মরমের কবি, যুগশ্রেষ্ঠ অলিয়ে কামেল সৈয়দ আমিরুজ্জমান শাহ (ক.)

11

 

মারেফত মানে মায়ের পথ। যে পথ দেখানো যায় না। তবে ভক্তি বিশ্বাসে সদা উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত, সৃষ্টিজগতের প্রতিজনের কাছে। তথাকথিত ব্যাখ্যা দিয়ে বলা যাবে না,তবে অন্তর দিয়ে অনুভব করা যায়। এই অনুভবে ভক্তিতে শ্রদ্ধায় আমরা মা খুঁজে পাই। মারেফতের ব্যাপারটাই এমন। জাগতিক জীবনের নানান ঘাত উপচার পেরিয়ে, ধর্ম বর্ণ গোত্র নির্বিশেষে এই মারেফতে এসে মিলিত হতে পারেন। শান্তি পেতে পারেন। যুগে যুগে এই শান্তির ধারা-বাহী অলিয়ে কামেল সেই পথেই ডাকেন। অথচ মারেফতকে চর্মচক্ষুতে নির্ণয় করা কোনোমতে সম্ভব নয়। অন্তর চক্ষু খুলে অনুভব করতে হয়। ততটুকু না গিয়ে সে অসম্ভব ব্যাপারে নাক ঢুকিয়ে মাথা আর অন্তর বাইরে রেখে, তথাকথিত মানুষ নিজে যেমন অজ্ঞতায় হাসির পাত্র হয়,অন্যকেও নষ্ট করার পাঁয়তারা করে। কিন্তু যুগের অলিয়ে কামেল সদা ডাকতে থাকেন ভক্তদের উজ্জীবিত বিশ্বাসে। শান্তির পথে ডাকা অনাচার মিথ্যাচার সরিয়ে একজন অলিয়ে কামেল কালাসোনা খ্যাত আমিরুল আউলিয়া সৈয়দ আমিরুজ্জামান শাহ ( ক.) আমিরুল আউলিয়া সৈয়দ আমিরুজ্জমান শাহ (ক.) শুধু যুগশ্রেষ্ঠ অলিয়ে কামেল ছিলেন না। একজন মরমি কবিও। পুঁথিসাহিত্যেও ছিলো অগ্রসর। তুখোড় পাÐিত্য ছিলো আরবি, উর্দু ও ফার্সি ভাষায়। ফার্সি ভাষায় লেখা অনেক কালাম (কবিতাও বটে) বিস্তর বিচার বিশ্লেষণের দাবি রাখে। সদাই মুর্শিদের প্রতি ভক্তি অনুরাগের কথা হৃদয়ে শব্দের ঝংকারে ধ্বনিত হয়েছে। তদুপরি সেই কবিতা আমিরুল আউলিয়া সৈয়দ আমিরুজ্জামান শাহ (ক.) এর ভক্ত অনুরাগের কাছে হৃদয় সঁপে দেওয়ার ব্যকরণ যেন; অর্থ্যাৎ কবিতাগুলো একটা সেতু নির্মাণ করে গেছে। আমিরুল আউলিয়ার মুর্শিদ ও নিজের কাছে এবং পরবর্তী নিজের ভক্ত অনুরাগের মাঝে। আধ্যাত্মিক সরলতার চমৎকার অনুভব। নিজের খেয়ালকে শুদ্ধস্বরে পরিচালনার জন্য মন্ত্র যেন –
‘হাবিবে রহমান, মেরে বাবাজান
সাহেবে সুলতান আমিরুজ্জমান’
আমিরুল আউলিয়া সৈয়দ আমিরুজ্জমান শাহ ( ক.) এর উপরোক্ত কবিতার (কালাম) দুটো লাইনে ছন্দের উদ্দীপনা আর তালের সমন্বয় সহজে অনুরণন তোলে। সেই দুটো লাইনেই আমিরুল আউলিয়া সৈয়দ আমিরুজ্জমান শাহ (ক.) এর পরিচয় ও পরিব্যাপ্তি হয়তো নির্ণয়ের আভাসগুলো অনুবাদ করা যায় মাত্র। কেননা আমার মতো ক্ষুদ্রজনের এই ভক্তির প্রয়াসটুকু অতো ভেতরে প্রবেশাধিকার নাও হতে পারে। তবুও উপরোক্ত দুটো লাইনের প্রথম লাইনে রহমানের হাবিব মানে আল্লাহর বন্ধু বলছেন মেরে বাবাজান মানে নিজের মুর্শিদেকে; এরপরের লাইনে নিজের স্বরূপ উন্মোচন করেছেন- সাহেবে সুলতান অর্থাৎ সুলতানের সাহেব আমিরুজ্জমান মানে জমান( জগতের আমির বা বাদশা)….
