মহাসড়কে আবার ফিরেছে ডাকাতি

39

এক সময় মহাসড়কে ডাকাতির ঘটনা নিত্যদিনের বিষয় হলেও হাইওয়ে পুলিশ আসার পর, তা একেবারেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু গত কিছুদিনের মধ্যে আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে ডাকাত চক্র। তারা বাসের মধ্যে যাত্রীবেশে চালক-হেলপারকে জিম্মি করে সবকিছু হাতিয়ে নিচ্ছে। তাই যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রশাসন তৎপর হয়েছে বলে জানা গেছে।
এদিকে মহাসড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে গাড়ি চলাচল বন্ধ রাখা ছাড়া কোনো উপায় নেই বলে জানান চট্টগ্রাম কক্সবাজার টেকনাফ (দক্ষিণাঞ্চল) সড়ক পরিবহন মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদের নেতৃবৃন্দ।
জানা গেছে, গত মাসে চকরিয়ার ফাঁসিয়াখালীতে তিনটি ডাকাতির ঘটনা ঘটে। এরই প্রেক্ষিতে গত শুক্রবার (২৭ নভেম্বর) মধ্যরাত আনুমানিক ৩ টায় পিস্তল, গুলি ও দেশীয় অস্ত্রসহ ডাকাত দলের ৬ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব-৭। গত সোমবার বেলা ১১টায় র‌্যাব-৭ এর চান্দগাঁও কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিষয়টি জানান র‌্যাব-৭ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. মশিউর রহমান জুয়েল।
গ্রেপ্তারকৃত আসামিরা হলো- কক্সবাজারের নাইক্যংদিয়া এলাকার হায়দার আলীর ছেলে ডাকাত সর্দার মো. ইয়াহিয়া জয়নাল (২৬), একই এলাকার ফরিদুল আলমের ছেলে ছলিম উল্লাহ (৩৩), শিয়া পাড়া এলাকার শাহাজাহানের ছেলে ছাবের আহমদ (২৯), দক্ষিণ পাড়া এলাকার হাছন আলীর ছেলে আবুল কালাম (৩০), চকরিয়া থানার খুটাখালী এলাকার শাহ আলমের ছেলে শাহ আমান বাটু (২৮), দক্ষিণ পতেঙ্গা নাজির পাড়া এলাকার মোহাম্মদ বদরুদ্দোজার ছেলে মো. আব্দুল্লাহ (২৫)।
লে. কর্নেল মো. মশিউর রহমান জুয়েল জানান, গত শুক্রবার (২৭ নভেম্বর) মধ্যরাত আনুমানিক ৩ টায় চট্টগ্রাম কক্সবাজার মহাড়কের ফাঁসিয়াখালীতে বাস ডাকাতির ঘটনায় সংশ্লিষ্ট ডাকাতদের গ্রেপ্তারের জন্য র‌্যাব গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে ও ছায়াতদন্ত শুরু করে। ছায়াতদন্তে ডাকাতদের চিহ্নিত করতে সক্ষম হয় র‌্যাব। পরে রবিবার বেলা দেড়টা থেকে ৪টা পর্যন্ত কক্সবাজারে অভিযান চলে। এতে র‌্যাবের উপস্থিতি টের পেয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে ডাকাত সর্দার মো. ইয়াহিয়া জয়নালকে আটক করা হয়। এ সময় তার কাছ থেকে একটি ওয়ান শুটার গান, এক রাউন্ড ৭.৬২ এমএম রাইফেলের বুলেট ও একটি রাম দা উদ্ধার করা হয়। তার দেয়া তথ্য মতে একে একে ছলিম উল্লাহ, ছাবের আহমদ, আবুল কালাম, শাহ আমান বাটু ও মো. আব্দুল্লাহকে আটক করা হয়।
জিজ্ঞাসাবাদে আটক আসামিরা জানায়, তাদের দল গত ৫ ও ১২ নভেম্বর একই এলাকায় আরো দুইটি বাসে ডাকাতি করে। তারা দীর্ঘদিন ধরে কক্সবাজার জেলার চকরিয়া ও সদর থানার বিভিন্ন এলাকায় রাত্রিকালে ছিনতাই ও ডাকাতি করে।
মশিউর রহমান জুয়েল আরও জানান, ৭ জন আসামির মধ্যে ৬ জনকে আটক করা হয়েছে। অন্যজনকে শনাক্ত করা হয়েছে। তাকে গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত থাকবে। গ্রেপ্তারকৃত আসামি ও উদ্ধারকৃত মালামাল পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের নিমিত্তে কক্সবাজারের সংশ্লিষ্ট থানায় হস্তান্তর প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
জানা গেছে, গত ৩ নভেম্বর রাত ৩টায় চকরিয়ার ফাঁসিয়াখালীতে এস. আলম বাসে দুর্ধর্ষ ডাকাতির ঘটনা ঘটে। এছাড়া একই স্থানে গত ৫ নভেম্বর মারছা বাস ও গত ২৭ নভেম্বর সৌদিয়া বাসে ডাকাতি হয়।
সৌদিয়া বাসের যাত্রীরা জানান, বাসে ৩৭ জন যাত্রী ছিলেন। সংঘবদ্ধ সশস্ত্র ডাকাত দল অস্ত্রের মুখে বাসযাত্রীদের জিম্মি করে। এরপর তাদের কাছ থেকে নগদ টাকা, ২০টি মোবাইল ও স্বর্ণালঙ্কার লুটে নেয়। এ সময় দুজনকে গুলিবিদ্ধ করেন ডাকাতরা। এ ঘটনায় চকরিয়া থানায় একটি মামলা দায়ের হয়।
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে পরপর তিনটি পরিবহনে দুর্ধর্ষ ডাকাতি, গুলি ও ছুড়িকাঘাতে যাত্রী ও পরিবহন শ্রমিক আহত, মালামাল লুটের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন চট্টগ্রাম-কক্সবাজার-টেকনাফ (দক্ষিণাঞ্চল) সড়ক পরিবহন মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদের নেতৃবৃন্দ।
তারা বলেন, ডাকাতদের মধ্যে মাত্র কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করলে হবে না, পুরো চক্রটিকে আইনের আওতায় আনতে হবে।
পরিবহন সংশ্লিষ্টরা জানান, পরপর তিনটি ডাকাতি ঘটনার সময় ডাকাত দলের সদস্যরা নগরীর শাহ আমানত সেতু এলাকা থেকে যাত্রীবেশে বাসে উঠেন। রাত ৩টায় যখন চকরিয়া পার হয়, তখন গাড়ির চালককে অস্ত্রের মুখে গাড়িকে ফুলবাড়ি নয়া অফিস এলাকায় নিয়ে যেতে বলে। এরপর চালক ওইস্থানে নিয়ে গেলে ডাকাতরা যাত্রীদের সর্বস্ব লুট করে পালিয়ে যায়। অথচ হাইওয়ে পুলিশ ও থানা পুলিশ টহলরত অবস্থায় থাকলেও চলন্ত গাড়িতে ডাকাত বা ছিনতাইকারী শনাক্ত করা খুবই দুরূহ।
বর্তমানে কক্সবাজার পুলিশ সুপারের নির্দেশক্রমে চকরিয়া প্রবেশের সময় বাস থামিয়ে যাত্রীদের ভিডিও করছে পুলিশ। যা খুবই কার্যকরী মনে করছেন যাত্রীরা। এতে ডাকাত, ছিনতাইকৃত গাড়ি ও ছিনতাইকারীদের দ্রæত শনাক্ত করা যাবে। যাত্রীরা বলছেন, ভিডিও বা ছবি ধারণ করার প্রক্রিয়াটি আরও আগে করা উচিত ছিল।
চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের যাত্রী আবুল কালাম বলেন, আগে ঢাকা থেকে কোন বাসে উঠলে সংশ্লিষ্ট বাস কর্তৃপক্ষ যাত্রীদের ছবি তুলে রাখতেন। যাতে কোন অসুবিধা হলে, তারা সহযোগিতা করতে পারেন। কিন্তু বর্তমানে সেটি তারা আর করেন না, ফলে ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের মত ঘটনা বেড়েই চলেছে। আমার ধারণা, ডাকাত দলের সাথে গাড়ি সংশ্লিষ্ট কেউ জড়িত থাকতে পারে।
চকরিয়ার মালুমঘাট হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ (পরিদর্শক) মোর্শেদুল আলম চৌধুরী বলেন, চলন্ত গাড়িতে ডাকাতি হলে সেটি নির্দিষ্ট করে বলা যায় না, কোন জায়গায় ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার যাওয়ার পথে লোহাগাড়া পার হওয়ার পর বাসগুলোর গতি থাকে ঘণ্টায় ৮০ থেকে ১০০ কি.মি। তাই নির্দিষ্ট কোন এলাকায় ডাকাতি হয়েছে, তা আমরা শনাক্ত করতে পারছি না। তবে আমাদের টহল টিম, পাশাপাশি থানার টহল টিম সবসময় মহাসড়কে অবস্থান করে।
তিনি আরও বলেন, আমার ধারণা রামুর রাবার বাগান এলাকাটি নির্জন এলাকা। সেখানে হয়তো ডাকাতির মত ঘটনা ঘটতে পারে। গাড়ির ভেতরে কে কাকে জিম্মি করলো সেটি আমরা (পুলিশ) বাইরে থেকে বুঝতে পারি না। তবে যেখানে ঘটনা হয়েছে বলে শুনেছি, সেখানকার আওতাধীন থানা অর্থাৎ চকরিয়া থানা মামলা নিয়েছে। বাকিটা তারা তদন্ত করে দেখবেন। এছাড়া কক্সবাজার পুলিশ সুপার মহোদয়ের নির্দেশে চকরিয়াতে একটি চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। সেখানে বাসগুলোকে দাঁড় করিয়ে ছবি ও ভিডিও করে রাখছেন পুলিশ। যাতে অপ্রীতিকর ঘটনা হলে ছবি ও ভিডিওগুলো কাজে আসে।
অন্যদিকে মহাসড়কে ডাকাতির ঘটনায় পরিবহন শ্রমিকদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে বলে জানান আরাকান সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. মুছা। তিনি পূর্বদেশকে বলেন, কয়েকদিনের ব্যবধানে একই স্থানে একই কায়দায় চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারগামী তিনটি নৈশ চেয়ার কোচে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। ডাকাতরা চালক, সুপারভাইজারদের মারধর ও জিম্মি করে যাত্রীদের সর্বস্ব লুট করে নিরাপদে সটকে পড়ে। এসব ঘটনায় শ্রমিকদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। একই সাথে ডাকাতের মারধরের শিকার ও টাকা-পয়সা হারিয়ে নিঃস্ব পরিবহন শ্রমিকদের জিজ্ঞাসাবাদের নামে থানায় এনে ডাকাতের পরিবর্তে শ্রমিকদের আসামি করে কোর্টে চালান করায় আমরা বিস্মিত।
তিনি আরও বলেন, মহাসড়কে যারা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা ও নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছেন, তাদের অবহেলার খেসারত নিরীহ শ্রমিকদের ঘাড়ে চাপিয়ে পরিবহন সেক্টরে অস্থিরতা সৃষ্টি না করে, গাড়ি চলাচল স্বাভাবিক রাখার দাবি জানাচ্ছি। আমরা ডাকাতদের গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং আটক পরিবহন শ্রমিকদের মুক্তির দাবি জানাচ্ছি।
হাইওয়ে পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার (চট্টগ্রাম জোন) শফিকুল ইসলাম বলেন, হাইওয়ে পুলিশ সবসময় তৎপর রয়েছে। তারপরও বিষয়টির বর্তমান অবস্থা কেমন আমি জানি না, জেনে আপনাকে জানাবো।