মসজিদে ভয়াবহ বিস্ফোরণ মুসল্লিদের মর্মান্তিক মৃত্যু ও হতাহতের দায় কার?

34

রাজধানী ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানাধীন তল্লা চামারবাড়ী বায়তুস সালাত জামে মসজিদে ভয়াবহ বিস্ফোরণে হতাহতের ঘটনা খুবই মর্মান্তিক। শুক্রবার রাতে এশার নামাজের ফরজ ও সুন্নাত আদায়ের পর মুসল্লিরা যখনই বিরতির নামাজ পড়তে যাবেন তখন হঠাৎ বিস্ফোরণে চল্লিশজন মুসল্লি দগ্ধ হয়। তাৎক্ষণিক আহতদের উদ্ধার করে ৩৭জনকে ঢাকায় মেডিকেলের শেখ হাসিনা বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। সর্বশেষ গতকাল বিকাল পর্যন্ত ইমাম-মুয়াজ্জিনসহ ২৫ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। প্রাণহানির সংখ্যা আরও বাড়তে পারে; কারণ আহতদের অনেকের অবস্থাই আশঙ্কাজনক। ভাগ্য ভালো, বিদ্যুৎ না থাকায় এশার নামাজের জামাত শেষ হওয়ার পরপরই বেশির ভাগ মুসল্লি বের হয়ে যান। সর্বশেষ ভেতরে থাকা প্রায় ৪০ জন আহত হন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে আহতদের সুচিকিৎসায় সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে এবং মসজিদে বিস্ফোরণে আহতদের ত্বরিৎ চিকিৎসার জন্য বিশেষ ওয়ার্ড গঠন করা হয়েছে। উদ্বেগের বিষয়, মসজিদের মতো স্পর্শকাতর জায়গায় ইউটিলিটি নিরাপত্তা না থাকলে আর কোথায় সবকিছু নিরাপদ ও আশঙ্কামুক্ত থাকবে-এমন প্রশ্ন দেশের সচেতন মহলের।
জানা যায়, তল্লা মসজিদেও নিচে তিতাস গ্যাসের সঞ্চালন লাইন রয়েছে। এ পাইপ লাইনটি দীর্ঘদিনধরে কোন সংস্কার না হওয়ায় কয়েকটি অংশে লিকেজ দেখা দেয়। এ সম্পর্কে মসজিদ কর্তৃপক্ষ একাধিকবার তিতাস কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন বলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হয়েছে কিন্তু কর্তৃপক্ষ কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়নি। এমনকি মসজিদের ভেতরে প্রায় সময় গ্যাস লিকেজের আওয়াজ ও গ্যাসের গন্ধ পাওয়া যেত বলে জানাচ্ছেন স্থানীয়রা। ফায়ার সার্ভিসের অগ্নিনির্বাপক দলও বলছে- মসজিদের ফ্লোরের নিচ দিয়ে গ্যাসের লাইন গেছে এবং আগুন নেভানোর জন্য পানি দেয়ার পর ওই পানিতে গ্যাসের বুদবুদ দেখা গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যেহেতু এসির কারণে মসজিদের দরজা ও জানালা সব সময় বন্ধ রাখা হয়, সেহেতু বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিটের কারণে আগুন লাগার পর জমে থাকা গ্যাস বিস্ফোরণকে ত্বরান্বিত ও তীব্রতর করেছে। বিষয়টির প্রমাণ পাওয়া যায় বিদ্যুৎ আসার সঙ্গে সঙ্গে মুহূর্তের মধ্যে ৬টি এসির সবই ভস্মীভূত হয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে। এরই মধ্যে মসজিদটির মুসল্লিরা অভিযোগ করেছেন, তিতাসের গাফিলতির কারণেই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। তিতাসের এমডি বলেছেন, খতিয়ে দেখে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এরই মধ্যে তিতাসের তিন সদস্যের তদন্ত কমিটিসহ ফায়ার ব্রিগ্রেড, জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে পৃথক পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। অনুসন্ধানের মাধ্যমে প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করে দায়ীদের বিচারের আওতায় আনা হবে বলে আমরা আশাবাদী।
আশঙ্কার বিষয়, মসজিদ-মন্দির ও প্রার্থনা কেন্দ্র থেকে শুরু করে সাধারণ ভবন সবকিছুই ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বনানী অগ্নিকান্ড, পুরান ঢাকার রাসায়নিক বিস্ফোরণ, বিদ্যুৎ ও গ্যাস বিস্ফোরণ ইত্যাদি তার প্রমাণ। কিন্তু এত সমস্যার পরও সমাধানের উদ্যোগ না নেয়া এবং দেখে-শুনে চোখবুজে থাকা যেন অভ্যাস হয়ে পড়েছে এবং সবাই যেন দুর্ঘটনাকে নিয়তি হিসেবে মেনে নিয়েছে। অন্যথায় নিমতলী ও চুড়িহাট্টার বিস্ফোরণের এত বছর পেরিয়ে গেলেও পুরান ঢাকা থেকে সরেনি কোনো রাসায়নিকের গুদাম-ব্যবসা। বড় ভবনগুলোতে অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার বিষয়ে এখন বেশির ভাগ মানুষই উদাসীন; এমনকি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও চুপচাপ। এ অবস্থার অবসান ঘটানোর সময় এসেছে। নারায়ণগঞ্জে মসজিদে বিস্ফোরণে বড় ধরনের হতাহতের পর সচেতনতার ওপর জোর দেয়ার বিকল্প নেই। গ্যাস, এসি বা বিদ্যুৎ- যে ইউটিলিটি কর্তৃপক্ষই দুর্ঘটনার জন্য দায়ী হোক, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। মসজিদ কমিটির অবহেলা ছিল কিনা, তাও খতিয়ে দেখতে হবে।
বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, এমন মর্মান্তিক ঘটনা বা পরিনতির জন্য কেউই প্রস্তুত ছিলেন না। কিন্তু এমন শোকাবহ অগ্নিদুর্ঘটনাও দেখতে চাই না। প্রতিটি বড় বড় দুর্ঘটনার পর নানা রকম আশ্বাস দেওয়া হয়। কিন্তু সেসব আশ্বাসের বাস্তবায়ন দেখা যায় না বললেই চলে। আমরা এমন নৈরাজ্যকর অবস্থা থেকে মুক্তি চাই। আমরা চাই, নারায়ণগঞ্জের ঘটনায় মুসল্লিদের সর্বোচ্চ চিকিৎসাসেবাসহ মৃতদের পরিবারকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা প্রদান নিশ্চিত করা হোক।