মনাম এর বৈঠকখানা চাটার দল উইপোকার মতো খাচ্ছে উন্নয়নকে

47

মনসুর নাদিম

বড় বিবি গুলবদন আর ছোট বিবি মেহেরজান যেন শীতকালীন ঝগড়ায় নামিয়াছে। শীতের মৌসুম শেষ, লেকিন তাহাদের ঝগড়া খতম হইতেছেনা। মরদ আর আওরাতের ঝগড়ার মধ্যে বিস্তর ব্যবধান। মরদেরা ঝগড়া আরম্ভ হইতেই আস্তিন গুটাইয়া কুদিয়া আসে। ইহা কিন্তু বহুত পুরানা কালচার। আজকাল তো বাচ্চা বাচ্চা নাবালেগরাই মাশাহ আল্লাহ্ ঝগড়ার আগে ও পরে পিলে চমকানো অস্ত্র প্রদর্শন করিয়া থাকে। মাগার, আওরাতে আওরাতে ঝগড়া বড়ই মজাদার। যেন পালা গান আরম্ভ হইয়াছে। সেই পালাগানে শোনা যায়, বংশ, খান্দান, শিক্ষা-দীক্ষা ইত্যকার অবাঞ্চিত প্রসঙ্গ। আমার মকানে এক মাহিনা তক থামিয়া থামিয়া সেই পালাগান চলিতেছে। অনেকটা ভাদ্রমাসের রোদ বৃষ্টির খেলার মতো। দুইবিবির ঝগড়ার কায়দাও বড় খুবছুরত। আরম্ভ করিয়া থাকে কাজের বুয়া হারুর মাকে দিয়া। দুসরা বিবি ফওরান বুঝিয়া যায় কোনদিকের বাতাস কোনদিকে বহাইতেছে। ফলে সেও হারুর মাকে মাধ্যম বানাইয়া যাহাই মুখে আসিবে আনাব-সানাব বকিতে বিলকুল ক্লান্তিবোধ করে না। হারুর মাও উভয়ের নিয়ত ও আমল বুঝিয়া নিরীহ পাবলিকের মতো খামোশ হইয়া যায়। লেকিন ধীরে ধীরে হারুর মাকে ক্রস করিয়া সরাসরি আক্রমনে চলিয়া যায়। আমি তাহাদেরকে থামাইতে কোশিশ করি। লেকিন উল্টা আমিই তাহাদের রোষানলের শিকার হই। তাহাদের ঝগড়ায় সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হই আমি। আমাকে তাহারা দুইজনই তাহাদের প্রাইভেট প্রপার্টি বলিয়া মনে করিয়া থাকে। অন্তত তাহাদের আচরণে আমার তাহাই মনে হয়। ঝগড়া যখন সপ্তমে আমার কোশিশ ও যখন নাকাম হইয়া যায়, তখন আত্মরক্ষার্থে মকান হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া হাঁটিতে হাঁটিতে মসজিদের শান বাঁধানো ঘাটে বসিয়া পানির তরফ তাকাইয়া থাকি। বসন্তের মৃদু সমীরণে মুখেরদাঁড়ি গুলি হেলিয়া দুলিয়া নরসুন্দরের নিকট গমনের আবশ্যকতা স্মরণ করাইয়া দিতেছে। বাহিরে কোথাও বসিলে কেউ না কেউ আসিয়া বিরক্ত করিয়া থাকে। ইজ্জতের খাতিরে অনেককে মিথ্যা বলিয়া অন্তরে তওবা করিতে হয়। কারণ ঘরের অশান্তি হইতে পরিত্রান পাইতে শান্তির অন্বেষায় পুকুর পাড়ে বসিয়াছি তাহা তো পড়শিদেরকে কহিতে পারিতেছিনা। সুতরাং তাহাদেরকে কহিতেছি-একটু ফ্রেশ হাওয়া খাইতে বসিয়াছি। লেকিন আমি জানি বর্তমানে কোথাও ফ্রেশ হাওয়াও নাই। ঘরে-বাহিরে সর্বত্রই বাতাস দুষিত। আমার এই মসৃণ মিথ্যা কথায় অনেকে আমার পাশে বসিয়া স্বাস্থ্য বিজ্ঞান শ্রবনের আগ্রহ ব্যক্ত করিয়া থাকেন। তাহাদের কেমন করিয়া বোঝায় আমি স্বয়ং নিজ স্বাস্থ্য লইয়া শংকিত। তাহাদের ধারণা আমি এই বয়সেও তারুণ্য ধরিয়া রাখিতে সক্ষম। কথা কিন্তু মিথ্যা না। কোশিশও জারি রাখিয়াছি বার্ধক্যের জীর্ণ জড়তার পরশ যেন আমাকে কাবু করিতে না পারে। লেকিন সংসারে দুই বিবির ঝগড়া, শরীয়তি মারফতি কথা-বার্তা শুনিতে শুনিতে আমার হৃদ রোগ পয়দা হইয়া গিয়াছে। দুই জনের চাপাচাপিতে রক্তচাপ বাড়িয়া গিয়াছে। সাথে বাজার দর, ডাক্তারি ফিস, মোক্তারি ফিসও বাড়িয়া গিয়াছে। এইসমস্ত বাড়াবাড়ির সহিত তাল মিলাইয়া দাম্পত্য কলহও বাড়িয়াছে। গিন্নির চাহিদা , সংসারের চাহিদা মিটাইতে না পারিয়া অনেকের ল’বেজান দশা হইয়াছে। সদা হাস্যোজ্জ্বল সকিনার বাপের মুখের হাসি যেন কেহ ছিনতাই করিয়াছে। সকিনার বাপের ম্লান চিন্তিত মুখে এক নীরব বিদ্রোহের ভাব ফুটিয়া উঠিয়াছে। টিকা লইতে গিয়া তামামদিন রোদে খাড়াইয়া ফিরিয়া আসিয়া গায়ে জ্বর লইয়া মাস্টার সাহেব শয্যাশায়ী। শুনিয়া মনটা বেজার হইয়া গেল। সরকার অর্ধলক্ষেরও বেশি গৃহহীনদেরকে ঘর দিয়াছে। সমাজে অবহেলিত তৃতীয় লিঙ্গদেরকেও ঘর ও গবাদি পশু দিয়া পুনর্বাসন করিতেছে। সরকারের প্রশংসনীয় কাজে কতিপয় অমানুষ ঘর হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় অসহায় মানুষদের নিকট হইতে টাকা আত্মসাৎ করিয়াছে বলিয়া অভিযোগ পাওয়া যাইতেছে।করোনা কালে অনেকে ত্রাণ আর নগদ মাল চাটিয়াছে। এই চাটার দল বঙ্গবন্ধুর আমল হইতে বাপ-দাদার খানদানি অভ্যাস পরিত্যাগ করিতে পারেনাই। সরকারের চমৎকার কাজ গুলিতে ইহারা কলংকের কালি লেপন করিয়া দিতেছে, তাহাদেরকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানাইতেছি। সকিনার বাপ কহিয়াছিল, সরকার যদি কখনো পতিতাদের জন্য কিছু বরাদ্ধ দেয়, তবে এই বেশরম চাটার দলেরা সেই লিস্টে তাহাদের মা-বোনের নামও লেখিয়া দিতে বিলম্ব করিবে না। পুকুরের শান্ত জলরাশির তরফ তাকাইয়া নানান ছুরতের চিন্তার জট খুলিতে আরম্ভ হইল। মনটা স্বাধীনভাবে যত্রতত্র ছুটিয়া বেড়াইতেছে। জলের মৃদু কম্পনে নিজের প্রতিবিম্ব নৃত্য করিতেছে। তিনকুড়ি ওমরের কুঁচকে যাওয়া শেকলটা দেখিয়া বেহদ আফসোস হইল। অদূরে হোটেলের ডেক সেট হইতে একটা পুরানা হিন্দি গান ভাসিয়া আসিল- ‘দুনিয়ামে হাম আয়ে হে তো জি-না হি পড়েগা, জীবন হে আগর জহর তো পি না হি পড়েগা’ অসহ্য পেরেশানি ঠেলিয়া কিঞ্চিৎ হাসি পাইল। জিন্দেগী তো এমনিতেই জহর হইয়া গিয়াছে। সকিনার বাপ আসিয়া আমার পাশে বসিলেন। আমি জবরদস্তি মুখে হাসি টানিবার কোশিশ করিলাম, মাগার পারিতেছি না। জিন্দেগির আধা হিস্যা অন্যদের খোশ রাখিতে হাসি-খুশির অভিনয় করিয়াছি।দেখিতে দেখিতে শান বাঁধানো ঘাটের দুইপাশে আধা ডজন লোক জমা হইয়া গেল। একথা সেকথার পর সকিনার বাপ একটা গল্প আরম্ভ করিয়া দিল। মজমা জমাইতে সকিনার বাপের তুলনা হয় না কোন এককালে জনৈক গোয়ালা বাদশাহর জন্য রাজদরবারে গরুর খাঁটি দুধ সরবরাহ করিত। গোয়ালা যেন দুধে জল মিশাইতে না পারে তারজন্য বাদশাহ এক মন্ত্রীকে দায়িত্ব দিলেন। নতুন মন্ত্রীকে দায়িত্ব দেয়ার পর বাদশাহ দেখিলেন দুধ আগের চাইতে খানিকটা পাতলা হইয়া গিয়াছে। বাদশাহ ফওরান মন্ত্রীকে দরবারে তলব করিলে মন্ত্রী তাহার সাহায্যার্থে একজন প্রতিমন্ত্রী নিয়োগের অনুরোধ করিলেন।বাদশাহ মন্ত্রীর পরামর্শে একজন প্রতিমন্ত্রী নিয়োগ দিলেন। সেকালে রাজ-রাজড়াদের দরবারে প্রচুর মন্ত্রী ও ভাঁড় থাকিত। সুতরাং শাহী মন্ত্রী সভায়ও একই মন্ত্রীর একাধিক মন্ত্রণালয় সহ দপ্তর বিহীন মন্ত্রী সেই প্রাচীনকাল হইতেই ছিল। যাহা হোক, প্রতিমন্ত্রী নিয়োগের পর বাদশাহ দেখিলেন, বাদশাহকে সরবরাহকৃত দুধ আগের চাইতে আরও খানিকটা পাতলা হইয়া গিয়াছে। বাদশাহ এইবার প্রতিমন্ত্রীকে তলব করিলেন। প্রতিমন্ত্রী হাতজোড় করিয়া বাদশাহ আলামপনার নিকট আরজ করিলেন, গোয়ালার পেছনে একজন চৌকিদার নিয়োগ করিতে। যাহাতে সে দুধে আর জল মিশাইতে না পারে। বাদশাহ এইবার প্রতিমন্ত্রীর পরামর্শে গোয়ালার পেছনে এক চৌকিদার নিয়োগ দিলেন। গ্রেফ খাঁটি দুধ পাইবার আশায় একই মন্ত্রনালয়ে চারজনকে নিয়োগ দিলেন। এই চারজনের জোটে রহিয়াছে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, চৌকিদার ও গোয়ালা। পরদিন বাদশাহ ফুরফুরে মেজাজে দুধের বাটিতে চুমুক দিতেই বাটিতে একটি গলদা চিংড়ি আবিষ্কার করিলেন। জাহাঁপনার শাহী গোস্বা চেতিয়া উঠিল। ফওরান গোয়ালাকে রাজ দরবারে হাজির হইতে হুকুম জারি করিলেন। যথা সময়ে শীর্ণ বস্ত্রে কাঁপিতে কাঁপিতে রাজ গোয়ালা দরবারে হাজির হইল। বাদশাহ তাহাকে দুধে গলদা চিংড়ির তামাম ওয়াকেয়া বয়ান করিয়া তাহার ফেরেববাজির জন্য তাহাকে কতলের হুকুম দিলে রাজগোয়ালা আসন্ন মৃত্যুর ভয়ে হাউমাউ করিয়া কহিল-জাহাঁপনা আমার গরুগুলি দৈনিক দশ কেজি দুধ দেয়। যার পুরোটাই আপনার খেদমতে পেশ করা হতো। লেকিন যেইদিন আপনি একজন মন্ত্রীকে দায়িত্ব দিলেন ঐদিন মন্ত্রী মহোদয় আমাকে কড়া হুকুম দিলেন, রোজ পাঁচ কেজি দুধ যেন তাহার মকানে পৌঁছায়ে দিই। হুজুর সেই পাঁচ কেজির ঘাটতি পুরাইতে দুধের সহিত পাঁচ লিটার জল মিলাইতে বাধ্য হইলাম। তারপর আপনি যখন প্রতিমন্ত্রী নিয়োগ দিলেন সেই প্রতিমন্ত্রী আমার মকানে গিয়া হুমকি-ধামকি দিয়া কহিলেন-রোজ তাহার মকানে যেন দুই কেজি করিয়া দুধ দিয়া আসি।
জাহাঁপনা আমি গরীব লাচার মানুষ। বুঝতেই পারছেন মন্ত্রীর পাঁচ কেজির সহিত প্রতিমন্ত্রীর দুই কেজি মোট সাত কেজির দুধ আপনার বরাদ্দ দুধ হইতে নিকালিতে হয়। তারপর আমার পেছনে চৌকিদার লাগাইয়া নয়া মসিবত খাড়া করিয়া দিলেন। ব্যাটা লুইচ্চ্যা লাফাঙ্গা পহেলা দিনই আসিয়া হাতের ডাÐা দিয়া কয়েক ঘা লাগাইয়া আমাকে শাসাইয়া দিল যাহাতে দুধে পানি না মিলাই। পরক্ষণে মুচকি হাসিয়া কহিল, তাহার মকানে রোজ এককেজি দুধ পৌঁছাইয়া দিতে পারিলে তামাম মামলা ঠিক চলিবে। হুজুর আমি তাহাকেও রাজি রাখিতে নিরুপায় হইয়া আপনার জন্য বরাদ্দকৃত দুধ হইতে এক কেজি দুধ তাহাকেও দিতে লাগিলাম। ইহার ঘাটতি পুরাইতে নিরুপায় হইয়া দুধের সহিত আট কেজি জল মিশাইয়া থাকি।জাহাঁপনার দরবারে আমার আরজ, দয়া করিয়া মন্ত্রী, চৌকিদার আর বাড়াইবেন না। নতুবা গলদা চিংড়ির সহিত দুধের বাটিতে রুই কাতলাও আসা আরম্ভ হইবে। সকিনার বাপ কথা শেষ করিয়া আমার তরফ চাহিলেন। আমি চেহেরা হইতে ক্লান্তির ছাপ সরাইয়া মিটি হাসা চেহেরা করিলাম। কারণ পাছে আবার সকিনার বাপ যেন আমার চেহেরা পড়িয়া না ফেলেন। তাহা হইলে শান বাঁধানো ঘাটে শাইন করিয়া বসিয়া থাকিবার তামাম পোল খুলিয়া যাইবে। যাহা হোক, সকিনার বাপের এই চাহনির অর্থ হইল, আমি তাহার গল্পের সারমর্ম বুঝিতে পারিয়াছি কিনা । সুতরাং আমার বোধগম্যতার স্বীকারোক্তি সরাসরি না করিয়া আল্লামা ইকবালের একটা মশহুর শেয়ের এর দুইটি লাইন আবৃত্তি করিলাম- ‘হার শাঁখ মে উল্লু বেইঠা তো আঞ্জাম ই গুলিস্তা কিয়া হোগা’।

লেখক : প্রবাসী সাংবাদিক ও কলাম লেখক