিভাগ-পূর্ব বাংলার চট্টগ্রাম জেলার প্রথম জেলা রেজিস্ট্রার; মাতা সাদীদা খানম, তিনিও বিদূষী নারী। তিনি একজন লেখক। জওশন আরা রহমান খাস্তগীর স্কুলে অধ্যয়নকালে বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনে শহরে ট্রাক মিছিল করেন, ভাষার দাবিতে আয়োজিত সমাবেশে যোগ দেন। ভাষা সংগ্রামী প্রতিভা মুৎসদ্দী সে সময় চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্রী, তিনি এবং তালেয়া রেহমান (সাংবাদিক শফিক রেহমানের স্ত্রী) চট্টগ্রাম কলেজ থেকে খাস্তগীর স্কুলে গিয়ে সে স্কুলের ছাত্রীদের মিছিলে যোগ দেন।
চট্টগ্রাম কলেজে অধ্যয়নকালে জওশন আরা রহমান ১৯৫৫-৫৬ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্র সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে কলেজের বার্ষিক ম্যাগাজিন “অন্বেষা” সম্পাদনা ও প্রথম বাংলায় প্রকাশ করেন। সে সময় চট্টগ্রাম কলেজ থেকে সহপাঠী, নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূস সহ দু’পাতা নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। এছাড়া চট্টগ্রামে সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও কার্যক্রমে নারীর অংশগ্রহণের অগ্রদূতই ছিলেন তিনি।
“একটি ঋদ্ধ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে তিনি বড় হয়েছিলেন। তাঁর লেখা থেকে আমরা যার সাক্ষ্য পাই-“৬০ দেওয়ান বাজার আমাদের বাসাটি ছিল বুদ্ধিদীপ্ত তরুণদের একটি মনোরম আড্ডার জায়গা। এখানে সাহিত্য-সংস্কৃতি, সমাজ-উন্নয়ন, রাজনীতি বিষয়ে উৎসাহী ব্যক্তিরা আসতেন। এর মধ্যে নবীনেরা ছিল খুবই প্রাণবন্ত। তাদের নিয়ে আমাদের একটি বিশেষ জগৎ ছিল। প্রায়ই বিকেলে আমরা জোর আড্ডায় বসতাম। এতে থাকতো সুচরিতদা, শফিউল আলম, মামুন ভাই, হারুন ভাই, ইউনূস ভাই, আবদুস শাকুর, এমদাদুল ইসলাম, দীননাথ সেন, সোবহান, সুধাংশু ভট্টাচার্য (একাত্তরের শহীদ) আবদুল হাই, কাজী ফরিদ প্রমুখ। এমদাদ ভাই সব সময় গুরুগম্ভীরভাবে মাহবুবের সাথে রাজনীতির কথা আলোচনা করতেন। মাহবুরের অত্যন্ত প্রিয় পাত্র। বাম ঘেঁষা সেই এমদাদ এখন চট্টগ্রামের একজন প্রতিষ্ঠিত এডভোকেট। ধীরস্থির প্রকৃতির মানুষ শফি ভাই চমৎকার বক্তৃতা দিতেন। কলেজ সংসদে নির্বাচিত জেনারেল সেক্রেটারি হিসেবে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মসূচি হাতে নিয়েছিলেন। তার সঙ্গে কাজ করতে খুবই আনন্দ পেতাম তার নির্মল হাসি এবং সুমিষ্ট ব্যবহারের জন্য। আজকাল দীননাথের কথা বিশেষ করে মনে পড়ে। কলেজ ম্যাগাজিন প্রকাশের সময় একসাথে কাজ করতে গিয়ে তার সাহিত্য-প্রতিভার পরিচয় পাই। প্রায়ই আমাদের বাসায় আসতো”। (জওশন আরা রহমান : স্মৃতিকথা একটি অজানা মেয়ে, পৃষ্ঠা. ৮০-৮১), তৃতীয় মুদ্রণ : ২০১০, নবযুগ প্রকাশনী, ঢাকা।)
পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানও ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁরা নিজেদের মধ্যে প্রথম ঘরোয়াভাবে শুরু করেছিলেন দেওয়ান বাজারে তাঁদের বাড়ির পেছনের উঠোনে। তাঁর স্মৃতিকথায় এই অনুষ্ঠানের অনবদ্য বিবরণ পাইÑ “আন্দরকিল্লা থেকে আসতেন বেলা হক, আবদুল হক, ফ্যানসি, রুমী, সানি। পাথরঘাটা থেকে তারাপদ ঘোষ, চিত্তরঞ্জন দাশ, পুতুল রানী দাশ এবং তাঁদের ছেলে মেয়েরা, বানী দাশ এবং তার ছেলেমেয়েরা, শিখারানী দাশ ও নিখিলরঞ্জন দাশ, সদরঘাট থেকে কামাল এ খান এবং কিশোয়ার, রুমঘাটা থেকে হুসনুন্নাহার, লুৎফর রহমান, শাহাবুদ্দীন, স্বপন, নওশাদ ও সেবু। দেওয়ান বাজার থেকে মেজবাহউদ্দীন জঙ্গী এবং সেজবাবু। আমাদের পাড়া থেকে কৃষ্ণগোপাল সেন, মীরা সেন, সমীরন রায় এবং তার ছেলে মেয়েরা। দেখতে দেখতে লোকের ভিড়ে আমাদের উঠোন ভরে যেত।
উষালগ্নে সুচরিতদার বাঁশি বাদনের মধ্য দিয়ে পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠান শুরু হতো। তারপর সকলে মিলে ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো এই গান গেয়ে আমরা বছরের প্রথম দিনকে বরণ করতাম। চমৎকার আবৃত্তি করতেন চিত্তরঞ্জন দাশ। পর পর অনেকগুলো একক ও সম্মিলিত গানের শেষে পরিবেশন করা হতো লুচি-তরকারি। পুতুল রানী এতে আমাকে সহায়তা করতেন। রোদ তীব্র হয়ে ওঠার আগেই আমাদের অনুষ্ঠান শেষ হতো। আমাদের পয়লা বৈশাখ উদযাপন অনুষ্ঠানে একদিন ঘটনাক্রমে উপস্থিত ছিলেন প্রফেসর মুনীর চৌধুরী। তিনি মাহবুবের বহু পুরোনো বন্ধু। ঢাকা থেকে বিশেষ কাজে চট্টগ্রাম এসেছিলেন। সেবার আমাদের বাসায় উঠেছিলেন …। পয়লা বৈশাখকে কেন্দ্র করে ছোটদের একটি শিল্পী গোষ্ঠী গড়ে ওঠে। এর প্রেক্ষিতে রবীন্দ্র জন্মোৎসব করার উদ্দেশ্যে ছোটদের রবীন্দ্রজয়ন্তী সংসদ নামে একটি কমিটি গঠন করা হয়। মুসলিম ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে ৩০ বৈশাখ, ১৩৭৩ বাংলা, ১৪ মে ১৯৬৬ এই সংসদের উদ্যোগে রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপিত হয়। এই উপলক্ষে দুই পৃষ্ঠার একটা ফোল্ডার ছাপানো হয়েছিল…”। (জওশন আরা রহমান : স্মৃতিকথা একটি অজানা মেয়ে, পৃষ্ঠা. ৮৫-৮৬), প্রাগুক্ত)
এই অসামান্য নারী জওশন আরা রহমানের ৮৬তম জন্মদিন আজ। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের আজকের এই দিনে তিনি মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হন। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে ডা. খাস্তগীর সরকারি বালিকা বিদ্যালয় থেকে বৃত্তিসহ প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। পরীক্ষার ফল প্রকাশ হবার আগেই বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হন কবি ও ভাষা সংগ্রামী মাহবুব উল আলম চৌধুরীর সঙ্গে। বিয়ের পর নিয়মিত লেখাপড়ায় বিঘ্ন ঘটে।
১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে জওশন আরা রহমান তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রী সংসদের চট্টগ্রাম জেলা শাখার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ১৯৫৮ সালে বি.এ পাস করেন। সমাজকল্যাণ বিভাগে চাকরিতে থাকাকালীন ১৯৬৪-১৯৬৫ সালে কলম্বো প্ল্যান স্কলারশিপ নিয়ে দু’বছরের জন্য নিউজিল্যান্ডে যান। ওয়েলিংটনে ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে সোস্যাল সায়েন্স-এ পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে চাকরিরত অবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে তৎকালীন ইনস্টিটিউট অব সোস্যাল ওয়েলফেয়ার থেকে এম. এ. পাস করেন।
কর্মজীবনে যখন প্রবেশ করলেন, তখনো তাঁর কর্মক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছিলো প্রথমে সরকারের সমাজকল্যাণ বিভাগ। সেখানে সাড়ে আঠারো বছর কাটিয়ে দেন শিশু ও মাতৃমঙ্গলের ন্যায় মানবিক কর্মে। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে শহর সমাজকল্যাণ অফিসার হিসেবে চাকরি আরম্ভ করে ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে ডেপুটি ডাইরেক্টর হিসেবে ‘মাদার্স ক্লাব’ প্রতিষ্ঠা করে ১৯৭৯-তে ইউনিসেফে-যোগ দেন। ইউনিসেফেও তিনি প্রথমে নারী উন্নয়ন কর্মসূচি প্রধান এবং পরে প্রোগ্রাম প্ল্যানিং সেকশনের প্রধান হিসেবে সাড়ে সতেরো বছর নারীর উন্নয়নে কাজ করেন।
এসব কর্মসূচিতে নারীকে উন্নয়নের মূলধারায় সম্পৃক্ত করার ব্যাপারে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। শিশু ও নারীর অধিকার রক্ষার ব্যাপারে তিনি একটি ইনস্টিটিউশন। তিনি আমাদের চট্টগ্রামের গর্ব। তিনি যে উচ্চতায় উপনীত হয়েছেন, চট্টগ্রামের আর কোন নারী সে উচ্চতায় পৌঁছতে পারবেন কিনা সেটা ভেবে দেখার বিষয়। উন্নয়ন সংগঠক হিসেবে তাঁর কৃতিত্ব অনন্যসাধারণ। দেশের দুই প্রধান উন্নয়ন চিন্তাবিদ ও সংগঠক প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস ও স্যার ফজলে হাসান আবেদের সঙ্গে সমপর্যায়ে সম দক্ষতায় তিনি কাজ করেছেন। পরিবার ও স্বামী লেখক, সাংস্কৃতিক সংগঠক, কবি ও ভাষা সংগ্রামী মাহবুব উল আলম চৌধরীর সঙ্গে দাম্পত্য জীবনের সূত্রে তিনি যে মানবিক জীবনবোধ ও সাংস্কৃতিক চেতনা অর্জন করেছেন, সেটাই জওশন আরা রহমাকে অনন্য মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছে। তাঁর জীবন একটি মহৎ মানবিক মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ একটি শুচি, শুভ্র ও সুন্দর সাংস্কৃতিক জীবনের অভিব্যক্তি।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা