মশার কীটনাশক সংকটে চসিক

37

ওয়াসিম আহমেদ

কবি জীবনানন্দ দাশের বিখ্যাত কবিতার একটি পঙক্তি, ‘আমারে দু-দন্ড শান্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতা সেন।’ চারদিকে বিপরীত ঢেউয়ের উচ্ছ¡লতায় ক্লান্ত একটি প্রাণকে অন্তত দু-দন্ড শান্তি দেওয়ার মত কবির কবিতায় বনলতা সেন ছিলো। এ শহরে বনলতা সেন নেই, তাই মশার কামড় ছাড়া দু-দন্ড শান্তিতে দাঁড়ানোর সুযোগ নেই। মশার এতো উপদ্রব আগে কখনও দেখেনি বীর চট্টলাবাসী। বিপরীতে মশক নিধনের দায়িত্বে থাকা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) ভুগছে কীটনাশক সংকটে।
গত চারমাসে দুইবার টেন্ডার আহবান করেও অংশ নেওয়া ঠিকাদারদের মধ্যে কাক্সিক্ষত কাউকে খুঁজে পায়নি সংস্থাটি। তাই সরাসরি বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ডকইয়ার্ড থেকে ওষুধ কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা জানিয়েছেন সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম। তিনি পূর্বদেশকে জানান, ‘দুই সপ্তাহের মধ্যে মশার কীটনাশক সংকট কেটে যাবে। দুইবার টেন্ডার আহবান করেও কাক্সিক্ষত ঠিকাদার পাইনি। তাই মূলত টেন্ডার প্রক্রিয়া বাতিল করে সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে সরাসরি ওষুধ কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’ চসিকের বিশ্বস্ত সূত্র বলছে, গত ছয় মাস ধরে কীটনাশক সংকট চলছে। কেনার নাম করে বিভিন্ন ঠিকাদার থেকে স্যাম্পল নিয়ে সেগুলো ব্যবহার করেই সামাল দিচ্ছে পরিস্থিতি। সর্বশেষ এক মাস ধরে কীটনাশক নেই বললেই চলে। যদিও অফিসিয়াল সূত্র এখনও এক সপ্তাহের কীটনাশক মজুদ আছে বলে দাবি করছে।
মশার উৎপাতে ওয়ার্ড পর্যায়ে বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে কাউন্সিলরদের। ওয়ার্ডবাসীকে মশার কবল থেকে বাঁচাতে ব্যক্তি উদ্যোগে কীটনাশক কিনে ব্যবহার করছেন চসিকের প্যানেল মেয়র ও রামপুর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আবদুস সবুর লিটন। তিনি পূর্বদেশকে জানান, ‘মশা প্রচুর বেড়েছে। প্রতিনিয়মত ওয়ার্ডবাসীর ক্ষোভের মুখোমুখি হতে হয়। তাই ব্যক্তি উদ্যোগে কীটনাশক কিনে ব্যবহার করছি। মাসে এক ড্রাম কীটনাশক লাগে। চারটি আলাদা ফগার মেশিনও কিনেছি। এতো নিয়মকানুন তো মানুষ বুঝে না। তাই মশা মেরে মানুষকে শান্তি দেওয়াই আমার কাছে নিয়ম। ’
সরেজমিনে গিয়ে ও ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, শুষ্ক মৌসুমে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের অধীনে খালে বাঁধ দিয়ে কাজ চলছে। এতে পানি প্রবাহ বন্ধ রয়েছে। যার কারণে বিগত যেকোনো সময়ে চেয়ে মশার উপদ্রব বেড়েছে। অন্যদিকে চাহিদার তুলনায় গত এক বছরে মাত্র ১২ ভাগের এক ভাগ কীটনাশক কিনেছে চসিক। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট এক কর্তা বলেন, প্রতিদিন একটি ওয়ার্ডে ৫ লিটার কীটনাশক ব্যবহার করলে বছরের পুরো নগরের জন্য প্রায় ৭২ হাজার লিটার কীটনাশক প্রয়োজন। সে তুলনায় গত এক বছরের মাত্র ৬ হাজার লিটার কীটনাশক কিনেছে সংস্থাটি। যা, ঢাকার সিটি করপোরেশনগুলোর এক ওয়ার্ডে ব্যবহৃত কীটনাশকের চেয়েও কম।
সাধারণত মশা নিয়ে জরুরী কোনো পরিস্থিতি তৈরি হলে গণখাতের ক্রয়বিধির ৭৬ (ট) ধারা (পিপিআর) ব্যবহার করে একক ঠিকাদার নিয়োগ করে কীটনাশক কিনত চসিক। কিন্তু বিগত সময়ে এ ধারা ব্যবহার করে পছন্দের ঠিকাদারকে ১৬টি ৭৬ (ট) ফাইল দিয়ে কীটনাশক কেনায় দুদক অভিযান চালায়। এতে আতঙ্কিত হয়ে জরুরী ভিত্তিতেও কোনো ওষুধ কিনছে না সংস্থাটি। উল্লেখ্য, এ ধারা অনুযায়ী অতিজরুরি বা প্রয়োজনীয় পণ্য, কার্য এবং সেবা ক্রয় করার কথা। এর মাধ্যমে প্রতিটি ক্ষেত্রে পাঁচ লাখ টাকার বেশি কেনাকাটা করা যাবে না।
দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় থাকার পর পুনরায় সচল হয়েছে চসিকের ম্যালেরিয়া ও মশকনিধন শাখা। পরিচ্ছন্নতা বিভাগের অধীনে আলাদা ম্যালেরিয়া ও মশকনিধন শাখা থাকলেও দীর্ঘ দেড়যুগ কোনো কার্যক্রম ছিল না। স¤প্রতি এই শাখার অধীনে একজন ম্যালেরিয়া ও মশকনিধন কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়েছে সংস্থাটি। কর্তা নিয়োগ হলেও সাংগঠনিক কাঠামো অনুসারে জনবল নেই। কীটনাশক ছিটানো ও সংশ্লিষ্ট কর্মকান্ড সম্পাদনে প্রশিক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই। মান্দাতা আমলের কৌশলেই চলছে মশক নিধন।
এমন পরিস্থিতিতে সদ্য নিয়োগ পাওয়া ম্যালেরিয়া ও মশক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা মো. শরফুল ইসলাম মাহী পূর্বদেশকে জানান, ‘আমাদের বর্তমানে লার্ভাসাইডের দ্রবণ ৩৫শ লিটার এবং এডালসাইডের দ্রবণ ১৪শ লিটার মজুদ আছে। আমি সদ্য দায়িত্ব নিয়েছি। অফিস গোছানোর চেষ্টা করছি। মেয়র মহোদয় বেশ আন্তরিক। একটি টিম নিয়ে মশক নিধনে বাস্তবিক কিছু কৌশল ব্যবহারের প্রস্তুতি নিচ্ছি। শুধু কীটনাশক নয়, প্রাকৃতিক উপায়ে মশক নিয়ন্ত্রণে উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহারে আমরা পরীক্ষা-নিরিক্ষা চালাচ্ছি।’