মহামারি নয় যেন আহামরি!

126

মছিউদ্দৌলা জাহাঙ্গীর

আসলে মহামারি নাম শুনলে যে ভয় পায়না এমন মানুষ প্রচুর আছে পৃথিবীতে। আজকের বিশ্বই তার প্রমাণ। সেনাবাহিনী নামিয়ে মানুষকে দমিয়ে রাখা যাচ্ছে না। অথচ ইতিহাস সম্পর্কে যাদের ন্যূনতম জ্ঞান আছে, বিশেষ করে মহামারির ইতিহাস যারা জানেন তাদের কলিজায় পানি নেই। ইতিহাসের একেক মহামারিতে লাখ লাখ শুধু নয়, কোটি কোটি মানুষ পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে মাত্র দু-চার বছরে। জানা ইতিহাসের মধ্যে মনে হয় চতুর্দশ শতকের ‘বুবোনিক প্লেগ’ যা ব্লাকডেথ নামে পরিচিত, ছিল ভীষণ সাংঘাতিক। ইউরোপ জুড়ে ছিল তার প্রাদুর্ভাব; ১৩৪৭-৫১ এই চার বছরে অন্তত ২০কোটি মানুষ মারা গিয়েছিল সেই মহামারিতে। বলা হয়, ইউরোপের অর্ধেক মানুষ সেই মহামারিতে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল- কি মর্মান্তি! বলতে গেলে সারা ইউরোপে তখন চলছিল মহাপ্রলয়। সেই সময় সারা উত্তর আফ্রিকা ও এশিয়া চষে বেড়াচ্ছিলেন ইবনে বতুতা, বিশ্ববিখ্যাত পর্যটক। আবার মধ্য এশিয়া কাঁপাচ্ছিলেন তখন তৈমুর লং। অবশ্য তখনও কাঁপাচ্ছিলেন না, সবে ডাকাতি শুরু করেছিলেন আরকি। ডাকাতি আর সর্দারী করে শক্তি সঞ্চয় করছিলেন এবং এইভাবে একদিন এক জাহাজে ডাকাতি করতে গিয়ে পায়ে আঘাত লেগে[RTF bookmark start: }_GoBack[RTF bookmark end: }_GoBack খোঁড়া হয়ে যান। আবার কেউ বলেন ভেড়া চুরি করতে গিয়ে হলেন খোঁড়া, হাহাহাহা। সে হতে নাম হয় তৈমুর লং- ফার্সীতে, অর্থ খোঁড়া তৈমুর। আহা ইউরোপ যখন হচ্ছে বিরান এদের তখন নাইকো জিরান, দিগি¦দিক দিচ্ছে উড়ান। রোম যখন পুড়ছিল নীরু তখন বাঁশি বাজাচ্ছিল। আশ্চর্য ইউরোপে এত বড় বিপর্যয় অথচ এশিয়া-আফ্রিকায় তার কোন খবরও নাই, যে যার মত চলছে!
অতএব যতক্ষণ নিজের উপর আসে না ততক্ষণ মানুষ বুঝেনা। এমন কি আসলেও বুঝেনা, যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ, বিপদ কেটে গেলে ভুলে যায়। ইবনে বতুতার বর্ণনায় নানান দেশের নানা কথা এসেছে, কিন্তু ইউরোপের প্লেগের কথা আসেনি। ফলে বুঝা যাচ্ছে তিনি প্লেগ সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না। তাহলে এবার বলুন করোনা নিয়ে আমরা কেমন করে অত সতর্ক হব? তখনকার প্লেগের ন্যায় করোনা তো এখন তত ভয়ঙ্কর নয়। তাই তো জার্মানির ৮৯ বছর বয়সী কার্স্টেন টুচসেন হ্যানসেন এবং ডেনমার্কের ৮৫ বছরের ইনগা রাসমুসেন সাড়া না দিয়ে পারলেন না হৃদয়ের আহ্বানে। দু’বুড়া-বুড়ি দু’দেশের বাসিন্দা, কেমন করে যে পড়ে গেলেন এ ফাঁদে আল্লাহ্ই জানেন। বলে না- প্রেম মানে না জাত-বিজাত, জোয়ান-বুড়া, দেশ-বিদেশ? সেটাই হয়েছে, যেই ভাবেই হোক দুই বছর আগে পরিচয় হওয়ার পর থেকে একে অপরকে না দেখলে থাকতে পারেন না। বুঝুন প্রেমের জোয়ার জোয়ান-বুড়া মানেনা হাহাহা, ফলে নিয়মিত তাঁরা দেখা করেন। ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে যেহেতু ভিসাহীন যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে, দেখা করতে কোন সমস্যাই হত নাতাঁদের। কিন্তু ঝামেলা বাধাল করোনা এসে, তবে বলে না প্রেম কোন বাধা মানে না? উপায় বের করে ফেললেন তাঁরা, সীমান্তে গিয়ে দুজন দুই পারে চেয়ার পেতে বসে খাওয়া-দাওয়া আর গল্প করে দিন পার করেদিচ্ছেন। এ ভয়াবহ সময়েও দুজন বড়ই আনন্দে কাটাচ্ছেন, জিজ্ঞেস করা হলে রাসমুসেন জবাব দিলেন, ‘জানি বিষয়টা খুব খারাপ হচ্ছে, তবে আমরা তো এটা বদলাতে পারবনা।’ ভাবুন কি কথা, হ্যানসেনের দেশের একটি প্রদেশের অর্থমন্ত্রী শেফার অবসাদে দস্তুরমত আত্মহত্যা করলেন করোনার ভয়ে। আর তিনি ডেনমার্কের বুড়ি রাসমুসেনের সাথে চুটিয়ে প্রেম করছেন সীমান্তে, হেহেহে।
এই কূলে আমি আর ঐ কূলে তুমি মাঝখানে নদী ঐ বয়ে চলে যায়Ñ মান্না দে। অথবা দুটি পাখি দুটি তীরে মাঝে নদী বহে ধীরে- তালাত মাহমুদ। গান দুটির সাথে হ্যানসেন আর রাসমুসেনের লাইফ স্টোরি খাপে খাপ মিলে গেছে। ৮৯ বছর বয়সে হ্যানসেনের কি মনোবল, আর তাঁর দেশের অর্থমন্ত্রীর বয়স ছবি দেখে মনে হয় পঞ্চাশও হয়নি, এ বয়সেই তিনি মনের সব শক্তি হারিয়ে ফেললেন। জুলিয়েট বলছে, ‘তুমি কি জান না যে নামে কিছু আসে যায় না- গোলাপকে যে নামেই ডাক, তার সুগন্ধ নষ্ট হয় না?’ তার জানালার নিচ থেকে তখন রোমিও, ‘ঠিকই বলেছ। এখন থেকে রোমিও না বলে ‘প্রিয়তম’ বলে ডেকো আমাকে।’ চমকে উঠে তখন জুলিয়েট জানতে চাইল, ‘ আমাদের বাগানের এতউঁচু পাঁচিল টপকে কিভাবে ভেতরে এলে তুমি?’ রোমিও বলল, ‘কোন বাধাই প্রেমিককে ঠেকাতে পারে না। সাহস থাকলে প্রেমিক যে কোন কাজই করতে পারে।’ জুলিয়েট, ‘তুমি তো জান আমার পরিবারের লোকদের, তোমায় পেলে তারা খুন করে ফেলবে।’ রোমিও, ‘সে ভয় নেই আমার। তোমাকে দেখার জন্য তলোয়ারের আঘাত সইতেও রাজি আমি।’ অনুরূপ থিসবী মশাল জ্বালিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত উন্মত্তা আইডা নদীর তীরে পিরামাসের অপেক্ষায়। পিরামাস মশালের আলো ধরে রাতের আঁধারে সাঁতার কেটে ছুটে আসত প্রেয়সীর পরশ নিতে উত্তাল নদীর অপর পার হতেÑ একেই বলে প্রেম। ফলে রাসমুসেনের আবেদনের সামনে হ্যানসন করোনা আর সীমানাকে কোন বাধা মনে করেন না। বয়স তাঁদের কি দিবে বাধা, হাহাহা?তবে রোমিও-জুলিয়েট এতহিট হল কেন বুঝলাম না। কারণ কাহিনীটি পিরামাস-থিসবী উপাখ্যানের সাথে প্রায় মিল এবং উভয়ের শেষ পরিণতিও এক, ছুরি দিয়েই শেষ। ফলে স্বাভাবিকভাবে মনে হয় শেকসপিয়র নকল করেছেন, যেহেতু পিরামাস-থিসবী তাঁর অন্তত আড়াই হাজার বছর আগের।
আসলে কথায় কথা বাড়ে, তাই কথার নাম লতা। দয়াকরে শেক্সপিয়ার প্রেমিরা আমাকে আড়চোখে দেখবেন না। রোমিও-জুলিয়েট বলি বা লাইলি-মজনু অথবা পিরামাস-থিসবী কিংবা হ্যানসেন-রাসমুসেনÑ প্রেম কোন বাধা মানে না, বয়স মানে না, এমন কি মহামারিও মানে না। কিন্তু বাস্তবে প্রেম নয় শুধু, মানুষের অভ্যাস অনেক কিছু মানেনা। তৈমুর ও বতুতা যখন বিশ্ব দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন তখন তুরস্কে আবার উসমানীয় তথা অটোমান সা¤্রাজ্য প্রতিষ্ঠার তোড়জোড় শুরু হয়েছিল। অথচ ইউরোপ জুড়ে তখন চলছিল মৃত্যুর মিছিল, বøাক ডেথ। আর উসমানের পুত্র অরখান ও আলাউদ্দিন সেখানে সৃষ্টি করলেন ত্রাসের রাজত্ব। ইউরোপীয়দের প্রতি একদিকে চলছিল তখন মহামারির ত্রাস, অপরদিকে উসমানীয়দের সা¤্রাজ্যবাদী ত্রাস। উভয়সংকটে পড়ে তখন তাদের ত্রাহি অবস্থা। আশ্চর্য যে প্লেগের কারণে গোটা ইউরোপ পরিণত হয়েছিল মৃত্যুপুরীতে, তার ক্ষুদ্র একটি ঢেউও এসে লাগেনি এশিয়া-আফ্রিকাতে! এমন কি তুরস্কে পর্যন্ত কোন খবর হয়নি, যদি হত উল্লেখিত ব্যক্তিগণ অমন দাপাতে পারতেন না। করোনাক্রান্ত বর্তমান পৃথিবীর দুর্দশা থেকে বিষয়টি উপলব্ধি করা যায়। প্লেগ তখন যত সংহারি ছিল, সে তুলনায় করোনা এখন অনেক কম সংহারক, তথাপি করোনা গোটা বিশ্বকে নাড়িয়ে দিচ্ছে। তার কারণ যোগাযোগ ব্যবস্থার সহজলভ্যতা। সুলভ যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে দুর্বল করোনা যেখানে গোটাবিশ্বকে নাড়িয়ে দিচ্ছে, দুর্লভ যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে সবল প্লেগ ইউরোপ পেরিয়ে তুরস্কে আঘাত করতে পারেনি। ফলে সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েও মহামারি প্লেগ বাকী বিশ্বের জন্যে তখন আহামরি কিছু হতে পারেনি। অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা’ই তখন পৃথিবীর আশীর্বাদ, এক অঞ্চল হতে অন্য অঞ্চলকে লক ডাউন, কোয়ারেন্টিন বা আইসোলেশন করে রাখত।
