মহান স্বাধীনতা দিবসের অঙ্গীকার হোক মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার

13

আজ মহান স¦াধীনতা দিবস। বাঙালির বাঙালির সবচেয়ে বড় অর্জন এ স্বাধীনতা। ইতিহাসের পথপরিক্রমায় আমরা লাভ করেছি একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর হতে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালিদের দমনে সর্বাত্মক শক্তি প্রয়োগ করতে শুরু করেছিল। কিন্তু স্বাধীন-স্বকীয়তায় বিশ্বাসী বাঙালি কোনকালেই পরাধীনতার শৃঙ্খলায় থাকতে প্রস্তুত ছিল না। ফলে পাকিস্তান শাসকদের বাংলা ভাষা বিরোধী প্রথম আঘাত সাহসের সাথে প্রতিরোধ করেছিল। এরপর বাঙালি থেমে থাকেনি ১৯৫২ থেকে শুরু হওয়া এ আন্দোলন সর্বমেষ ’৬৯-এর গণআন্দোলনে রূপ নেয়, এরপর ’৭০-এর নির্বাচন- যার মধ্য দিয়ে বাঙালি সন্ধান পায় তার গন্তব্যের। ক্রমাগত আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে বাঙালি উপস্থিত হয় মাহেন্দ্র বর্ষ ১৯৭১-এ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালি তখন জেগে ওঠে মহাবিক্রমে। সমগ্র জাতির চোখ তখন ওই এক তর্জনীর দিকে। বঙ্গবন্ধুর দিকনির্দেশনা নক্ষত্রের মতোই জাতিকে পথ দেখায়, ১৯৭১-এর ৭ মার্চ জাতির চাওয়া ভাষা পেলো সেই ভাষণে, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এরপর মুক্তিপাগল মানুষ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার চূড়ান্ত প্রস্তুতি শুরু করে।
১৯৭১-এর ২৫ মার্চের বিভীষিকাময় রাতে পাকিস্তানি বাহিনী অস্ত্রের মুখে স্তব্ধ করে দিতে চাইলো বাঙালি জাতির স্বাধীনতার আকাক্সক্ষাকে। কিন্তু না, পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তুললো বাঙালি। ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার মধ্য দিয়ে শুরু হলো ‘যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে’ মুক্তিযুদ্ধ। দীর্ঘ ৯ মাসের সেই যুদ্ধ- তার কত চরিত্র-পার্শ্বচরিত্র, কত ঘটনা-উপঘটনা- মহাকাব্যের বিশালতাকেও হার মানায়। ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হলো, সম্ভ্রম হারালো ২ লাখ মা-বোন। অবশেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত মিত্রবাহিনীর কাছে পরাজয় মেনে নিতে বাধ্য হলো পাকিস্তানি বাহিনী। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে এবং ত্যাগ, তিতিক্ষার মাধ্যমে অর্জিত হলো আমাদের মহান স্বাধীনতা। কিন্তু ইতিহাসের নির্মম অধ্যায় হলো- স্বাধীনতা লাভের মাত্র সাড়ে ৩ বছরের মাথায় পরাজিত গোষ্ঠী মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়। জেলখানায় হত্যা করা হয় জাতীয় ৪ নেতাকে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধগুলোর মূলে শুরু হয় কুঠারাঘাত। যে প্রত্যয় নিয়ে যুদ্ধ করে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালি জাতি স্বাধীন আবাসভূমি গড়েছিল সেখানে শুরু হয় অপশক্তির নতুন চক্রান্ত। কয়েক দশক ধরে স্বাধীনতার ইতিহাস নানাভাবে বিকৃত করা হয়। নতুন প্রজন্মের সামনে মুক্তিযুদ্ধের ভুলপাঠ হাজির করা হয় ইতিহাস-চেতনা বঞ্চিত একটি প্রজন্ম গড়ে তোলার লক্ষ্যে। আশার কথা, এসবে বিভ্রান্ত না হয়ে নিজের গরজেই তরুণরা বাংলাদেশের শিকড়ের সন্ধান করেছেন। ইতিহাসকে জেনে, ইতিহাসের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তারাই সবার আগে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও উপযুক্ত শাস্তির দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন। আগামী দিনেও মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাসের সামনে দাঁড়িয়ে তারাই দেশকে নেতৃত্ব দেবেন, এ আশা এখন বাস্তব। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এ চেতনা অব্যাহত থাকলে সেটি হবে মুক্তিযুদ্ধের শ্রেষ্ঠ অর্জন। বর্তমানে বাংলাদেশকে সা¤প্রদায়িকতামুক্ত, স্বাধীনতার চেতনায় উজ্জীবিত, গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল একটি দেশ হিসেবে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন। একাত্তরের এ দেশীয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রায় শেষের দিকে। মূল হোতারা প্রায় ফাঁসিতে ঝুলেছে। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের রাজনীতি নিষিদ্ধের আইনগত প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত। সংবিধানের মূল চেতনায় প্রত্যাবর্তন ঘটছে দেশ। উগ্র সা¤প্রদায়িক রাজনীতি অবসানের মাধ্যমে নতুন সম্ভাবনার দিকে যাত্রা করছে স্বাধীন এ বাংলাদেশ। এখন সত্যিকার সোনার বাংলাদেশ হিসাবে গড়ে উঠার অপেক্ষায়।
আমরা বলতে চাই, ইতিহাসের এমন একটি সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে বাঙালিকে স্বাধীনতার মর্মবাণীই পুনরুচ্চারণ করতে হবে। স্বাধীনতা মানে শুধু পরাধীনতা থেকে মুক্তি নয়। স্বাধীনতা হলো স্বাধীন রাষ্ট্রে সার্বভৌম জাতি হিসেবে মাথা তুলে থাকার সব আয়োজন। যেদিন দেশের আপামর জনগণ প্রকৃত অর্থে গণতান্ত্রিক পরিবেশে নিজেদের নাগরিক অধিকার নিয়ে মাথা উঁচু করে বাস করতে পারবে, সেদিনই স্বাধীনতাকে পরিপূর্ণ সফল বলে মনে করা যাবে। স্বাধীনতার ৫২তম বছরপূর্তির এ সময়ে আমাদের সংকল্প হোক আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসা¤প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল, সাম্যমৈত্রীর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়বোই প্রতিক্রিয়াশীলতার সব বাধাকে প্রতিহত করে।