মনেপ্রাণে একনিষ্ঠ এক শিক্ষক শামসুদ্দিন শিশির

149

সেই স্কুল জীবন থেকেই পত্রিকার প্রতি ঝোঁক। এক পর্যায়ে অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে ভেতরের সম্পাদকীয়, উপ-সম্পাদকীয় ও ফিচার পাতার প্রতি অসাধারণ টান। এষণা, গবেষণা, তথ্য, উপাত্তে ভরা চিন্তা-চেতনা, মেধা-মনন, মন ও মগজ নিংড়ানো নির্যাস আর অসাধারণ রসে পূর্ণ কথামালা। নিজেকে ঋদ্ধ করে নেয়ার এক অনন্য আধার । এ পাতার নামে-বেনামে-ছদ্মনামের লেখকদের মাঝেই নজরে পড়ে ‘শিশির’ নামটি। ‘শিশির’ নয় শুধু মীর আবু ছালেহ মোহাম্মদ শামসুদ্দীন শিশির। এ শিশির স্নিগ্ধ ভোরে সজীব ঘাসের ডগায় মুগ্ধতা ছড়িয়ে সকালের মিষ্টি রোদে ঝরে পড়া শিশির বিন্দু নয়। এ শিশির হৃদয় পাগল করা, মনোবীণায় সুর তোলা এক উচ্ছল অনন্য ‘শুচিস্নিগ্ধ শিশির’। আমার ভালোলাগার মানুষ-ভালোবাসার মানুষ এ ‘শিশির স্যার’।
অধ্যয়নকাল হতেই লেখালেখি, সাংবাদিকতা ও প্রকাশনার কারণে জামাল খান- চেরাগী পাহাড় সাংবাদিক পল্লী, আন্দরকিল্লা প্রেসপাড়া ও বইবাজারে বেশীরভাগ সময় আমার অবস্থান, আড্ডা ও ঘুরোঘুরি। কখনো বইয়ের দোকানে, কখনো প্রেসে, কখনো পত্রিকা পাড়ায় কিংবা রাস্তায় শিশির স্যারকে দেখতাম। এমনকি মখোমুখি হয়েছি, পাশাপাশি বসেছি। কখনো কথা হয়নি, পরিচিত হইনি। অথচ আমরা একে-অপরকে দেখতাম-চিনতাম। হঠাৎ একদিন কথা না হয়ে পাওে নি। আর এ সংযোগের মাধ্যম আরেক ঘনিষ্ঠ অনুজ শিমুল মহাজন। হাটহাজারীর পশ্চিম ধলই উচ্চ বিদ্যালয়ের ২০ বছর পূর্তি উৎসব স্মরণিকা (২০০৬) ‘নবোদয়’ এর সম্পাদক বিদ্যালয়ের তৎকালীন সহকারী প্রধান শিক্ষক (বর্তমানে প্রধান শিক্ষক, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ একাডেমী, গড়দুয়ারা, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম) শিমুল মহাজনকে সামান্য সহযোগিতা করতে গিয়ে অসামান্য ও অসাধারণ এ মানুষের সাথে পরিচয় ঘটল। অবশ্য এ চার চোখের মিলন, দু’হাতের করমর্দন ও উষ্ণ আলিঙ্গন অনেক আগেই হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল। এ বিলম্বে আমি বঞ্চিত হলাম এ মহান ব্যক্তির সুনিবিড় আন্তরিক সান্নিধ্য থেকে। অবশেষে পেলাম তাঁর বিশাল হৃদয়ের অকৃত্রিম ভালোবাসার লাল গোলাপ।
শামসুদ্দীন শিশির এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। চট্টগ্রাম শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজ -এর সর্বকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় শিক্ষক। তাঁর বন্ধুত্বসুলভ আচরণ, অমায়িক ব্যবহার ও উদার মানসিকতা তাঁকে সকলের প্রিয় করে তুলেছে। ক্লাসে যেমন তিনি তুখোড় বাগ্মী, নিষ্ঠাবান শিক্ষক, দায়িত্বশীল শিক্ষাগুরু; তেমনি ক্লাসের বাইরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও তিনি অনন্য বাক্পটু। বিভিন্ন সভা-সমাবেশ ও সেমিনারে তাঁর দরাজ কণ্ঠে যুক্তিনির্ভর, সুচিন্তিত, তথ্যসমৃদ্ধ, পান্ডিত্যপূর্ণ ও মিষ্টভাষী আলোচনা-বক্তব্য-বিবৃতি সকলকে বিমুগ্ধ করে। তাঁর বাচনভঙ্গি, কথাবলার স্টাইল ও উপস্থাপন কৌশলে সকলের কাছে তিনি সুপন্ডিত-সুবক্তা হিসেবে সুপরিচিত।
জনপ্রিয় কলামিস্ট শামসুদ্দীন এক ব্যতিক্রমী লেখক। তিনি পত্র-পত্রিকায় মূলতঃ শিক্ষা বিষয়ক লেখাই লেখেন। সভা-সমাবেশ সেমিনারে তিনি যেমন শিক্ষা বিষয়ের আলোচক থাকেন, তেমনি তাঁর লেখালেখির প্রধান বিষয়-শিক্ষা। মনে-প্রাণে একনিষ্ঠ এক শিক্ষক বলেই তিনি শিক্ষাকেই তার লেখালেখির মূল উপজীব্য বিষয় করেছেন। শিক্ষার মৌলিক বিষয়, শিক্ষার্থী-শিক্ষক-অভিভাবক সম্পর্ক ও গুরুত্ব, শিক্ষক ও শিক্ষকতা পেশার বিষয়-বৈচিত্র্য, শিখন-শিক্ষণ পদ্ধতি ও কৌশল, শিক্ষকের মর্যাদা ও শিক্ষকতা পেশার তাৎপর্য বিষয়ে তিনি অনেক গবেষণা করেছেন এবং পান্ডিত্যপূর্ণ প্রবন্ধ লিখেছেন।
শিক্ষকের-এ শিক্ষক মহান শিক্ষকতা পেশাকে শিক্ষকদের কাছে নতুনভাবে নতুন কৌশলে উপস্থাপন করেছেন। শিক্ষকতা কোন লোভনীয় পেশা নয়, এক মর্যাদাপূর্ণ মানবিক দায়িত্ব। শিক্ষকতা এক মহা আনন্দময় ব্রত, যাপিত জীবনে অম্ল-মধুর কষ্ট- এ মৌলিক দর্শনই তিনি সকলের কাছে ছড়িয়ে দিয়েছেন। আদর্শিক -এ শিক্ষক শিক্ষা বিষয়ে অনেক মননশীল গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর এ রচনা সম্ভার আমাদের বাংলা সাহিত্যের ভান্ডারকে করেছে সমৃদ্ধ, তেমনি শিক্ষা বিষয়ক প্রবন্ধ সাহিত্যে এনেছে নতুন মাত্রা। এ ছাড়াও শিক্ষা বিষয়ক কর্মশালা পরিকল্পনা ও পরিচালনা এবং শিক্ষা বিষয়ক পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশনায় তিনি প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন।
সদালাপী, বন্ধুবৎসল, সদা হাস্যোজ্জ্বল, উচ্ছল, উদ্যমী ‘শিশির স্যার’ আদর্শ শিক্ষকের মডেল। জীবনের এ মধ্যাহ্নেও তিনি টগবগে তরুণ। নিরলস শিক্ষাকর্মী, ন্যায়নিষ্ঠ শিক্ষাব্রতী, সুগভীর শিক্ষাচিন্তক এ ব্যক্তিত্বের অবিরাম পথচলা যেন খরস্রোতা নদী। এ মহান পুরুষ আমাদের একান্ত আপনজন। হৃদয়ের গভীরে ছোট্ট কোঠরে তাঁর নিত্য বসবাস। অগণিত শিক্ষক-প্রশিক্ষণার্থী-ভক্তের মনোজগতে তিনি পরম শ্রদ্ধার আসনে সমাসীন। এ মনোমানুষের প্রতি আমার ভালোবাসার অবিরাম ঝর্ণাধারা বয়ে যাবে চিরদিন- চিরকাল নিরন্তর।