মহানবি হযরত মোহাম্মদ (সঃ) এর শিশুকাল

63

 

মক্কা এক রহস্যময় নগরী। এ নগরের সাথে অসংখ্য মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা জড়িত। এটা চোখ জুড়ানো কোনো শহর ছিলো না, সেখানে জাঁকজমকপূর্ণ মনোরম প্রাসাদ ছিলো না। এটা সুবিস্তৃত রাজকীয় এমন কোনো রাজধানীও নয় যে তার বীর সেনারা প্রতিবেশী জাতিকে তাদের অধীনতা মেনে নিতে বাধ্য করেছিলো। এ শহর প্রতিষ্ঠিত হয় বিশ্বের একটি অত্যন্ত শুষ্ক ও পরিত্যক্ত জায়গায়। একটা সময় এই নগরের ব্যবসা বাণিজ্য চলতো মরুপথে, উটের সহযোগিতায়। এ নগর সম্পদশালী বা শক্তিশালী নগর না হওয়া সত্তে¡ও বিশ্বের অনেক সম্পদশালী নগরের চেয়েও এ নগরের গুরুত্ব অনেক বেশি। এ নগরী বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্মভূমি এবং এখানেই আছে মহান আল্লাহর পবিত্র কা’বা ঘর। আয়তাকার বিস্তৃত আঙিনার মাঝখানে রেশমি কালো কাপড়ে সোনালী রংয়ের সুতায় বোনা নকশা(কোরআনের আয়াত) করা চারিদিকে ঢাকা ঘনক্ষেত্র বিশিষ্ট এই ঘরের নামই কা’বা ঘর। আদি পিতা হযরত আদম (আ.) প্রথম কাবা ঘর নির্মাণ করেন। একসময় বন্যায় এ ঘর নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর একই ভিত্তির উপর হযরত ইব্রাহিম (আ.) তাঁর পুত্র হযরত ইসমাঈল (আ.) কে সাথে নিয়ে এ ঘর পুনরায় নির্মাণ করেন। তখন থেকেই বহুবার মেরামত করা হলেও এখন পর্যন্ত এ ঘরের সীমানা এবং আকার অপরিবর্তিতই আছে।
আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (স.) ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ সোমবার সুবেহ সাদিকের সময় মা আমিনার ঘর আলোকিত করে দুনিয়াতে শুভাগমন করলেন। তাঁর জন্মের আগেই তাঁর পিতা আব্দ্ল্লুাহ্ মৃত্যুবরণ করেন। সে সময় মক্কার অস্বাস্থ্যকর আবহাওয়ার কারণে শিশুদের লালন-পালনের দায়িত্ব দেয়া হতো বেদুঈন ধাত্রীদের কাছে। হযরত মোহাম্মদ (স.) এর জন্মের কিছুদিন পর বনি সা’দ গোত্রের প্রায় ১২ জন মহিলা দুগ্ধপোষ্য শিশুর খোঁজে মক্কায় উপস্থিত হলেন। তাঁদেরই একজন বিবি হালিমা, যাঁর উপর অর্পিত হলো হযরত মোহাম্মদ (স.) কে লালন-পালনের দায়িত্ব।
বছরটা ছিলো ঘোর অন্ধকারময় আর সবখানেই ছিলো অভাব। মা হালিমা এবং তাঁর স্বামী হারিস বিন আব্দুল ওজ্জা মানসিকভাবে খুবই বিপর্যস্ত ছিলেন। তাঁরা ঠিক করলেন মক্কায় গিয়ে দুগ্ধপোষ্য শিশু খুঁজে আনবেন। সেজন্যই একটি কাফেলার সাথে যুক্ত হয়ে অন্যান্যদের সাথে তাঁরা দুগ্ধপোষ্য শিশুর খোঁজে মক্কার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছিলেন। যে গাধার পিঠে সওয়ার হয়ে তাঁরা যাত্রা শুরু করেছিলেন সেটা এতো শীর্ণকায় ছিলো এবং ক্লান্তিতে এতো দুর্বল হয়ে পড়েছিলো যে তার রাস্তায় পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হলো। ওদিকে তাঁদের বাচ্চাটাও সারারাত ক্ষুধার জ্বালায় কান্না করছিলো। সেই রাতে তাঁরা একদম ঘুমাতে পারলেন না। বাচ্চার ক্ষুধা নিবৃত্ত করার মত দুধও মা হালিমার ছিলো না। তখন তাঁরা হতাশ হয়ে পড়লেন। এই কষ্টের অবস্থায় কোনো দুগ্ধপোষ্য শিশু হয়তো পাওয়া যাবে না। কাফেলার অন্যান্যদের চেয়ে অনেক পরে তাঁরা মক্কায় পৌঁছলেন। এরইমধ্যে অন্যান্য সব মায়েরা নবজাতকের লালন-পালনের দায়িত্ব পেয়ে গেছেন। কেবলমাত্র একটি শিশু বাকি রইলো। সেই শিশুটি ছিলো হযরত মোহাম্মদ (স.)। হযরত মোহাম্মদ (স.) এর পিতা বেঁচে ছিলেন না। তাঁর পরিবার উচ্চবংশীয় হলেও ধনী ছিলেন না সেজন্য কোনো ধাত্রী শিশুটিকে নিতে আগ্রহী হলেন না। কিন্তু বিবি হালিমার মনে শিশুটির প্রতি গভীর মায়া ও মমতা জেগে উঠলো। তখন তিনি তাঁর স্বামীকে বললেন, আমার এই শিশুটিকে নিতে খুবই ইচ্ছে হচ্ছে। যদিও এর থেকে আমাদের তেমন কিছু পাওয়ার নেই। তখন তাঁর স্বামীও রাজি হলেন। তিনি বললেন, ‘আমার মনে হয় না যে তুমি ভুল বলছো, হয়তো এই শিশুটির কারণে আমাদের উপর একাধিকবার আল্লাহর রহমত নাজিল হতে পারে’। তখন মা হালিমা ঘুমন্ত শিশুটির দিকে দৌড়ে গিয়ে শিশুটির সুন্দর ছোট বুকে হাত রাখলেন তখনই সে শিশু চোখ খুলে হাসলো, তাঁর চোখ থেকে আলো বিচ্ছুরিত হলো, মা হালিমা শিশুটিকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে কোলে তুলে নিলেন। তারপর যেখানে তাঁদের কাফেলা তাবু খাটিয়েছিলো সেখানে ফিরে গেলেন। মা হালিমা অবাক হয়ে দেখলেন শিশুটি তার ক্ষুধা নিবারণের জন্য যথেষ্ট দুধ পান করতে পারলো এবং তাঁর দুধ ভাইও যথেষ্ট দুধ পান করলো। তাঁরা আরো বেশী বিস্মিত হয়ে গেলেন যখন দেখলেন সকাল থেকে তাঁদের যে উটের বাঁটে দুধ ছিলোনা সে উটের বাঁট গুলো দুধে পরিপূর্ণ হয়ে গেলো। মা হালিমার স্বামী উটের বাঁট থেকে দুধ দোহন করলেন এবং তাঁরা পরম তৃপ্তির সাথে সেগুলো পান করে রাতের ছায়ায় ঘুমিয়ে পড়লেন। অনেকদিন পরে তাঁরা ভালো ঘুমালেন। ঘুম থেকে জেগে মা হালিমার স্বামী বললেন, ‘হালিমা তুমি এক অসাধারণ শিশুকে পোষ্য রূপে গ্রহণ করেছো’। শিশু মোহাম্মদ (স.) কে সাথে নিয়ে তাঁরা গাধার পিঠে সওয়ার হলেন। গাধাটি দ্রæতগতিতে চলতে শুরু করলো এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই কাফেলার সবাইকে পিছনে ফেলে এগিয়ে গেলো। তখন কাফেলার অন্যান্যরা সবাই অবাক হয়ে গেলো আর ভাবতে লাগলো, ‘গাধাটির এমন কি হলো, যা সম্পর্কে আমরা কোনো ধারণাই করতে পারছিনা’। অত্যন্ত খুশি মনে অবশেষে তাঁরা শিশু হযরত মোহাম্মদ (স.) কে বনি সাদ গোত্রে নিজেদের ঘরে নিয়ে গেলেন। শিশু মোহাম্মদ (স.) কে তাঁদের কাছে নিয়ে যাওয়ার পর থেকেই খরাপীড়িত সেই গোত্রে অনেক পরিবর্তন শুরু হলো। তাঁদের ভেড়াগুলো সতেজ হয়ে উঠলো, সব রকমের অভাব দূর হয়ে গেলো। তাঁদের বাড়িঘর কল্যাণ ও প্রাচুর্যে ভরে উঠতে লাগলো। শিশু হযরত মোহাম্মদ (স.) এর আচরণে অসাধারনত্ব প্রকাশ পেলো। মাত্র নয় মাস বয়স থেকেই তিনি এতো সুন্দর করে সাবলীল ভাবে কথা বলতেন যে, তা সবার হৃদয় স্পর্শ করতো। তিনি কখনো অপরিষ্কার থাকতেন না এবং কখনো চিৎকার করে কাঁদতেন না। রাতে কখনো ঘুম না এলে মা হালিমা শিশু মোহাম্মদ (স.)কে তাবুর বাইরে নিয়ে যেতেন। তখন তিনি আকাশের তারকারাজির দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেন এবং ভীষণ আনন্দিত হয়ে উঠতেন। আকাশের অপরূপ দৃশ্য গুলি দেখতে দেখতে এক পর্যায়ে ক্লান্ত হয়ে তিনি ঘুমিয়ে পড়তেন। তাঁর বয়স ২ বছর হলে মা হালিমা দুধ খাওয়া ছাড়ালেন এবং পূর্ব প্রতিশ্রæতি অনুযায়ী তাঁকে তাঁর মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিতে গেলেন। মা আমিনা তাঁকে পাওয়ার জন্য উদগ্রীব ছিলেন এবং প্রতীক্ষায় ছিলেন। কিন্তু ধাত্রী মায়ের জন্য এটা ছিলো অনেক বেশি অসহনীয় বিরহের ও বেদনাদায়ক। মক্কা নগরীতে পৌঁছে মা হালিমা বিবি আমিনার কাছে মিনতি জানিয়ে বললেন, ‘দেখুন বাদিয়ার আলো বাতাসে আপনার বাচ্চা কি সুন্দর সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয়েছে, এখন যেহেতু সে হাঁটতে শিখেছে বাদিয়ায় থাকলে তাঁর জন্যে আরো ভালো হতো। তাছাড়া মক্কার আলো-বাতাস শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এবং মারাত্মক। আপনার চোখের সামনে সে শুকিয়ে যাবে তখন আপনি আমার কথা ভাববেন, তখন তো অনেক দেরি হয়ে যাবে’।
সন্তানের প্রতি মা হালিমার এতো এতো ভালোবাসা ও মায়া-মমতা দেখে এবং তাঁর স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে বিবি আমিনা শিশু মোহাম্মদ (স.) কে মা হালিমার সঙ্গে আবারও বাদিয়ায় পাঠিয়ে দিলেন। তাঁর করুণাময়ী, মমতাময়ী ধাত্রী মা হালিমা তাঁকে আদরে জড়িয়ে ধরে কোলে নিয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে বাদিয়ায় নিজ বাড়িতে ফিরে এলেন। এখানেই মরুপ্রান্তরে ঢেউ খেলানো বালুর কার্পেটে শিশু হযরত মোহাম্মদ (স.) হাঁটতে শিখলেন। এখানেই তিনি আনন্দের সাথে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে নিতেই বড় হতে লাগলেন। তিনি নক্ষত্রখচিত আকাশের গভীর নীল তাবুর নিচে ঘুমিয়ে পড়তেন। মরুভূমির নির্মল বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে নিতে তার বক্ষদেশ স্ফীত হয়ে উঠলো। যাযাবরদের পুষ্টিকর খাদ্য খেয়ে শিশুটি সুপুষ্ট হয়ে বড় হতে লাগলো। তাঁর খাদ্য তালিকায় ছিলো দুধ, পনির, খেজুর, সেঁকারুটি, উট ও ভেড়ার মাংস। যখন তিনি অন্যান্য যাযাবর বালকদের দলে মিশে পাহাড়ের উপরে ভেড়া চড়ানোর দৃশ্যাবলী দেখতেন তা তাঁকে অনেক আনন্দ দিতো। যদিও তিনি চিন্তাভাবনা বেশি করতে পছন্দ করতেন তবুও তাঁর সমবয়সী দুরন্ত বেদুঈন বালকদের সাথে কখনো একমত হতে পারতেন না। তিনি তাদের কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতেন এবং তাবুর নিকটবর্তী নির্জন জায়গায় বসে চিন্তামগ্ন থাকতেন। এই পরিবেশ তাঁকে দৈহিক ও আত্মিক শক্তি জুগিয়ে ছিলো। যা পরবর্তীতে বহু কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে তাঁকে অনেক সাহায্য করেছিলো। অনেক আনন্দের সাথে হযরত মোহাম্মদ (স.) তাঁর ছোটবেলার কথা স্মরণ করতেন। তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘আল্লাহপাক আমাকে দুটি অমূল্য নেয়ামত দান করেছেন, তার মধ্যে একটি হচ্ছে মক্কার সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করা এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে সমগ্র হিজাজের সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর অঞ্চল বনি সাদ গোত্রে প্রতিপালিত হওয়া’।
একদিন সকালবেলা হযরত মুহাম্মদ (স.) তাঁর দুধ ভাইকে সাথে নিয়ে তাদের পিতার পশুর পাল কে পাহাড়ে চরানোর জন্য বের হলেন। দিনের মাঝামাঝি সময়ে শিশু মুহাম্মদ (স.) এর দুধভাই হঠাৎ দৌঁড়ে বাড়ি ফিরে এলেন এবং ভীত সন্ত্রস্ত্র স্বরে চিৎকার করে মা-বাবাকে ডেকে বললেন, ‘তোমরা তাড়াতাড়ি এসো, আমার কুরাইশী ভাইকে সাদা কাপড় পরা দু’জন লোক মাটিতে শুইয়ে তার বুক চিরে দু’ভাগ করে ফেলছে’। একথা শুনে মা হালিমা ও তাঁর স্বামী যথাশক্তি দিয়ে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে মোহাম্মদ (স.) কাছে পৌঁছলেন। সেখানে তাঁরা শিশু মোহাম্মদ (স.) কে পাহাড়ের উপর বসে থাকতে দেখলেন। তাঁকে খুব শান্ত দেখাচ্ছিলো কিন্তু তাঁর মুখ কেমন যেনো বিবর্ণ দেখাচ্ছিলো। তারা তাকে আদর করে একের পর এক প্রশ্ন করতে লাগলেন, ‘বাছা, তুমি কি অসুস্থ বোধ করছ? তোমার ভাগ্যে কি ঘটেছিলো? শিশু মোহাম্মদ (স.) এসব প্রশ্নের উত্তরে বললেন, আমি যখন মেষপালের দিকে মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করছিলাম সে সময় সাদা কাপড় পরা দু’জনের আবির্ভাব ঘটলো। তাদেরকে আমি প্রথমেই দুটো বড় পাখি মনে করেছিলাম। কাছে আসতে ভুল ভাঙলো। তারা ধবধবে উজ্জ্বল সাদা পোশাক পরিহিত ছিলেন। তাদের মধ্যে একজন আমাকে দেখিয়ে অন্য জনকে জিজ্ঞাসা করলেন, এই কি সেই বালক? অন্যজন বললেন, হ্যাঁ এই সেই বালক । যখন আমি ভয় পেয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম, তখন তারা জোর করে ধরে আমাকে শুইয়ে দিয়ে বুক চিরে ফেললেন, তারপর তারা আমার হৃদপিÐ থেকে জমাটবাঁধা এক কালো রক্তপিÐ বের করে দূরে ফেলে দিলেন। তারপর তারা আমার বুক বন্ধ করে দিয়ে চলে গেলেন। এ ঘটনা সম্বন্ধে পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ পাক বলেন, ‘আমি কি তোমার বক্ষ প্রশস্ত করিনি এবং তোমার মধ্য থেকে তোমার ভার লাঘব করিনি, -যে ভার তোমার পৃষ্ঠকে অবনত করেছিল? আমি তোমার জন্যে তোমার মর্যাদাকে মহিমান্বিত করেছি’। এ ঘটনার পর থেকেই মোহাম্মদ (স.) এর পালক মা-বাবা তাঁকে নিয়ে চিন্তাপূর্ণ অবস্থায় দিন কাটাতে লাগলেন। তাঁরা তাঁকে নিয়ে ভয় পাচ্ছিলেন যে, যে শিশুটি তাঁদের জন্য সৌভাগ্য বহন করে এনেছে তাঁকে নিশ্চয়ই প্রতিবেশীদের মধ্যে কেউ ঈর্ষান্বিত হয়ে যাদু-টোনা দ্বারা অসুস্থ করেছে। তাই আরো খারাপ কিছু ঘটার আগেই তারা তাকে তাঁর পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিতে চাইলেন। অনিচ্ছা সত্তে¡ও মা হালিমা শিশু মোহাম্মদ (স.) কে চার বছর বয়সে মা আমিনার কাছে ফিরিয়ে দিতে যাচ্ছিলেন। যাওয়ার সময় পথমধ্যে অনেক লোকের ভিড়ে হযরত মোহাম্মদ (স.) হারিয়ে গেলেন। অনেক খোঁজাখুঁজির পর তাঁকে ফিরে পেলে তাঁর দাদা আবদুল মুত্তালিব তাঁকে সস্নেহে জড়িয়ে নিলেন এবং নাতিকে ফিরে পাওয়ার আনন্দে কয়েকটি ভেড়া ও দুম্বা জবাই করে নগরীর গরিব-দুঃখীদের মাঝে সেই সব পশুর মাংস বিতরণ করলেন এবং নাতিকে কাঁধে তুলে দ্রুত পদক্ষেপে ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী কা’বা ঘরের চারপাশে প্রদক্ষিণ করে মহান আল্লাহর নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন।
নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণার মাঝে থাকা মা হালিমা এবং শিশু মোহাম্মদ (স.) কে দাদা আবদুল মুত্তালিব মা আমিনার কাছে নিয়ে গেলেন। স্নেহশীলা মমতাময়ী মা খুশিতে আত্মহারা হয়ে হালিমা কে জিজ্ঞেস করলেন, এর আগে আপনি আমার সন্তানকে কাছে রাখার জন্য অনেক আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। এখন এমন কি ঘটেছে যে আপনি তাকে আমার কাছে ফেরত নিয়ে এসেছেন? মা হালিমা
বললেন, আমার মনে হয় সে এখন বড় হয়েছে তাই আমি আগের চেয়ে তার জন্য হয়তো বেশি কিছু করতে পারবোনা। কোনো দুর্ঘটনার ভয়ে আমি তাকে আপনার কাছে ফেরত এনেছি। যাতে আপনার চোখের সামনে সে বড় হতে পারে। এরপরেও মা হালিমার মুখমÐলে বিষণ্নতার ছাপ দেখে মা আমিনা জিজ্ঞেস করলেন, তাকে ফেরত দেওয়ার ব্যাপারে আপনি কি কিছু গোপন করছেন? আমাকে সবকিছু খুলে বলুন। মা হালিমা মনে করলেন তাঁকে এখন সবকিছু খুলে বলা দরকার। তখন তিনি মা আমিনার কাছে ঘটনাটি খুলে বললেন। মা আমিনার মন দারুণভাবে আহত হলো। তখন তিনি বললেন, আপনার কি ধারণা যে আমার ছেলে শয়তানের প্রভাবে পড়েছে? মা হালিমা বললেন, আমি সে ভয়ই করছি। তখন মা আমিনা বললেন, জেনে রাখুন শয়তানের কোনো ক্ষমতা নেই তাঁর ক্ষতি করার। কারণ এক গৌরবময় ভবিষ্যৎ তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে। তখন মা আমিনা শিশু মুহাম্মদ (স.) মায়ের গর্ভে থাকাকালীন বিভিন্ন রকম অবস্থার অলৌকিক ঘটনাগুলো মা হালিমাকে জানালেন। এরপর মা আমিনা মা হালিমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে পুরস্কৃত করে তাঁর শিশু মোহাম্মদ (স.) কে গভীর মাতৃস্নেহে সুস্বাস্থ্য ও মুক্ত বাতাসে শক্তিশালী জীবন গঠন করার জন্য তৈরি হলেন। তখন নগরীর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের জন্যে আর ভয় ছিলো না।
স্নেহময়ী মায়ের আদরে শিশু মোহাম্মদ (স.) এক সুন্দর ও বুদ্ধিমান বালক রূপে বড় হতে লাগলেন। কিন্তু মায়ের স্নেহ ও ভালোবাসা তিনি বেশিদিন ভোগ করতে পারেননি। শিশু মোহাম্মদ (স.) কে সাথে নিয়ে মক্কা ফেরার পথে মদিনা থেকে কিছু দূরে ‘আল আবওয়া’ নামক স্থানে অসুস্থ হয়ে পড়লেন এবং সেখানেই অবস্থানকালে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই মা আমিনা ইন্তেকাল করেন। এরপর শিশু মোহাম্মদ (স.) কে তাঁর দাদা আবদুল মুত্তালিব অত্যন্ত আদর স্নেহ ও যত্ন করে বড় করতে লাগলেন। নাতির প্রতি ছিলো তাঁর অগাধ স্নেহ-ভালোবাসা। তিনি বলেন, ‘সে-ই তো আমার বৃদ্ধকালের আনন্দ, সে নিশ্চয়ই একদিন উচ্চ পদমর্যাদার অধিকারী হবে, যে পদমর্যাদা কোন আরবিয়ের কপালে এযাবৎ জোটেনি’ এ ধরনের কথা বলার সময় তিনি শিশু মোহাম্মদ (স.) কে তাঁর পাশে বসিয়ে ও কাঁধে হাত বুলিয়ে আদর সোহাগ করতেন। ভালোবাসার আতিশয্যে বালক মোহাম্মদ (স.) বাক্যহারা হয়ে যেতেন। কিন্তু হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর ভাগ্যে তাও বেশি দিন স্থায়ী হলো না। তাঁর দাদাও ইন্তেকাল করেন। এই অনাথ শিশু মোহাম্মদ (স.) কে লালন-পালনের দায়িত্ব তাঁর চাচা আবু তালিব গ্রহণ করলেন। দাদা আবদুল মুত্তালিব তাঁর মৃত্যুর আগেই এই সহযোগিতার জন্য চাচা আবু তালিব কে নির্বাচিত করে রেখেছিলেন। কারণ, চাচাদের মধ্যে আবু তালিব একমাত্র ব্যক্তি যিনি শিশু মোহাম্মদ (সা.) কে অনেক বেশি স্নেহ করতেন।
লেখক: ডিওএইসএস, চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট, বায়েজিদ, চট্টগ্রাম