আধ্যাত্মিকতার ব্যাপারটি হচ্ছে নিজেকে চেনা বা নিজেকে জানান দেওয়া। সেখানে উপরোক্ত দুটো লাইন শুধু চট্টগ্রাম নয় বাংলাদেশ নয় পুরো বিশ্বের আধ্যাত্ববাদের চর্চাকারীদের জন্য অনুসরণীয়। হযরত আমিরুল আউলিয়া সৈয়দ আমিরুজ্জমান শাহ (ক.) এর মুর্শিদ অন্বেষণও আধ্যাত্মিক অনুকরণ করা ব্যক্তিদের কাছে চমৎকার নির্দেশনা বাতলে দিয়েছে। আমিরুল আউলিয়া মাদারজাদ অলি। তবুও মুর্শিদ অন্বেষণ অর্থাৎ নিজের আত্মার কথাকে উপলব্ধি করেছেন। জীবনের শুরুতে শিক্ষকতার মহান পেশায় জড়িত ছিলেন। এলাকায় কুরআনের দ্বীনি শিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি মসজিদের ইমামতির দায়িত্ব পালন করেছেন। এমতাবস্থায় নিজের মধ্যে নিজের মুর্শিদকে অন্বেষণে প্রথমে পটিয়ার বড়লিয়ার হযরত মৌলানা আবদুর রশিদ (রহ.), এরপরে রাউজান থানাধীন কদলপুর মৌলানা আবদুল আজিজ শাহ (রহ.) এর কাছে গিয়ে কঠোর রেয়াজতে ছিলেন। কিছুদিনের মধ্যেই উনারা বুঝতে পেরেছেন আমিরুল আউলিয়া সৈয়দ আমিরুজ্জমান শাহ (ক.) এর প্রেম তৃষ্ণা মেটানোর সে উৎস উনাদের করায়ত্তে নেই। উনারা হাসিমুখে আমিরুল আউলিয়াকে বিদায় দেন নিজেদের বরাতে ফয়েজ দান করে। এখানে উল্লেখ্য যে, এখনকার আধ্যাত্মিক চর্চাকারী পীর মর্শিদের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। এখনকার পীর কোথায় আর মুর্শিদ কোথায় নিজেরা নিরূপণ করতে পারেন না। কেবল জাগতিক লোভ লালসায় আটকে রাখা,ফয়েজ হাসিল কী পীরও জানেন না,ভক্ত জানবেন কোত্থেকে…
দুজন অলিয়ে কামেলের দরবার হতে বিদায়প্রাপ্ত হয়ে মুর্শিদের অন্বেষণের ভাবাবেগ আরো বাড়ছে। এরপরে কিছুদিন আনোয়ারার দেয়াঙ পাহাড়স্থ হযরত আজগর শাহ (রহ.) এর সান্নিধ্যে এসে রেয়াজত করেন। তিনিও বিদায় দিলে সেই ভাবাবেগ ক্রমে ক্রমে জজবা হালে বাহিত করেছিল। তখন এলাকার হাদু চৌধুরী জামে মসজিদে মাগরিবের আজানের পরে কেউ যেতেন না, গেলেও ফেরত আসা সম্ভব হতো না। সেই মসজিদের ইমামতি করতেন হযরত আমিরুল আউলিয়া। একদিন জজবা হালের এমন গতি ছিলো যে মসজিদের পূর্বদিক থেকে দ্রæতলয়ে হেঁটে আসতে শুনতে পেলেন এশারের আযান! হযরত আমিরুল আউলিয়া আত্মার টানে জামাতে দাঁড়িয়ে গেলেন। দেখলেন একজনেরই দাঁড়ানোর জায়গা ফাঁকা ছিলো। মুসল্লিদের মধ্যে কারো সাথে কারো কথা নেই, নামাজ শেষে আমিরুল আউলিয়ার সামনে বসা শুধু ইমাম। ইমাম সাহেব সামনে আসতে বললেন। আমিরুল আউলিয়া আদবের সাথে সামনে গিয়ে বসলেন। ইমাম সাহেব পরপর তিনবার জিজ্ঞেস করলো – বাবা তুমি কি চাও?
আমিরুল আউলিয়া তিনবারের জিজ্ঞাসার পরে একবারে উত্তর দিলেন – আমি মানুষ হতে চাই…
ইমাম সাহেব তখন বললেন- তুমি যাকে খুঁজছো তাঁকে এখানে পাবেনা। ঈছাপুর দমদমার কূলে( বর্তমান মাইজভান্ডার শরীফ) চলে যাও। সেখানেই তোমার কাক্সিক্ষত মুর্শিদকে পাবে। এই বলে ইমাম সাহেব অদৃশ্য হয়ে গেলেন। এরপরে আমিরুল আউলিয়া আল্লাহর নিকট শোকরানা আদায় করে, সেই মুর্শিদকে অন্বেষণে আরো ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। এমতাবস্থায় মজজুবে অলি হযরত আকবর শাহ ( রহ.) এর সাথে সাক্ষাৎ হলো। সবিস্তারে ব্যাপারটি জানালে আকবর শাহ (রহ.) কালবিলম্ব না করে ঈছাপুর দমদমার কূলে চলে যেতে বলেন। আশেক মাশুকের মধ্যে বাইতেনে রশি দিয়ে টান বুঝতে বিলম্ব হলো না। আমিরুল আউলিয়া দমদমার কূলে গিয়ে দেখলেন সেই হাদু চৌধুরী জামে মসজিদের ইমাম সাহেব! যিনি আমন্ত্রণ জানিয়েছেন দমদমার কূলে আসতে। তিনিই হলেন গাউছুল আযম হযরত আহমদ উল্লাহ্ মাইজভান্ডারী (ক.)…. আমিরুল আউলিয়াকে আহŸান করলো – ‘আও ব্যাটা মেরে পাছ সবকুছ মিল যায়েংগি’…. এই যে মুর্শিদ অন্বেষণ আর মুর্শিদও নিজেকে জানান দেওয়া ও মেহমান করে নিয়ে গেছেন। এই হলো আধ্যাত্মিকতা। এই যে আমিরুল আউলিয়ার মানুষ হতে চাওয়া,কী আধ্যাত্মিক সরলতার অনুভব, পরিশুদ্ধতার নিরীখে; এই মহান অলি জন্মলাভ করেন চৈত্রের ১ তারিখ ১৮৬৫ খ্রিষ্টাব্দে…
০২.
আমিরুল আউলিয়া সৈয়দ আমিরুজ্জমান শাহ (ক.) এর মুর্শিদের প্রতি কেমন ভক্তি আর রেয়াজত উল্লেখ করার মতো ভাষা অনুসন্ধানে কঠোর রেয়াজতে শামিল হতে হবে। একদিন গাউজুল আযম হযরত আহমদ উল্লাহ মাইজভাÐারী (ক.) ডানহাতে বেহেশত আর বাম হাতে দোজখ বলে তাঁর ভক্তদের বললেন- তোমরা কে কোনটা ধরবে ধরো…
সবাই ডানহাত ধরার জন্য তড়িঘড়ি, ডানহাত ধরলেন বেহেশত যাওয়ার জন্য আর আমিরুল আউলিয়া ধরলেন বামহাত! মুর্শিদ কারণ জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেন- দুটোই আমার মুর্শিদের হাত,মুর্শিদের হাতে দোজখ থাকলে সেখানে যাবো না কেন?
এই হলো প্রেম। আধ্যাত্মবাদের প্রেম। এর ব্যাখ্যা শুধু হৃদয়ের অনুভব দিয়ে। বড়মা সায়েরার মা ছিলেন আমার মা সৈয়্যদেনা মোছাম্মৎ মর্জিয়া ভাÐারীর মতো আমিরভান্ডারের আশেকিনা। বড়মা ছিলেন আমিরুল আউলিয়ার আর মা আবু ছৈয়দ শাহ (রহঃ) এর…আমাদের পুরাতন বাড়ি আর আমিরভান্ডার দুটো পৃথক উপজেলায়। তখন ছিলো না মোবাইল। কিন্তু কী আত্মিক টান,এদিকে বড়মা সায়েরার মায়ের সাধ জেগেছে রুই মাছের মাথা খাবে। ঐদিকে আমিরুল আউলিয়ার এক ভক্ত রুই মাছ নিয়ে এলেন। আমিরুল আউলিয়াও কালবিলম্ব না করে রুইমাছের মাথা পাঠিয়ে দিলেন আমার বড়মায়ের জন্য। কী বাইতেনে প্রেম। সবার আড়ালের কী পরিশুদ্ধ প্রেম। আশেক মাশুকের ভালোমন্দ বুঝতে পারা। সাধ আহ্লাদ আর আকুতি শত হাজার মাইল দূর থেকে নির্ণয় করতে পারা। ভাবলে গায়ের লোম শিউরে ওঠে। আমিরুল আউলিয়া সেই সুদূর ত্রিশ চল্লিশ মাইল উচুনিচু পাহাড় পর্বত নদী নালা পেরিয়ে আসতেন মাইজভাÐার শরীফকে সামনে রেখে। ভাবতে পারেন স্বাভাবিক চিন্তায়! বেশি দেরির কথা নয় উনিশ শতকের শুরুর দিকে…
এজন্যই বুঝি গাউছুল আযম আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী (ক.) নিজের খোশরোজ শরীফ পালনে আমিরুল আউলিয়াকে হুকুম দেন। যেটি আমিরুল আউলিয়ার বেলায়ত বার্ষিকী। যেটি পয়লা মাঘের ওরশ সর্বজনবিদিত।
০৩.
আমিরুল আউলিয়া সৈয়দ আমিরুজ্জমান শাহ (ক.) একদিন ভক্ত অনুরক্ত মুরিদানদের সামনে বললেন – আমি দুনিয়াতে এমন একটা কাজ করে যাচ্ছি যা কেউ করেনি। আমি জীবদ্দশায় তাঁবুত তৈরি করেছি। সেই তাঁবুতের পিছনের দিকে দরজার ন্যায় খোলা রেখেছি যাতে কফিন সহজে ঢুকানো যায়,তাঁবুতের দক্ষিণ দিকে আয়না লাগিয়েছি যাতে আমার ভক্ত আশেকবৃন্দ আমাকে দেখতে পায়। কোন ভক্তের বাড়ি কিংবা অন্য কোথাও নিতে চাইলে কফিনসহ নিতে পারবে, তাঁবুতে চাকা লাগানো হয়েছে। আমার দেহ ছেড়ে প্রাণ বের হয়ে গেলে জানাজা শেষে ঘরের ছাদের উপর কফিনসহ ছয়মাস রেখে দেবে। সম্ভব না হলে তিনমাস, না হয় একমাস না হলে অন্তত ছয়দিন রাখবে। এসব কথা জালালি হালতে ঘুরে ঘুরে বলে জবান পাকে উচ্চারিত করছেন- এয়া আমিরুজ্জমান এবং প্রত্যুত্তরে বলছেন- ‘লাব্বাইকা’…
এরপরে খোদার জিকির নবীর দরূদ কালেমায়ে শাহাদাত জবান পাকে উচ্চারণে, ভক্ত আশেক থেকে জাগতিক আড়ালে প্রভুর দরবারে অনন্ত মিলনে ধন্য হন। ( ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিউন। সেই সময়টি ছিল ৩রা মে ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দের ১২জিলক্বদ ২০শে বৈশাখ রোজ বৃহস্পতিবার সকাল ৯ ঘটিকায়….

লেখক : কবি ও সম্পাদক