মজলুম জনগণের আইনজীবী আবদুল লতিফ উকিল

72

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী

চট্টগ্রাম বারের প্রথম মুলমান আইনজীবী রেয়াজুদ্দিন সিদ্দিকী। শুধু তাই নয়, তিনি চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির ১৭ জন স্থাপয়িতার মধ্যে একমাত্র মুসলিম সদস্য। তাঁর পর আরো তিনজন মুসলিম আইনজীবীকে আচকান পাজামা ও মাথায় লাল তুর্কি টুপি ধারণ করে চট্টগ্রাম আদালতের অলিন্দে বিহার করতে দেখি। তাঁরা হচ্ছেন খান বাহাদুর জালালউদ্দিন আহমদ (পরবর্তীকালে মন্ত্রী), খান বাহাদুর আবদুস সাত্তার ও খান বাহাদুর সৈয়দ মকবুল হোসেন, যাঁদেরকে রেয়াজউদ্দিন সিদ্দিকীই তাঁর জুনিয়ররূপে চট্টগ্রাম আদালতে আইন পেশায় প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। ইতিমধ্যে খান বাহাদুর আমান আলীও চট্টগ্রাম আদালতে আইন চর্চায় ব্রতী হন এবং তিনি গভর্নমেন্ট প্লিডার পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন। এদের পরে আরো দু’জন মুসলমান আইনজীবী আইন পেশায় নিয়োজিত হয়ে খুবই খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন, তাঁরা হচ্ছেন আবদুল লতিফ উকিল ও বদরুল হক খান। দু’জনের মধ্যে আবদুল লতিফ উকিল বয়সে সামান্য বড়। দু’জনের মধ্যে মিল অনেক, গরমিলও কিছুটা ছিলো। দু’জনই অসামান্য আইনজীবী ও আকর্ষণীয় মানুষ ছিলেন। রাজনীতিও করতেন; তবে বদরুল হক খানের রাজনীতি পার্লামেন্টারি গÐির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো। আবদুল লতিফ উকিলকে পার্লামেন্ট খুব একটা কাছে টানে নি। মাঠের রাজনীতিতেই তিনি স্ব্যচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। কারণ মানুষটা তো ছিলেন আমজনতার নেতা। গণমানুষের সঙ্গে মিশে যেতে পারলেই স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন। একারণে আবদুল লতিফ উকিল তাঁর আইনচর্চার ক্ষেত্র হিসেবে সাধারণ মানুষের জীবনটাই বেছে নিয়েছিলেন। মানুষের সেবা করার জন্যই আইন পেশা গ্রহণ করেছিলেন। তিনি খুব দ্রæত জনপ্রিয় উকিল হয়ে উঠেছিলেন। তীক্ষè যুক্তি-তর্কের অব্যর্থ বাণে যখন প্রতিপক্ষকে ফালা ফালা করে ফেলতেন, আদালতের সে দৃশ্য তখন দেখার মত হয়ে উঠতো।
১৯২৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে প্রথম শ্রেণিতে বি.এল. পাস করার পর তদানীন্তন অবিভক্ত বাংলার মন্ত্রী খান বাহাদুর জালালউদ্দিন আহমদের জুনিয়র হিসেবে আবদুল লতিফ উকিল চট্টগ্রাম বারে আইন পেশায় যোগদান করেন। বারে গিয়ে তিনি দেখতে পেলেন ব্রিটিশ শাসনে বাঙালি মুসলমানদের প্রতি পদে পদে অনেক বাধা-বিঘ্ন, অনেক বিপদ পোহাতে হয়। বিশেষতঃ রাজনীতি ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে তা প্রায় অত্যাচার-অবিচার-জুলুমের পর্যায়ে উপনীত হয়েছিলো। আপসহীন সংগ্রামী লতিফ উকিল এই অবস্থা দেখে নীরব থাকতে পারেননি।
বাঙালি মুসলমানদেরকে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সচেতন করে তুলতে এগিয়ে আসেন তিনি। এ সময় (১৯২৪) নিখিল ভারত মুসলিম লীগের চট্টগ্রাম শাখা গঠিত হলে মরহুম কে.বি মকবুল হোসেন সভাপতি ও মরহুম আবদুল লতিফ উকিল সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। একই সঙ্গে নির্বাচিত হন চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক। তাঁর আগে কোন মুসলমান এই পদে নির্বাচিত হননি। পরে দীর্ঘদিন সভাপতিও নির্বাচিত হয়েছিলেন। এরপরও তিনি দেখতে পান যে, সামন্তবাদী, সা¤প্রদায়িক ও ব্রিটিশের দালাল মনোভাবাপন্ন অবাঙালি ও গোঁড়া সামন্ত মনোভাবাপন্ন উকিলরা প্রতিবাদী মুসলমান উকিলদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করছেন। এতে তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে সমগ্র বাংলায় (পূর্ব ও পশ্চিম বাংলা) মুসলিম আইনজীবী সমিতি গড়ে তোলেন। এই সমিতি গড়ে তোলার ব্যাপারে তাঁকে শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক, কলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের তৎকালীন মেয়র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, ত্রিপুরার (বর্তমান কুমিল্লা) উকিল আবদুল করিম মিয়া ও নারায়ণগঞ্জের একজন সাহসী উকিল প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করেন।
তিনি এমন আত্মমর্যাদাশীল ব্যক্তিত্ব ছিলেন, সে যুগে যা’ কদাচিৎই দেখা যেত। অসাধারণ সংগ্রামী জীবনই তাঁর চরিত্রে আত্মমর্যাদার সমাবেশ ঘটিয়েছিলো। মেধা ও জ্ঞানের সঙ্গে দুর্দমনীয় সাহস, একনিষ্ঠ স্বদেশপ্রেম, জনদরদ ও দৃঢ়চিত্ততা তাঁর চরিত্রকে করে তুলেছিল এক শোভন মনোহারিত্বে অদ্বিতীয়। ভারত বিভাগের পূর্বে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসনামলে, গরীব কৃষক-প্রজাকূলের উপর সামন্তবাদী শোষণ এবং জমিদারী-মহাজনী প্রথা উচ্ছেদের জন্যে মরহুম শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের সহযোদ্ধা হিসেবে যাঁরা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে আলহাজ মরহুম আবদুল লতিফ উকিল ছিলেন অন্যতম। তিনি সামন্তবাদবিরোধী আন্দোলনে পূর্বাঞ্চলীয় সংগঠক ছিলেন। কৃষক-প্রজা পার্টির কেন্দ্রীয় ভাইস-প্রেসিডেন্ট ও ঋণ সালিশী বোর্ডের নেতা হিসেবে এই দায়িত্ব তিনি আরো বেশি যোগ্যতা ও বিশ্বস্ততার সাথে পালন করেন।
আবদুল লতিফ উকিল ১৮৯৭ সালের ১ মার্চ হাটহাজারী থানার ফটিকা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মুন্সি রহমান আলী। তিনি চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে এন্ট্রান্স পাস করেন। আই.এ. ও বি.এ. পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। ১৯২৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে প্রথম শ্রেণিতে বি.এল. পাস করেন। অতঃপর আইন ব্যবসায় যোগ দেন।
