মসলার দাম লাগামহীন সবজির বাজারে আগুন

128

কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে একটি অসাধু সিন্ডিকেট অস্থির করে তুলছে মসলার বাজার। গত কয়েক মাস ধরে ক্রমে বাড়ানো হয়েছে পেঁয়াজ, আদা-রসুন, এলাচি, দারচিনি ও চিকন জিরাসহ বেশ কিছু মসলার দাম। তবে ১৫ দিনে অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে এগুলোর দাম। এক সপ্তাহের ব্যবধানে পণ্য ভেদে দাম বেড়েছে কেজি প্রতি ২০ থেকে ৬৫০ টাকা পর্যন্ত। সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে আমদানিকৃত এলাচের। এ ছাড়া পেঁয়াজ, আদা, রসুন, শুকনা মরিচ, জিরা, দারুচিনি ও জত্রিকসহ প্রায় সব মসলা পণ্যের বাজার ঊর্ধ্বমুখী। আমদানিকারকরা বলছেন, অগ্রিম কর বৃদ্ধি, বুকিং রেট বেড়ে যাওয়া, বৃষ্টিতে সরবরাহ কমে যাওয়া এবং নষ্ট হওয়ার কারণে পেঁয়াজ-রসুনসহ মসলার দাম বেড়ে গেছে।
অপরদিকে বাণিজ্যমন্ত্রী বলছেন, আগামী ১৫ দিনের মধ্যে পেঁয়াজ, রসুনের দাম কমে স্বাভাবিক অবস্থায় আসবে। এদিকে হঠাৎ সবজির বাজারও চড়া।
জানা যায়, কয়েকমাস আগে থেকে মসলার দাম বাড়তে শুরু করলেও কয়েকদিন ধরে তা ব্যাপকহারে বেড়েছে। কোরবানির ঈদের সুযোগে দাম বাড়িয়ে দিয়েছে পাইকার ও খুচরা দোকানিরা। এক সপ্তাহের ব্যবধানে কোনো কোনো মসলার দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। পেঁয়াজ, রসুন, হলুদ, এলাচ, আদা, মরিচ ও ধনিয়াসহ বহু মসলাপণ্যের চাহিদার সিংহভাগ আগে দেশীয় উৎপাদনের মাধ্যমেই পূরণ করা হতো। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে উৎপাদন মৌসুমে দেশীয় মসলাপণ্যের দাম কমে যাওয়ায় কৃষকদের লোকসান গুনতে হয়। এতে মসলা উৎপাদনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন অনেক কৃষক। ফলে চাহিদা মেটাতে ব্যবসায়ীদের মধ্যে মসলাপণ্যে আমদানি-নির্ভরতা বাড়ছে।
নগরীর রিয়াজউদ্দিন বাজার, টেরিবাজারসহ কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা যায়, আদা, রসুন ও পেঁয়াজের দাম উর্ধ্বমুখি। এক সপ্তাহও আগে রসুনের দাম ছিল কেজি প্রতি ১০০ থেকে ১১০ টাকা। বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ১৬০ টাকায়। কেজিতে দাম বেড়েছে ৫০ থেকে ৬০ টাকা। কোনো কোনো বাজারে এরও বেশি দামে বিকিকিনি হচ্ছে। পাইকারিতে পেঁয়াজের দাম ছিল ১৮-২২ টাকার মধ্যে। এর মধ্যে দফায় দফায় বেড়ে বর্তমানে পেঁয়াজের দাম ঠেকেছে ৩৫ টাকায়। ভারতের নাসিক পেঁয়াজ গত সপ্তাহের চেয়ে ৫-৭ টাকা বেড়ে প্রতিকেজি ৩১ থেকে ৩২ টাকায়, ছোট আকারের কানপুর বা ইন্দুরি পেঁয়াজ ২২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দুই সপ্তাহ আগে বাজারে আদা বিক্রি হয়েছে ৯০ টাকায়। কেজিতে ২০-২৫ টাকা বেড়ে বর্তমানে ১১০-১১৫ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে।
খাতুনগঞ্জের মসলার আড়ত ও পাইকারি দোকান ঘুরে দেখা গেছে, বর্তমানে প্রতিকেজি আমদানিকৃত এলাচ বিক্রি হচ্ছে ২২৫০-২৩০০ টাকায়, যা এক সপ্তাহ আগেও ১৭০০-১৮০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিপ্রতি দাম বেড়েছে ৫৫০ থেকে ৬৫০ টাকা। এক সপ্তাহ ধরে প্রতিকেজি জত্রিক বিক্রি হচ্ছে ২২৫০-২৩০০ টাকায়। আগে বাজারে পণ্যটির দাম ছিল ১৯০০-২০০০ টাকা। প্রতি কেজিতে দাম বেড়েছে ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকা। পাইকারি পর্যায়ে প্রতিকেজি আমদানিকৃত দারুচিনি বিক্রি হচ্ছে ৩৪০-৩৭০ টাকা। অথচ কয়েকদিন আগেও বাজারে একই মানের দারুচিনি প্রতিকেজি বিক্রি হয়েছে ২৫০-২৭০ টাকা। একইভাবে প্রতিকেজি ভারতীয় জিরা কেজিতে ৩০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৩১০-৩২০ টাকা। তুরস্ক ও সিরিয়া থেকে আমদানি করা জিরা বিক্রি হচ্ছে ৩৬০ টাকায়।
আমদানিকারকরা বলেছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে মসলাপণ্যের বুকিং দর বেড়ে যাওয়ায় দাম বেড়েছে। বাজেটে অগ্রিম করও বাড়ানো হয়েছে। সরবরাহও কমেছে আগের তুলনায়। তবে সাধারণ ক্রেতাদের অভিযোগ, সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলেও কিছু মুনাফালোভী ও সুযোগ সন্ধানী ব্যবসায়ী কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে অতিরিক্ত মুনাফা করতেই মসলার দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। এদিকে খুচরা ব্যবসায়ীরা মসলার বাজার চড়ে যাওয়ার জন্য পাইকারি ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটকে দায়ী করেন।