বিশ্বে যুগে যুগে অনেক বড় বড় মহামারির সংক্রমণ ঘটেছে। ৫৪১ খ্রি. সংঘটিত জাস্টিনিয়ান প্লেগে প্রায় ৫ কোটি মানুষ মারা গিয়েছিল। ১৫২০ খ্রি. আমেরিকায় স্মলপক্সে ৫.৬০ কোটি মানুষ মারা গিয়েছে। বলা হয়, আমেরিকান আদিবাসীদের প্রায় ৯০% তখন শেষ হয়ে গিয়েছিল। সম্ভবত ইউরোপীয়রা এ কাজ করেছে, আদিবাসীদের শেষ করার জন্য সে রোগের বীজ সেখানে নিয়ে গিয়েছিল। তাদের স্বার্থসিদ্ধি হয়েছে, গোটা মায়া ও ইনকা সভ্যতার পতন ঘটেছে, হেহেহে। ১৯১৮ সালে স্প্যানিশ ফ্লুতে প্রায় ৫ কোটি মানুষ মারা যায়। এটি ভারতেও ছড়ায় এবং পৌনে দুকোটি মানুষ মারা যায়। ইতিহাস বলে বড় বড় মহামারি, যেগুলোতে কোটির উপর মানুষ মরেছে, সব ইউরোপে সংঘটিত হয়েছে। একটি হয়েছে ভারতে ১৯১৮ সালে, তখন ছিল ইংরেজ শাসন এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। তাহলে বুঝা যাচ্ছে মহামারির প্রাদুর্ভাবের জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থা একটি অভিশাপ। কিন্তু কথা হচ্ছে বড় বড় মহামারি সব ইউরোপে কেন সংঘটিত হয়? তবে কি তারা মহামারিকে বেশি অবহেলা করে? অবস্থাদৃষ্টে তো তাই মনেহচ্ছে, এবারের করোনাকে তারা অতি অবহেলা করেছে। আমেরিকানরাও তা করেছে, অবশ্য বর্তমান আমেরিকানরা তো সব ইউরোপীয়ানদের বীজ তাই অভ্যাস সবার একই। মহামারিকে তারা আহামরি কিছু মনে করে না। শুরু থেকে ট্রাম্প করোনাকে তেমন গুরুত্ব দেন নি, অতি কথা বলে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা তিনি খারাপ করে দিয়েছেন। ঠিক তেমন ইউরোপের বিভিন্ন দেশের অবস্থা। অথচ চীন সেহিসেবে অনেক পরিপক্বতার পরিচয় দিয়েছে, তাদেরদেশে উৎপত্তি হলেও তারা কিন্তু লাগাম টেনে ধরতে পেরেছে। মহামারিকে তারা ঠিকই ভেবেছেআহামরি, তাই পেয়েছেসাফল্য তারা রকমারি।
মহামারি যুগে যুগে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে হয়েছিল,ম্যাসাকার বেশী ঘটেছে ইউরোপ ও আমেরিকায়। মনে হয় তারা কোয়ারেন্টিন ও আইসোলেশন ব্যবস্থাকে তেমন গুরুত্ব দিত না। যা করোনার বেলায়ও পরিলক্ষিত হচ্ছে, ফলে যা হওয়ার তা হচ্ছে দলে দলে মানুষ মরছে। বারেবারে তারা মনে করেছে মহামারি নয় কোন আহামরি। অনুরূপ অবস্থা আজ আমাদেরও, মহামারিকে আমরাও আহামরি কিছু মনে করছিনা। কোয়ারেন্টিন, আইসোলেশন কোনকিছু আমরা মানছি না। দুদিন ঘরে থাকলে অস্থির হয়ে উঠি, রাস্তায় বেরিয়ে পড়ি। এস্বভাব আমাদের ত্যাগ করতে হবে। নইলে দেখা যাবে এঅস্থির ভাব এক দিন আমাদের চিরস্থির করে দেবে। দোয়া করি সবাই সুস্থ থাকুন, নিরাপদে থাকুন, শান্তিতে থাকুন, আল্লাহ্ আমাদের রক্ষা করুন, আমিন। আরএ বিপদে একে অপরকে সহযোগিতা করতে হবে। শুনলাম ট্রাম্পের হুমকিতে ভারত হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন রপ্তানি না করার সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে। ভাল হয়েছে, হুমকিকে ভুতে-প্রেতেও ভয় করে। আবার দেখলাম তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে হুমকি দিয়েছেন। স্যার এভাবে সবাইকে হুমকি দিতে থাকলে হিতে-বিপরীত হবে। ঐ শুনুন করোনা নিয়ে রাজনীতি করতে নিষেধ করছে, হেহেহেহে। তবে এত হতাশার মাঝেও মার্কিন বিজ্ঞানীরা আশার আলো দেখাল। তারা নাকি মানব শরীরে করোনার বিস্তার রোধক একটি বড়ি বানাতে সক্ষম হয়েছেÑ আল্লাহ্ কবুল করুন, আমিন।

লেখক : কলামিস্ট