আইনজীবী হিসেবে আবদুল লতিফ উকিল বিশেষ করে নির্যাতিত মুসলমানদের ন্যায়বিচারের জন্য অক্লান্ত চেষ্টা চালান। তিনি গ্রামে গ্রামে গণমুখী শিক্ষা চালু করেন। তিনি মুসলিমদের ফেরকায় বিশ্বাস করতেন না। একতাই ছিল তাঁর আদর্শ। একই সময়ে তিনি বিভিন্ন মতের মাদ্রাসা ও দরগা কমিটির পরিচালনায় নিয়োজিত ছিলেন। সৌদি আরবে হজ্বব্রত পালন করতে গিয়ে তিনি হাজিদের সমস্যা নিরসনে সৌদি সরকারের কাছে সম্মিলিতভাবে বিভিন্ন প্রস্তাব পেশ করেন। এক পর্যায়ে তিনি মুসলিম লীগের রাজনীতি ত্যাগ করে আওয়ামী মুসলিম লীগের সাথে জড়িত হন। সমবায় আন্দোলনেও জড়িত হন। তিনি চট্টগ্রামের প্রাচীনতম সমবায় প্রতিষ্ঠান ইসলামাবাদ টাউন কো-অপারেটিভ ব্যাংকের ২২ বছর চেয়ারম্যান ছিলেন। তাঁর প্রচেষ্টায় সমবায় সংগঠনের প্রভূত উন্নতি হয়। তিনি চট্টগ্রাম পৌরসভার কমিশনার ও চট্টগ্রাম পৌর ওয়েলফেয়ার পার্টির নেতা নির্বাচিত হন। কাঁহারপাড়া আক্রমণের জন্য তিনি ব্রিটিশ সৈন্যদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন। তিনি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটির সাথেও সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৬৫ সালের ২০ জানুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
মরহুম আবদুল লতিফ উকিল একজন সফল আইনজীবী ছিলেন। তিনি সবসময় তাঁর পেশার সম্মুখের আসনে ছিলেন। বহু মামলা তিনি বিনা ফিতে করেছেন। কোন মক্কেল মজলুম হলে তাকে সাহায্যও করেছেন। দল-মত-নির্বিশেষে রাজনৈতিক কর্মীদেরও সাহায্য করেছেন। দুঃস্থ মানুষের হাতে অকাতরে তুলে দিয়েছেন তাঁর উপার্জিত অর্থ। মরহুম উকিল সাহেব চট্টগ্রাম জেলা বোর্ড সদস্য ও স্কুল বোর্ডের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। জেলার বিভিন্ন স্থানে স্কুল প্রতিষ্ঠা করে বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে শিক্ষা স¤প্রসারণে আলোকোজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছিলেন। সেই সময়ে তাঁকে মরহুম সৈয়দ সোলতান, মরহুম আবদুর রহমান ও মরহুম আহমদ কবির চৌধুরী (সাবেক এমপি আবদুল্লাহ আল হারুন ও সাবেক সাবেক মন্ত্রী আবদুল্লাহ-আল-নোমানের পিতা) যথেষ্ট সহযোগিতা করেছিলেন। তাঁরা সকলেই চেয়েছিলেন গ্রাম ভিত্তিক গণমুখী শিক্ষাব্যবস্থা। যে শিক্ষা ব্যবস্থায় গ্রামের কৃষক, দিন মজুরের সন্তানরা অবৈতনিক শিক্ষার নিশ্চয়তা পাবে। এই সময়ে মরহুম লতিফ উকিল সাহেবের কতিপয় ভক্ত তার নামে একটি স্কুল করার প্রস্তাব করলে তিনি কিছুতেই রাজী হননি এবং বলেছিলেন ‘দেশ ও জনগণের জন্যে আমি আল্লাহকে রাজি-খুশি করতে কাজ করছি, নিজের নামে জনপ্রতিষ্ঠানের নাম দেবার জন্যে নয়’। এই ধরনের শালীনতা, নিজের ও অপরের সম্বন্ধে পরিমিত জ্ঞান ও মূল্যবোধ মরহুম উকিল সাহেবের এক লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য ছিল। তিনি হাটহাজারী হাই স্কুল ও কাজেম আলী হাইস্কুল পরিচালনা কমিটির সেক্রেটারি, চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ ও ইসলামিক ইন্টারমেডিয়েট কলেজ গভর্নিং বডির সদস্য ছিলেন। হাটহাজারী প্রাইমারী স্কুল ও ফটিকা রহমানিয়া প্রাইমারী স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। হযরত গরিব উল্ল্যাহ শাহ্ (রহ:), হযরত বায়েজিদ বোস্তামী (রহ:), হযরত মিসকিন শাহ্ (রহ:) দরগাহ কমিটির সেক্রেটারি, হাটহাজারী অদুদিয়া মাদ্রাসার সাংগঠনিক কমিটির সভাপতি ও হাটহাজারী বড় মাদ্রাসার সূরা’র সদস্য ছিলেন।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা