মধ্যবিত্ত-কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি

27

বাসুদেব খাস্তগীর

মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের জীবনের গল্প এখন শুধু গল্প নয়, যেন জীবনের এক নিদারুণ এক বাস্তবতার গল্প। যে গল্পের পরতে পরতে শুধু হাহাকার আর হাহাকার। তারা যেন সমাজে একাকী এক শ্রেণির মানুষে পরিণত হয়েছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের এক ধরনের আত্মসম্মানবোধ থাকে। জীবনে নানা কষ্টের মধ্যে চললেও তারা সহজে হাত পাততে পারেন না। এই সমাজে বরাবরই মধ্যবিত্তরা নানা চাপের মধ্যে থাকে। করোনা মহামারিতেও তারা ছিল প্রচÐ চাপের মধ্যে। ঐ সময়ে নিম্নবিত্তরা পেয়েছে নানা সাহায্য-সহযোগিতা এবং এ সহযোগিতা ছিল বহুমুখী। কিন্তু মধ্যবিত্তের সে সময় অন্তরালেই ছিল। মধ্যবিত্তের শ্রেণির লোকদের দুঃখ সহজে কেউ বোঝে না। সেসময় উচ্চবিত্ত শ্রেণির খাদ্যপণ্য, চিকিৎসা ও ওষুধ ব্যবসায়ীরা লাভবান হয়েছিল ব্যবসা করে। কিন্তু সে সময় অনেক পরিবারকে শহর ছাড়তে হয়েছিল এবং অনেকেই হয়েছিল চাকরিহারা। যাদের অধিকাংশই ছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। তারাই আবার সংকটের মুখোমুখি। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মধ্যবিত্তের জীবন এখন দুর্বিষহ। তাদের জীবন যেন আর চলছে না। জীবনের ঘানি টানতে গিয়ে প্রতিনিয়ত তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। মধ্যবিত্ত নামটি যেন এখন প্রতিনিয়ত হাহাকার করা এক নাম। সংসার নামক বিশাল এক প্রতিষ্ঠানের ঘানি টানতে গিয়ে অকূল সাগরে ভাসতে ভাসতে কূলের দিশাই পাচ্ছে না মধ্যবিত্ত। কয়েক বছর ধরে নিত্যপণ্যের লাগামহীন দাম বৃদ্ধি জনজীবনকে করে তুলেছে অতীষ্ঠ। যার প্রভাব মধ্যবিত্তের ঘাড়েই বেশি। মধ্যবিত্তরা না পারছে ওপরে যেতে না পারছে নি¤েœ যেতে। তারা এ সমাজে উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্তের মাঝমাঝি থেকে এক ধরনের প্রচÐ চাপ ও মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে দিনাতিপাত করছে। করোনা পরবর্তী বিশ্ব প্রেক্ষাপট ও রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ সারা বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছে, যেখানে সবচাইতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকেরা। যাঁরা সমাজে একটু আত্মসম্মানবোধ নিয়ে জীবনযাপনে অভ্যস্ত, সেখানে তাদের অবস্থানটা বড়ই নাজুক। উচ্চবিত্ত শ্রেণির লোকদের বৈশ্বিক মন্দা পরিস্থিতি জীবনযাপনে তেমন প্রভাব ফেলে না। একেবারে নিম্নবিত্ত শ্রেণির লোকেরা হয়তো কিছু কষ্টে পড়েন, কিন্তু সামাজিক অন্যান্য দায়বদ্ধতা থেকে তারা কিছুটা মুক্ত বলে মধ্যবিত্তের মত তেমন কঠিন জীবন সংগ্রামের মুখোমুখি হন না। মধ্যবিত্তকে সামাজিক অনেক দায়দায়িত্ব পালন করতে হয়। নিজের জীবনের প্রয়োজন মিটিয়ে সেসব দায়িত্ব পালন আজ কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি। এদেশে একসময় জিনিসপত্রের দাম বাড়লে এক ধরনের হই হই রই রই পড়ে যেত। পত্রিকা মিডিয়ায় কত আলোচনা। কত জনের কত জবাদিহিতা। এখন পরিস্থিতি যেন সম্পূর্ণই পাল্টে গেছে।
জবাবদিহিতার কোনো বালাই নাই। কারো কোনো জোরালো প্রতিবাদ নেই। যে যার মত কারণ ছাড়াও জিনিসপত্রের দাম বাড়ায়। আজকে এক ধরনের দাম হলে সে জিনিসের দাম কালকে অন্যরকম। বাড়তি টাকার পরিমাণটা একটাকা দুই-টাকা নয়। রীতিমত দাম এক ধরনের দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতা। সামান্য একটা অজুহাত পেলেই দাম বাড়ানোর হিড়িক। বিশ্ববাজারে দাম কমে গেলে এখানে দাম কমে যাওয়ার উদাহরণ অনেক কম। কিছুদিন আগে বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমে গেলেও এদেশে এমন হারে তেলের দাম কমানো হয় যার সুফলভোগিরা হলেন উচ্চবিত্ত ও মালিক শ্রেণিরা। যার সামান্য সুবিধাও এদেশের মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্তরা পাননি। মানুষের মধ্যে চেতনাবোধ ও প্রতিবাদের ভাষা যেন ক্রমাগত লোপ পাচ্ছে। অযথা ঠুনকো অজুহাতে দাম বাড়ানো ব্যক্তিদের কোনো জবাবদিহিতার আওতায় আনা যায় না। মাঝে মাঝে বিক্ষিপ্তভাবে এদিক ওদিক অভিযানের কথা শোনা যায়, পরে সে দৃশ্য আবার তিমিরেই মিলিয়ে যায়। দেশের সাধারণ মানুষ যারা একটু মানসম্মানের সহিত জীবন যাপনে অভ্যস্ত; যারা সামাজিক দায়িত্ব পালনে নিবেদিত, যারা সন্তান সন্তদির পড়ালেখায় নিজেকে সমর্পণ করেন তাদের জীবনতো এখন দুর্বিষহ এক জীবনেরই নাম। চাকুজীবীদের বেতনভাতা স্থির রয়েছে অনেকদিন। দেশের যে সময়ের আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করে বেতনস্কেল নির্ধারণ করা হয়েছিলো সে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এখন দেশে নেই। যে হারে বছরে ইনক্রিমেন্টে বেতন বাড়ে, তার চেয়ে কতগুণ হারে যে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে প্রতিনিয়ত তার হিসাব কে রাখে? আর ব্যবসাতো এখন একশ্রেণির মানুষের হাতে নিয়ন্ত্রিত। সেখানে ছোটখাটো অনেক ব্যবসায়ীরা ঠাঁই করে নিতে পারছেন না। বর্তমানে রাইড শেয়ারিং ব্যবসায় নিয়োজিত অনেকের জীবনের গল্প শুনে অবাকই হই। কেউ চাকরিহারা, কেউ ব্যবসাহারা হয়েই জীবনে এ পেশাকে তারা বেছে নিয়েছেন। আসলে দেশে মধ্যবিত্তের জীবন কঠিন এক বাস্তবতার মুখোমুখি। হাহাকার করা মানুষের বেদনা বুঝার জন্য দেশে যেন কেউ নেই। এদেশে সময়ে সময়ে দেখা যায় বাজারে এক একটা পণ্য নিয়ে একেক ধরনের ফটকাবাজি ব্যবসা। কখনও পেঁয়াজ, রসুন, আদা, সয়াবিল তেল, লবণ, চাউল নিয়ে নানান তেলেসমাতি কাÐ। আবার কখনও দেখা যায় কোনো ঔষধ, ডিম,আটা বা চিনি নিয়েও নানা কারসাজি। হঠাৎ বাজার থেকে পণ্য উধাও হবার গুজব। ফলে বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ানোর হিড়িক। মাঝখানে কিছু ব্যবসায়ীদের পোয়াবারো-আঙুল ফুলে কলাগাছ। পরিমাণে হয় সাধারণ মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের পকেট কাটা ও স্বাভাবিক জীবনযাপনে নাভিশ্বাস। এভাবে ক্রমাগত মধ্যবিত্তের জীবন হয়ে উঠছে কঠিন থেকে কঠিনতর। তাছাড়া আছে বছর শেষে বাড়িভাড়া বৃদ্ধি। বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানির বিলও বাড়ছে সমান তালে। সন্তানদের স্কুলের বেতন, কোচিং ফ্রি, প্রাইভেট পড়ানোসহ পড়াশোনায় চলে যায় মোট আয়ের অধিকাংশ টাকা।
এছাড়া পরিবহন ব্যয়, ডিশ সংযোগ বিল, ওয়াইফাই বিল, মোবাইল খরচতো আছেই। আর গৃহকর্মীর মজুরিও বাড়ছে প্রতিনিয়ত। বাসায় ময়লা পরিষ্কার ওয়ালাকে দিতে হয় অতিরিক্ত টাকা। মাসের শুরুতে বেতন পেয়েই এসব ব্যয় মেটাতে মেটাতে সঞ্চয় সোনার হরিণই হয়ে যায়। অসুস্থ হয়ে যদি কেউ ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া লাগে তাহলে তো কথাই নেই। ডাক্তারের ভিজিট, টেস্ট, ঔষধ মিলে ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা। জীবনের সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে চলছে মধ্যবিত্তের জীবন। মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ এখন খুব মনোকষ্ট নিয়ে দিন পার করছে। তাদের জীবনের প্রাণখোলা হাসি যেন কবেই মিলিয়ে গেছে। নিউইর্য়ক ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান মার্সার চলতি বছরের কষ্ট অব লিভিং সার্ভে-২০২২ শীর্ষক এক জরীপে বিশ্বের ব্যয়বহুল নগরী নির্ধারণে পৃথিবীর বিভিন্ন শহরের প্রায় ২০০টি পণ্য ও সেবার মূল্য গণনা করে দেখিয়েছে যে বিশ্বের ২০০ শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান ৯৮ তম। ঢাকা শহর বা সার্বিকভাবে বাংলাদেশে এর সবগুলোই শহরই এখন ব্যয়বহুল নগরী। গত ২১ অক্টোবর ২০২২ দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার এক প্রতিবেদনে সিপিডি এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, ‘শুধু আমদানি পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি নয়; দেশের অভ্যন্তরে উৎপাদিত জিনিসপত্রের দামও বাড়ছে। মাছ-মাংস না খেয়ে ঢাকা শহরে চার সদস্যের এক পরিবারের এখন খাবার কিনতে মাসে গড়ে ৯ হাজার ৫৯ টাকা খরচ করতে হয়। মাছ-মাংস খেলে ওই পরিবারের খাবারে খরচ হয় ২২ হাজার ৪২১ টাকা। এটি চলতি বছরের অক্টোবর মাসের হিসাব। গত পৌনে চার বছরে খাবার কেনায় ওই সব পরিবারের খাবার খরচ ২৭ থেকে ৩৮ শতাংশ বেড়েছে।’ এর প্রভাব শুধু শহর নয় গ্রামগঞ্জেও এর বিরূপ প্রভাব বিদ্যমান। ওই দিন পত্রিকার মূল প্রতিবেদনে পোশাক শ্রমিক, গাড়ির মিস্ত্রি, বেসরকারি চাকরিজীবী, কৃষক ও মাস্ক বিক্রেতা নামে পাঁচ পেশার লোকের জীবযাত্রা বিশ্লেষণ করে দেখানো হয় তাদের পরিবারে ব্যয় বৃদ্ধির কারণ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, সন্তানের পড়াশুনার খরচ বৃদ্ধি, যাতায়ত ভাড়া বৃদ্ধি, পরিবারে অসুস্থতা, নাশতার বাড়তি দাম, বাসাভাড়া বৃদ্ধির মত কারণগুলো যুক্ত হয়ে জীবনযাত্রায় অনেক কাটছাঁট করে এখন চলতে হচ্ছে। এজন্য তাদের অনেকেই আজ বাজার ব্যয় কমিয়েছেন, ছুটির দিনে বেড়ানো বাদ দিয়েছেন, স্বজনদের বাড়িতে কম যান, মাছ-মাংস খাওয়া প্রায় বাদ দিয়েছেন, ফল কেনেন না, নিমন্ত্রণ এড়িয়ে চলেন, চা-নাস্তা খাওয়া বাদ দিয়েছেন, রিকশা বাদ দিয়ে হেঁটে চলার মত সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রাত্যহিক জীবনে ঠিকে থাকার লড়াই করে যাচ্ছেন। অথচ এই মানুষদের বাদ দেওয়া বিষয়গুলো ছিলো প্রাত্যহিক জীবনেরই অপরিহার্য অনুষঙ্গ। আর আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা খুবই সুযোগ সন্ধানী। উৎসব যেমন ঈদ, রোজা, পূজা, কিংবা ঋতু ভিত্তিক সময় শীত, বর্ষা, গরম যে কোন উপলক্ষেই ব্যবসায়ীরা জিনিস-পত্রের দাম বাড়িয়ে দিতে সময়ক্ষেপণ করেন না। মানুষের মৌলিক চাহিদা হচ্ছে অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থান। এই মৌলিক চাহিদাগুলো মিটিয়ে একটু বিনোদন কিংবা বিলাসিতার সুযোগ খুঁজবে সেই পথ খোলা নেই। মধ্যবিত্তের জন্য নিত্য প্রয়োজনীয় অনেক খাবার এখন বিলাস দ্রব্যে পরিণত হয়েছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষকে প্রতিনিয়ত হিমশিম খেতে হচ্ছে আয়-ব্যয়ের হিসাব মিলাতে। চাওয়া পাওয়ার যন্ত্রণা লুকাতে লুকাতে তার পিঠ দেয়ালে ঠেকে যাচ্ছে। ব্যয় অনুপাতে একজন ব্যক্তির আয় বৃদ্ধি পাওয়া প্রয়োজন। যদি তা না হয় তাহলে তার জীবনযাপন কখনও স্বস্তিদায়ক বা স্বাচ্ছন্দ্যের হবে না। এজন্য মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির আয় বৃদ্ধির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি ধনী-দরিদ্রের পাহাড়সম আয় বৈষম্যও দূর করা জরুরি। আয় বৈষম্য কমানোর জন্য ধনীক শ্রেণির কাছ থেকে সঠিক পন্থায় কর আদায় করে জনগণের কল্যাণের জন্য ব্যয় করার পদক্ষেপ নিতে হবে। মধ্যবিত্তকে অর্থনীতির এই কঠিন সময়ে নানা সম্মানজনক প্রণোদনার আওতায় এনে বেঁচে লড়াইয়ে সমর্থন যোগাতে হবে। জনপ্রিয় লেখক হুমায়ুন আহমেদের বলেছিলেন, ‘মধ্যবিত্তদের সুখে থাকার প্রতিনিয়ত অভিনয় করে যেতে হয়।’ উক্তিটিতে আবেগ আছে। সাথে আছে নিধারুণ বাস্তবতা। বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের সাথে অন্য শ্রেণির মানুষের জীবনধারার যে অসমতার সৃষ্টি হয়েছে দূরীভুত করতে উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
লেখক : অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক ও শিশুসাহিত্যিক