মধু পূর্ণিমা : দান ও সেবার অত্যুজ্জ্বল প্রেরণা

44

 

বৌদ্ধ ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় প্রতিটি পূর্ণিমা তিথি প্রত্যেক বৌদ্ধের কাছে স্বমহিমায় চিরভাস্বর। প্রতিটি পূর্ণিমার সাথে বুদ্ধের জীবন দর্শনেরও সুনিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। তেমনি মধু পূর্ণিমা বৌদ্ধদের কাছে অবিস্মরণীয় ও অন্যতম একটি ধর্মীয় উৎসব। বুদ্ধের সময়ে কোশাম্বীর ঘোষিতারামে বহু সংখ্যক বৌদ্ধ ভিক্ষু অবস্থান করতেন। এসময় বিনয়ধর পন্থী ও সূত্রধর পন্থী ভিক্ষুদের মধ্যে বিনয় সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে তীব্র মতদ্বৈততা চলে আসছিল। এদের নেতৃত্বে ছিলেন সূত্রে পারদর্শী একজন এবং আরেকজন বিনয়ে পারদর্শী ভিক্ষু। এ বিতর্ক চরম আকার ধারণ করলে তথাগত বুদ্ধ স্বয়ং এ বিতর্ক নিরসনের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন।উভয় দল তাঁদের স্ব স্ব পক্ষে অনড় অবস্থানে থাকলে বিবাদ মীমাংসার উদ্যোগ নিঃস্ফল হয়ে দাঁড়ায়। এমতাবস্থায় বুদ্ধ কোশাম্বী ত্যাগ করে পারিলেয়্য বনে গিয়ে দশম বর্ষাবাস পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। পারিলেয়্য বনে অবস্থানকালে এক একাচারী হাতি বুদ্ধের সেবায় এগিয়ে আসে এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে বনের ফল ফলাদি সংগ্রহ করে প্রতিনিয়ত বুদ্ধকে দান করত যা দান ও সেবার মহিমাকে সমুজ্জ্বল করেছিল। এ ধরনের দানের দ্বারা হস্তীরাজ কর্তৃক বুদ্ধকে সেবা করতে। দেখে বনের এক দলছ্যুট বানরের মনেও এভাবে দানীয় কাজে অংশ গ্রহণের অভিলাষ জাগে। দানীয় চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে বানরটি ভাদ্র পূর্ণিমা তিথিতে একটি মৌচাক সংগ্রহ করে বুদ্ধকে দান করল। মৌচাকে মৌমাছির ডিম ও ছানা থাকার কারণে বুদ্ধ মধু পান করতে না পারার বিষয়টি অনুধাবণ করে সে মৌচাকটি নিয়ে ছানা ডিম পরিষ্কার করে পুনরায় বুদ্ধকে দান করল। এবার বুদ্ধ বানর প্রদত্ত মধু স্বাচ্ছন্দ্যে পান করলেন। বুদ্ধের মধুপান স্ব চক্ষে অবলোকন করে বানর আনন্দচিত্তে গাছের শাখা থেকে শাখান্তরে লাফিয়ে বেড়াতে লাগল। দুর্ভাগ্যবশত গাছের শাখা ভেঙে বানরটি মাটিতে পড়ে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে। প্রসন্নচিত্তে বুদ্ধকে মধু দান করে বানরটি তাবতিংস স্বর্গলাভে সমর্থ হয়েছিল। পারিলেয়্য বনে হস্তীরাজ কর্তৃক বুদ্ধের সেবা এবং বানর কর্তৃক মধু দান এই ভাদ্র পূর্ণিমাকে ধর্মীয় আবহে এক আনন্দমুখর দিবসে পরিণত করেছে। বুদ্ধপূজা, বর্ষাষাটিকা চীবর দান, অষ্টপরিষ্কার দান, সংঘ দান, মধুদান, প্রদীপ প্রজ্বলন ও ভিক্ষুসংঘকে পিÐদানসহ ভাবগাম্ভীর্যে দিবসটি পালন করা হয়।
কোশাম্বীবাসীর বিবাদ বিসম্বাদের বিষয়টি ভিক্ষু ও সাধারণ জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লে জনগণ ভিক্ষু সংঘের উপর ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁদের চতুর্রপ্রত্যয় বন্ধ করে দেয়।অবশেষে ভিক্ষুরা তাঁদের ভুল বুঝতে পেরে পারিলেয়্য বনে গিয়ে বুদ্ধের কাছে ক্ষমা চেয়ে তাঁকে লোকালয়ে ফিরে আসতে অনুরোধ জানান। বুদ্ধ তাঁদেরকে সংঘভেদ মূলক কাজ থেকে বিরত থাকতে উপদেশ দিলেন। বানরের মধুদান বৌদ্ধ ইতিহাসে সেবা, ত্যাগ ও দান চিত্তের মহান শিক্ষা হিসেবে দেদীপ্যমান যা মানুষের জন্য শিক্ষনীয় বিষয়।
আজ দেখি মানুষের মধ্যে লোভ, দ্বেষ, মোহ এক মহা আতংক হয়ে বিরাজ করছে। মৈত্রী, করুণার আলোকে মধু পূর্ণিমা আমাদের সবার জীবনে শান্তি, কল্যাণ ও সমৃদ্ধি বয়ে আনুক। মধু পূর্ণিমা হোক সবার কাছে দান সেবার অত্যুজ্জ্বল প্রেরণা। বাংলাদেশ সমৃদ্ধ হোক।
বিশ্বে শান্তি বিরাজ করুক।
জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক।
লেখক : সাবেক অধ্যক্ষ, রাঙ্গুনিয়া কলেজ