মসলা আমদানিকারক এ্যাপোলো এন্টারপ্রাইজের স্বত্ত্বাধিকারি মো. জাহাঙ্গীর আলম জানান, বিদেশে মসলার দাম অস্বাভাবিকহারে বেড়ে গেছে। আমরা বেশি দামে আমদানি করেছি। তিনি বলেন, অনেক আমদানিকরাক লোকসানের সম্মুখিন হচ্ছেন। কারণ বেশি দামে কিনে কম দামে ছাড়তে হচ্ছে। খুচরা ব্যবসায়ীরা হয়ত বেশি মুনাফা লাভের আশায় দাম বেশি নিচ্ছে। আমদানিকারকরা নির্দিষ্ট দামেই পণ্য বাজারে ছাড়ছে। দাম বাড়ানোর কোনো সুযোগ নাই। তিনি বলেন, বাজেটে এআইটি যোগ হওয়ায় আমদানি খরচ বেড়ে গেছে। সে অনুযায়ী আমরা দাম নির্ধারণ করি। বেশি দামে বিক্রি করার কথাটি ঠিক নয়। তিনি বলেন, সিন্ডিকেট হওয়ার বিষয়টিও সত্য নয়। আন্তর্জাতিক বাজারের হিসেবেই দাম উঠানামা করে। লোকাল বাজারের দাম বাড়ানোর সুযোগ নেই।
খুচরা ব্যবসায়ী সিরাজুল ইসলাম বলেন, আমরা বেশি দামে কিনে আনি বিধায় বেশি দামে বিক্রি করি। তবে কোরবানির ঈদকে টার্গেট করে পাইকারি ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত মুনাফার লোভে মসলার দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। চাহিদা বাড়ার সুযোগ কাজে লাগিয়ে পাইকারি ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন।
জানা যায়, প্রতি বছর কোরবানির সময়কে সামনে রেখে মসলার দাম বাড়িয়ে দেন ব্যবসায়ীরা। অতি মুনাফার লোভেই দাম বাড়ান তারা। পাইকারি ব্যবসায়ীরা এ সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। তাদের কাছ থেকে কিনে খুচরা ব্যবসায়ীরা দাম আরো বেশি নেন।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ক্যাব’র কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, প্রতি বছর কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে মসলার দাম বাড়িয়ে দেন ব্যবসায়ীরা। মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা তৎপর হয়ে উঠেন। এতে সাধারণ ক্রেতারা ক্ষতিগ্রস্ত হন। তিনি এ ব্যাপারে প্রশাসনের নজরদারি বাড়ানোর দাবি জানান।
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, আগামী ১৫ দিনের মধ্যে পেঁয়াজ-আদা-রসুনের দাম কমবে। তিনি গতকাল মঙ্গলবার সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে অধিবেশন শেষে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন।
বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, আগামী ১৫ দিনের মধ্যে পেঁয়াজ-আদা-রসুনের দাম কমে আসবে। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসকদের নির্দেশনা দেয়া হয়েেেছ।
পেঁয়াজ-আদা-রসুনসহ জিনিসপত্রের দাম বাড়ার কারণ জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, কোথাও কোথাও বৃষ্টি হয়েছে। এতে ভারত থেকে আমদানিকৃত পেঁয়াজ কিছুটা নষ্ট হয়েছে। যার প্রভাব পড়েছে বাজারে। তবে আগামী ১৫ দিনের মধ্যে এ অবস্থার উন্নতি ঘটবে।
সবজিতেও আগুন
হঠাৎ করে বাজারে বেড়ে গেছে সকল প্রকার সবজির দাম। বৃষ্টির অজুহাতে দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতা। তবে পাইকারের তুলনায় খুচরায় দামের ফারাক ১০ টাকারও বেশি।
কয়েকটি কাঁচাবাজার ঘুরে দেখা যায়, সবধরনের সবজির দাম বেড়েছে। প্রতি কেজি বেগুন বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৭০ টাকায়। চারদিন আগেও বিক্রি হয়েছে ৩০ থেকে ৪০ টাকায়। জিঙ্গা কেজি বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকায়, বরবটি ৭০ টাকা, তিতকরলা ৮০ টাকা, কাঁকরোল ৫০ টাকা, তরই ৬০ টাকা, পেঁপে ৪০ টাকা, মিষ্টি কুমড়া ৪০ টাকা, পটল ৬০ টাকা ও কচুর লতি ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অথচ চারদিন আগেও এসব সবজির দাম ছিল বর্তমানের অর্ধেক।
বক্সিরহাটের তরকারি বিক্রেতা আবদুল মোনাফ বলেন, আমরা বেশি দামে কিনে আনছি। পাইকাররা দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের করার কিছু নাই।
অপরদিকে পাইকারি বাজারে গিয়ে দেখা গেছে সেখানেও দাম চড়া। প্রতিটি সবজির দামই অগের তুলনায় কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা বেশি। তবে খুচরা ব্যবসায়ীরা অধিকহারে দাম নিচ্ছেন।
পাইকারি ব্যবসায়ী মিজান বলেন, বৃষ্টির কারণে সবজি আসতে পারেনি। এছাড়া সবজি নষ্টও হয়ে গেছে। একারণে দাম বেড়ে গেছে। কয়েকদিন রোদ দিলে সবজি আসা শুরু হবে। দামও কমে যাবে।