মনাম এর বৈঠকখানা লাজ নীতি হীন রাজনীতি !

30

 

এখন শীতকাল। মাগার মাথার উপর ফ্যান এখনও ঘুরিতেছে। শীতের সেই রূপ রঙের স্বাদ এখনও পাইতেছিনা। অনুভূতিহীন এক ঋতু অতিক্রান্ত করিতেছি। শীতকাল ছিল বাঙালির পিঠা পুলির মিষ্টি রসালো ঋতু। গুলবদন আর মেহেরজানের মাঝে শীত আসিলেই পিঠা বানানোর প্রতিযোগিতা চলিয়া আসে। খেজুরের রস দিয়া ভাপা পিঠা খাওয়া বাঙালি সমাজের একটি অলিখিত প্রথা। আফসোস। আজকাল খেজুরের রস আগের মতো পাওয়া যায়না। তিন/চার দশক আগে রস ওয়ালার চিৎকারে মানুষের ঘুম ভাঙ্গিত। আর আজ দশ ব্যাটারির টর্চ জ্বালাইয়াও রস ওয়ালা তালাশ করিয়া পাওয়া যায়না।তাই বলি ঋতু আর ঋতু নাই। ইনসান বদলিয়া যাইতেছে ঋতুর দোষ দিয়া কী লাভ ? পুরানা হিন্দি ফ্লিমের গানটা মনে পড়িয়া গেল-‘চাঁদ না বদলে সুরুজ না বদলে, না বদলা রে আসমান। কিতনা বদল গেয়া ইনসান’। পত্রিকার খবরে দেখিলাম, সাইবেরিয়া হইতে হিমালয় হইয়া দেশের উত্তরাঞ্চল দিয়া শীতের হিমেল হাওয়া প্রবেশ করিবার মুখে বাধা হইয়া খাড়াইয়াছে পশ্চিম মধ্য বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া ঘূর্ণিঝড় ‘জাওয়াদ’। তাই শীত আসি আসি করিয়াও হাঁটু মুড়িয়া বসিয়া আছে।
মাস্টার সাহেব ম্লান হাসি দিয়া বৈঠকখানায় উপস্থিত হইলেন। কুশলাদি বিনিময়ের পর আসল কথায় আসিলেন। তিনি ক্ষোভ ঝাড়িয়া কহিলেন-এই জন্যই কী দেশ স্বাধীন করিয়াছিলাম ? পাসপোর্ট বানাইতে জায়গার খতিয়ান চাহিতেছে। যেইসব নাগরিকদের ঘরবাড়ি নাই, তাহারা খতিয়ান কোথায় পাইবে ? প্রধানমন্ত্রী কিছুদিন আগে গৃহহীনদের মধ্যে অনেকগুলি গৃহ দিয়াছেন। যাহারা এখনও গৃহহীন তাহারা খতিয়ান কোথায় পাইবে ? এন আই ডি কী জন্য ? মাস্টার সাহেবের এক আত্মীয়ের এন আই ডিতে আসল নাম ইংরেজিতে হইলেও ডাক নামটা বাংলায় আসায় তাহার পাসপোর্ট হইতেছেনা, যতক্ষণ এন আই ডি’র বাংলা নামটা ইংরেজিতে করা না হইতেছে। অথচ বাংলাদেশে ইহা ভুল কিছু নয়। এই সামান্য ব্যাপার লইয়া মানুষদেরকে হয়রানি করিবার কোন মানে হয়না। এই হয়রানির পেছনে দুর্নীতির গন্ধ পাওয়া যায়। অনেক ভুক্তভোগীর মতে এই সমস্ত হয়রানির অন্যতম কারণ হইল ‘ঘুষ’।আফসোস ! এই হয়রানি বা দুর্নীতি যাহারাই করিতেছে তাহারা শিক্ষিত। কথায় আছে শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। আমি বলি ‘সুশিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড’। তা না হইলে সাধারণ মানুষ তো সাধারণ মানুষ, এইখানে সরকারের মন্ত্রী পর্যন্ত রেহাই পাইতেছেন না। গেল সপ্তাহে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তফা জব্বারের একটি চেক ব্যাংক হইতে ফিরিয়া আসিয়াছে শুধুমাত্র ডিসেম্বর বানানটা বাংলায় লেখার কারণে। আমি তাজ্জব বনিয়া যাই বাংলাদেশে বাংলা লেখা নিষিদ্ধ হইল হবে ? ফেব্রুয়ারি আসিলেই শুধু সর্বত্র বাংলা চালুর জন্য মাইকে, রেডিও, টি ভিতে চেঁচামেচি আরম্ভ হইয়া যায় ? বাকি এগারমাস বাংলার বিরুদ্ধে বাঙালিদের হয়রানি করা হয়। ইহাই কী দেশপ্রেম ? ইহার নাম কি ভাষা প্রেম ? যাহারা এই ছুরতের ঝামেলা পাকায় তাহাদের বিষয়ে খোঁজ খবর নেওয়া নেহায়েত জরুরি। মুল্লুকের সর্বত্র কিছু আইনের দোহাই দিয়া ঘুষ দুর্নীতি চাঁদাবাজি খতরনাক ছুরতে বাড়িয়া গিয়াছে। টমটম যদি রাস্তায় চলিতে দেওয়া না হইবে, তাহা হইলে আমদানির অনুমোদন দেওয়া হইল কেন ? এখন স্রেফ এই নিষেধাজ্ঞার অজুহাতে প্রশাসনের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা ও স্থানীয় টাওট, বাটপারের যোগসাজশে টমটম চলিতেছে। ইহা যেন গরুর মালিকও চুপ, রাখালও খোশ মধ্যখানে গরুর নাকাল হাল। রাজনীতি ছিল জনগণের কল্যাণে, সমাজের কল্যাণে। মাগার আজকাল রাজনীতি মানেই টাকা। রাজনীতিতে কিছু অযোগ্যের অনুপ্রবেশ ঘটিয়াছে। শিক্ষা, সভ্যতা ভব্যতা, চক্ষুলজ্জার বিলকুল ধারে-কাছে নাই। খবরের কাগজে দেখিলাম, প্রয়াত সাংসদ বীর মুক্তিযোদ্ধা মাঈন উদ্দিন খান বাদলের স্মরণ সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে দক্ষিণ জেলা আওয়ামীলীগের সহসভাপতি এস এম আবুল কালাম উষ্মা জাহের করিয়া বলিলেন-এখন কী সেই শান্তি আছে ? শান্তি কোথায় গেল ? আজ একটি টিউবওয়েলের জন্য পঞ্চাশ হাজার টাকা দিতে হইতেছে। ইহা সরকার দলীয় এক নেতার আক্ষেপ। ইউপি নির্বাচনেও ভোট বাণিজ্য আরম্ভ হইয়াছে।যেখানেই যাই মানুষের মুখে মুখে আক্ষেপের স্ফুলিঙ্গ। সমাজের মাসুম জনগোষ্ঠি অঙ্গার। কেহ কেহ আফসোসের দীর্ঘশ্বাস ছাড়িয়া কহিয়া থাকে-রাজনীতি এত কলুষিত হইল কী করিয়া ! কেহ কহিতেছে দুর্বৃত্তদের রাজনীতিতে অনুপ্রবেশের কারণে রাজনীতির এই ছেড়া বেড়া অবস্থা। কেহ কহিতেছে স্বাধীনতা বিরোধীদের সুবিধাবাদীরা মনোনয়ন কিনিয়া ধান্ধাবাজি করিয়া অর্থের অবৈধ পাহাড় গড়িয়া রাজনীতিকে কলুষিত করিয়াছে। আজ কয়দিন টক অব দ্যা টাওন হইল ডাঃ মুরাদ হাসান প্রসঙ্গ। তিনি কোন ছুরতে এম পি হইয়াছেন তাহাতে বিস্ময়ের কিছু নাই। মাগার আমি তাজ্জব বনিয়া যায় তিনি প্রতিমন্ত্রী হইলেন কোন ছুরতে ? একজন রাজনীতিবিদ, একজন এম পি, একজন মন্ত্রী কীভাবে এতটা শিষ্টাচার বিবর্জিত হইতে পারেন তাহা আমার বোধগম্যের বাহিরে। তাহার অশ্লীল শব্দের প্রস্তর খন্ড হইতে রেহাই পাননি রোকেয়া হল ও শামসুন্নাহার হলের ছাত্রী নেতৃগণ। রেহাই পান নি বিরোধী নেতৃ বেগম খালেদা জিয়ার নাতনি। রাজনীতিতে ব্যক্তিগত আক্রোশ থাকা অনুচিত। চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহির ফোনালাপ টা দুই বছর আগের। নায়িকা এখন স্বামীর সহিত ওমরার উদ্দেশ্যে মক্কা নগরিতে অবস্থান করিতেছেন। দুই বছর পর তাহাদের ফোনালাপ প্রকাশ পাইবার কারণ উদঘাটন করাও আবশ্যক। সকিনার বাপ আমি ও মাস্টার সাহেব একসাথে ফোনালাপ্ টা শ্রবণ করিয়া মুর্ছা যাইবার যোগাড়।ছিঃ ছিঃ ছিঃ রাজনীতিতে খল নায়কদের বেপরোয়া আবির্ভাব ঘটিয়াছে। এটাকেই বলা হয় ‘লাজ,নীতি হীন রাজনীতি’। যেখানে হায়া শরম নীতি নৈতিকতা অনুপস্থিত চৌ ফাটা চরিত্র, সেখানে সুস্থ রাজনীতি আকাশ কুসুম।আমরা বঙ্গবন্ধু, মাওলানা ভাসানী, শহীদ সোহরোয়ার্দীর আদর্শ হইতে যোজন যোজন দূরে আসিয়া পড়িয়াছি। আমাদের কতই না দুর্ভাগ্য ! স্বাধীনতার পরপর স্বাধীনতার স্থপতিকে সপরিবারে হত্যা করা হইল। বিজয়ের দুইদিন আগে বুদ্ধিজীবীদের সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হইয়াছিল। জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করিয়া স্বাধীনতা বিরোধীরা মেধা শূন্য, নেতৃত্ব শূন্য জাতিতে পরিণত করিয়াছিল আমাদেরকে। ধীরে ধীরে তাহা পরিষ্কার হইলেও আমরা অজ্ঞাত কারণে মরুভূমির উটপাখির মতো বালিতে মুখ গুঁজিয়া থাকিতে অভ্যস্ত হইয়া পড়িতেছি।
মাঝে মাঝে কিছু ঘটনা প্রবাহ ধাক্কা মারিয়া আমাদের তন্দ্রা ছুটাইয়া দিলেও কিছুদিন পর সব ভুলিয়া অদ্ভুত নেশায় আবারও ঝিমাইতে থাকি। বেশিরভাগ চতুর লোকের দুইটা রূপ থাকে। বাহিরের রূপটা যেমন তেমন ভেতরের রূপটা হয় ভয়ঙ্কর। এই ভেতরের রূপটা সহজে বাহিরের জগতে ধরা পড়ে না। দুয়েকটা যাহা ধরা পড়ে তাহা এলার্মিং রাজনীতিবিদদের জন্য। মনোনয়ন বাণিজ্য যতদিন চলিতে থাকিবে ততদিন ধান্ধাবাজ মনোনয়ন প্রার্থীদের টেকানো যাইবে না। কাজী নজরুল বলিয়াছিলেন-‘নিজের নাই মনুষ্যত্ব জানিনা কেমনে তারা, নারীর কাছে চায় সতীত্ব হায়রে শরম হারা’। এই লাইন দুইটাকে এইভাবে বলিলে কেমন হয়, নিজের নাই মানবতা জানিনা কেমনে তারা, জনপ্রতিনিধির টিকেট কিনে হায়রে শরম হারা। জিয়াউর রহমান কহিয়াছিলেন- ‘আমি রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি কঠিন করিয়া দিব’। নিঃসন্দেহে তিনি তাহা করিয়া গিয়াছেন। ইহা জাতির জন্য ক্ষতিকর একটি কাজ। রাজনীতি হইতে হইবে নিঃস্বার্থ, ব্যক্তি বিদ্বেষ হীন। আজ যত অনিয়ম, দুর্নীতি, লাঠালাঠি, লুঠোলুঠি ও খুনোখুনি’র পেছনে রহিয়াছে অপরাজনীতি তথা কলুষিত রাজনীতির তেলেসমাতি। দীর্ঘকাল ক্ষমতায় থাকা দলে সুবিধা ভোগীদের সুনামি ঠেকানো না গেলে একসময় ক্ষমতার কুরছি সেই সুনামিতে ভাসিয়া যাইবার প্রবল আশংকা থাকিয়া যায়। তাই লাজ-নীতি হীন রাজনীতির চর্চা প্রতিরোধ করিতে মহল্লা মহল্লায় সুশিক্ষিত যুবসমাজকে আগাইয়া আসিতে হইবে। সরকারকে সহযোগিতা করিতে হইবে। স্থানীয় প্রবীণ সমাজকে সম্পৃক্ত করিয়া দল মত নির্বিশেষে অসাম্প্রদায়িক সাংগঠনিক কর্মকান্ডের সূচনার মাধ্যমে রাজনীতির আকাশে সুবাতাস বহিবে বলিয়া আমার ধারণা।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট