মনাম’র বৈঠকখানা সুরত আলীর ইলেকশন !

51

মনসুর নাদিম

কমিশনার পদে খাড়া হইয়াছে সুরত আলী। ইলেকশন মৌসুম আসিলেই লোকে সুরত আলীর সুরত দেখিবার মওকা পাইয়া থাকে। পাঞ্জেগানা নামাজ মহল্লার মসজিদেই পড়ে। ধুপদুরস্ত পায়জামা পাঞ্জাবি মাথায় টুপি। নরম নরম মিঠা জবানে হামদরদী সুরে চেনা অচেনা তামাম লোকের সহিত কথা বলিয়া থাকে। বিলকুল বদলিয়া যাওয়া এই সুরত আলীকে চেনা বড়ই মুশকিল হইয়া পড়ে। ভোটের বাদে কোথায় টুপি, কোথায় পাঞ্জাবি ? কোট, টাই পিন্দানো অচেনা সুরত আলী হাপ্তা মাহিনা বাদে নজরে আসে। মিঠা কথা ভোটের বাদে কোটের অন্দরে গায়েব। কাহারো তরফ নজর করিবার তেমন ফুরসৎ মিলেনা। যাই হোক, সুরত আলীর এই জিন্দেগানির সুরত দেখিতে দেখিতে আমি ফিদা হইতে না পারিয়া সাদা হইয়া গিয়াছি। গেল বারও সুরত আলী একই তরিকায় ভোটে খাড়াইয়াছিল। রাস্তাঘাট, মশা, গ্যাস সংকট কিছুতে হাত না দিয়া দাপটের সহিত সময় পার করিয়াছিল। মাগার নিজের পুরানা মকানটায় মোজাইক পাথর লাগাইয়া তাজমহল বানাইয়াছে। যাহা হোক, কয়েকদিন আগে জুমার নামাজে আচানক সুরত আলীর সহিত আমার দেখা। সালাম করিয়া এমন জোরে জড়াইয়া ধরিল যে সামান্যের জন্য আমার চশমাটা বাঁচিয়া গিয়াছিল। অনেকক্ষণ জড়াইয়া ধরিল। হাতের লাঠিটা ডান কদমের পাতার ওপর চাপিয়া বসিল। চশমা আর টুপি তেরছা হইয়া গেল। করোনা কালে ইহা আমার বিলকুল পছন্দ না হইলেও তাহার তো করোনা কে ঠেলিয়া করুণা চাওয়ার দশা। এক অস্বস্থিকর নাটক যেন আরম্ভ হইল মসজিদের বারান্দায়। মনে হইল আমার দুনিয়া দেখানে ওয়ালে আব্বাজান কিংবা পেয়ারের বেটা বেটিরাও এই ছুরতের মোহাব্বতের সহিত সিনার সহিত কখনো এতক্ষণ লাগাইয়া রাখেন নাই। আমার মত অনেকেই জানে ইহা সুরত আলীর পুরানা আদত। সকিনার বাপ কহিয়া থাকে নেতা আর অভিনেতার মধ্যে খুব একটা পার্থক্য নাই। একজন পয়সার জন্য অভিনয় করে তো অন্য জন ক্ষমতার জন্য অভিনয় করে। সুরত আলীরা এই ছুরতের ড্রামাবাজ হইয়া থাকে ইহাতে বিলকুল আন্দেশা নাই। আমার পাশে আকবর মিয়া খাড়াইয়া মিটি মিটি হাসিতেছে। চার-পাঁচ মিনিটের মাথায় সুরত আলীর কবজা হইতে আজাদ হইলাম বটে মাগার তাহার তেলেসমাতি কথা হইতে নিষ্কৃতি পাইলাম না। সুরত আলী তাহার নির্বাচনী কথা-বার্তা গরগর করিয়া বয়ান করিতেছে আর নাবালক মিয়া ঘন ঘন মস্তক দোলাইয়া হ্যাঁ হু করিয়া তাহাকে সমর্থন করিতেছে। সুরত আলীর অসম্পূর্ণ কথা নাবালক মিয়া খুব ছুরত করিয়া সম্পূর্ণ করিতেছে। ইহা নাবালক মিয়ার আদত। এই সমস্ত সুরত আলীদের সহিত দুয়েকজন নাবালক মিয়া থাকেই এটা এই মুল্লুকের অতি পুরাতন কালচার।এক ডজন নাত-নাতনির দাদা-নানা বনিয়া চুল দাঁড়ি পাকিয়া সাদা হইয়া গিয়াছে তবুও নাবালক মিয়া নাবালক নামেই পরিচিত। আমার হাসি পায়, এইছুরতের বে-আক্কলি নাম যাহারা রাখে তাহাদের সোহাগের স্থুলতার বহর দর্শনে। আমাদের মুল্লুকে এই কিসিমের বহুত নাম আছে যাহা মানুষের বয়সের সহিত একসময় সামঞ্জস্যহীন হইয়া পড়ে। কোন আমলে বাচ্চার নাম রাখিয়াছে লেদা বাছা। সেই লেদাবাছা এক সময় জওয়ান হইয়া বিবাহ-শাদী করিয়া ঘর সংসার করিল। আওলাদ ফর্জন্দ নাত নাতনি হইয়া বুড়া বাছা বনিয়া একটা দুইটা দাঁতও পড়িয়া গেল লেকিন আজতক তাহার নাম লেদা বাছাই রহিয়া গেল। নাম রাখিতে গিয়া ভাবিয়া চিন্তিয়া খুব অল্প লোকই নাম রাখিয়া থাকে। কাগজে একবার একটা ঘটনা পড়িয়া হাসিতে হাসিতে দম আটকাইয়া যাইবার উপক্রম হইয়াছিল। একজন সৌদি বাঙালি প্রবাসী রিয়াদ বিমান বন্দরে গেলে কাস্টম অফিসার পাসপোর্টে তাহার নাম দেখিয়া তাজ্জব বনিয়া গেলেন । কারণ তাহার নাম ছিল ‘জামাল মিয়াঁ’। আরবিতে জামাল অর্থ উট, আর মিয়াঁ অর্থ একশত। সেই হিসাবে তাহার নামের অর্থ দাঁড়ায়-‘একশত উট’। আরবি কাস্টমস কর্মকর্তা মজা করিয়া কহিল-একশত উট কোথায় ? আমার সামনে তো একটা উটই দাঁড়ানো।
নামের অর্থ ও প্রেক্ষাপট না জানিয়া নাম রাখাই সবচাইতে বড় বদনাম। অনেকে আবার নাম রাখিয়া থাকে- জনি, জ্যামি, রিসি, জেসি ইত্যাদি বিলাতি কুত্তার নাম।যাহা হোক, সুরত আলী বহুত হামদরদী সুরে জিজ্ঞাসা করিল, আমার তরফ হইতে মহল্লার কোন খেদমতের প্রস্তাব আছে কিনা। আমিতো জানি ইহা গ্রেফ তাহার মক্করবাজি। প্রতিবার সুরত আলী ভোট চাহিতে আসিলে মনে মনে বলি-গতস্য শোচনা নাস্তি। এইবারও ব্যাতিক্রম হইলনা। সুতরাং বড় কোন কাজের কথা না কহিয়া গ্রেফ মশার জুলুম হইতে মহল্লাবাসীকে নিষ্কৃতি দিতে কহিলাম। সাথে সাথে আকবর মিয়াও আমাকে সমর্থন করিল। রাতে দিনে এই মচ্ছড় বাহিনীর আকবরি জুলুছ সমানতালে জারি রহিয়াছে। দিনে-দুপুরেও অনেকে মচ্ছড়দানির অন্দরে বসিয়া খানা পিনা খাইতেছে।গেল রমজান মাসে জোহরের নামাজ পড়িয়া মকানে আসিয়া তাজ্জব বনিয়া গেলাম। দেখিলাম গুলবদন আর মেহেরজান মশারীর অন্দরে বসিয়া কোরআন তেলাওয়াত করিতেছে। মনে করিলাম তাহারা এতেকাফ লইয়াছে। লেকিন আমার বিনা এজাজতে তাহারা এতেকাফ লইবেনা। আর দুইজনই একসাথে এতেকাফ লইলে তো আমাকে চিল্লায় যাইতে হইবে। চিল্লায় যাই আর গোল্লায় যাই হিম্মৎ করিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম-বেগম সাহেবারা কী এতেকাফ লইয়াছেন ? তাহারা জবাব দিল- এতেকাফ নয় হুজুর, মচ্ছড়কাফ। মশার জুলুম হইতে বাঁচিতে এই ফন্দি করিয়াছি। আমি আফসোসের হাসি দিলাম। আমি মশারির অন্দরে থাকিতে পারিনা। মশার কয়েলই আমার ভরসা। মশারির ভেতর গেলেই আমার গ্রেফ কবরের কথা মনে পড়ে। তাহা ব্যতীত মশারি হইতে বাহির হইতে ঢুকিতে মশারি মাথায় গায়ে লেপটাইয়া যায়। মশারির আদরে ঝাপ্টাইয়া ধরা হইতে নিজেকে সহজে ছাড়াইতে পারিনা। হাত ছাড়াইলে মাথা আটকায়, মাথা ছাড়াইলে কাঁধ আটকায়।
গোটা বছরই করোনা। চাকরি ব্যবসা তামাম সেক্টরে মন্দাভাব। ব্যাংক ঋণ এনজিও ঋণ যাহারা নিয়াছিল এখন তাহারা চোখে সর্ষেফুল দেখিতেছে। কাহারো ঋণ খেলাপির তকমা লাগিতেছে। কাহারো বাড়ি-ঘর নিলাম হইবার জোগাড়।করোনা’র জন্য দীর্ঘ দশ মাসের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। সতর্কতা অবলম্বন করিতে যাইয়া শিশুদের মোবাইল প্রীতি বাড়িয়া গিয়াছে। অনলাইন ক্লাশের জন্য দরিদ্র পরিবারগুলো ধার-কর্জ করিয়া শিশুদেরকে স্মার্ট ফোন কিনিয়া দিয়াছেন। এখন পড়ার চাইতে শিশুরা গেইমের প্রতি বেশি উৎসাহিত হইয়া পড়িয়াছে। সকিনার বাপ কহিলেন, তাহার দুই নাতি তামাম দিন মোবাইল দখলের জন্য মারামারি করিয়া থাকে। এইদিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় খতরনাক ছুরতে কিশোর গ্যাং মাথা চাড়া দিয়া উঠিয়াছে। এই লেখা যখন লেখিতেছি তখন কাগজে পড়িলাম, লালখান বাজার সংঘর্ষে কিশোর গ্যাং লিডার শরীফ গ্রেপ্তার। ইহা নির্বাচনকে কেন্দ্র করিয়া। ইতোপূর্বে পাঠান টুলিও আওয়ামীলীগের দুই গ্রæপের সংঘর্ষে দুইজন নিহত হইয়াছে। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে কেন্দ্র করিয়া বিরোধী পক্ষ বিদ্রোহী পক্ষ যেই ছুরতে লাঠালাঠি আরম্ভ করিয়াছে তাহাতে মনে ভয় ধরিয়া গিয়াছে। পান চিবাইতে চিবাইতে সেইদিন মাস্টার সাহেব কহিলেন, স্থানীয় নির্বাচনটাকে অন্তত রাজনীতিমূক্ত রাখা উচিৎ ছিল। প্রথম ২০১৬ সালে স্থানীয় নির্বাচনকে দলীয়ভাবে করার সিদ্ধান্ত হইয়াছিল। মুরুব্বি সকিনার বাপ কহিলেন, স্থানীয় প্রতিনিধি স্থানীয়রাই বাছিয়া লইবেন। ইহাতে সরকারের নিরপেক্ষতা বজাইয়া থাকিত। কোন কোন জায়গায় এমনও ঘটিয়াছে সুরত আলীদের মতো অযোগ্য লোকেরা বার বার মনোনয়ন পাইয়া শিক্ষিত সমাজের মস্তকের ওপর ছড়ি ঘুরাইতেছে। আফসোস ! দলীয় মনোনয়নে কোন তেলেসমাতির ভানুমতির খেলায় সুরত আলীরা কোন সেবা না করিয়া সেবকের তাজ পিন্দিয়া নির্লজ্জের মতো ঘুরিয়া বেড়ায়। বিদ্রোহী প্রার্থী দমনের কথা যতই বলা হোক, বিদ্রোহী প্রার্থী কয়জনে সরিয়া খাড়াইয়াছে ? বরং অধিকাংশের ছুরতে হাল ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সুচাগ্র মেধিনী’। ফলে দল ক্ষতিগ্রস্ত হইতেছে। নিজেরা নিজেদের মধ্যে মারামারি রক্তপাত করিয়া নির্বাচনী পরিবেশটাকে কুরুক্ষেত্র বানাইয়া দিলে ভোটারেরা হিম্মৎ হারা হইয়া গৃহকোণে অবস্থান করিবে। আমরা চাই জনগণ নির্ভয়ে ভোট কেন্দ্রে আসুক তাহাদের রায় তাহাদের পছন্দের প্রার্থীকে দিয়ে আদর্শ সমাজ গঠনে তাহাদের গণতান্ত্রিক ভূমিকা রাখুক। সুরত আলীদের টেকাইতে স্থানীয় নির্বাচন স্থানীয়ভাবে করার বিকল্প নাই।

লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক