ভয়াল এপ্রিলেই দুর্যোগের আভাস

64

করোনা মহামারির মধ্যে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাস হিসেবে পরিচিত ভয়াল এপ্রিলেই তাপদাহ ও ঘূর্ণিঝড়ের মত একাধিক প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। সংস্থাটির বিশেষজ্ঞদের মতে, চলতি মাসেই দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে তীব্র তাপপ্রবাহ, মধ্যাঞ্চলে শিলাবৃষ্টি এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলে আকস্মিক বন্যা হতে পারে। এ ছাড়া, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হতে পারে দু-দু’টি নিম্নচাপ। যার অন্তত একটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে।
আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এপ্রিল মাসে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের আলামতই বিদ্যমান রয়েছে। তবে বঙ্গোপসাগরে এক থেকে দু’টি নিম্নচাপ সৃষ্টি হতে পারে। যার মধ্যে একটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়ার প্রবণতাও পরিলক্ষিত হচ্ছে। দেশের উত্তর, উত্তর-পশ্চিম ও মধ্যাঞ্চলে দুই থেকে তিন দিন বজ্র ও শিলাবৃষ্টি হতে পারে। বয়ে যেতে পারে মাঝারি ধরনের কালবৈশাখী ঝড়। দেশের অন্য এলাকায় চার থেকে ছয় দিন বজ্রসহ শিলাবৃষ্টি ও মাঝারি ধরনের কালবৈশাখী ঝড় বয়ে যেতে পারে। অপরদিকে, উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে একটি তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। সেসময় তাপমাত্রা বেড়ে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে চলে যাবে। দেশের অন্য অঞ্চলে এক থেকে দুটি মৃদু (৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস) কিংবা মাঝারি ধরনের (৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস) তাপপ্রবাহ হতে পারে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর গত মাসের আবহাওয়া পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে দেখেছে, বিদায়ী মার্চ মাসে সারাদেশে স্বাভাবিকের চেয়ে ৬০ দশমিক এক শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। তবে সাত বিভাগের মধ্যে কেবলমাত্র রংপুর বিভাগেই স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হয়েছে। পশ্চিমা লঘুচাপের সঙ্গে পূবালী বায়ুপ্রবাহের সংযোগ ঘটায় দ্ইু থেকে সাত মার্চ, ১৪ থেকে ১৫ মার্চ এবং ২৪ থেকে ২৫ মার্চ দেশের বিভিন্ন জায়গায় হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টি হয়। সেই সঙ্গে বয়ে যায় দমকা হাওয়া। বিক্ষিপ্তভাবে কয়েক জেলায় শিলাবৃষ্টিও হয়েছে। বাংলাদেশ ও এর প্রতিবেশী এলাকায় তাপীয় লঘুচাপের উপস্থিতিতে ২৭ থেকে ৩১ মার্চ দেশের বিভিন্ন জায়গায় মৃদু তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে। সেসময় অর্থাৎ গত ২৭ ও ২৮ মার্চ সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ফরিদপুর ও চাঁদপুরে ৩৭ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়। এ ছাড়া ১৭ মার্চ টেকনাফে বিদায়ী মাসে দেশের সর্বোচ্চ ৩৭ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। উপমহাদেশীয় উচ্চচাপ বলয়ের প্রভাবে ও উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে আসা শুষ্ক বায়ুপ্রবাহের কারণে ৮ থেকে ১২ মার্চ এবং ১৬ থেকে ১৯ মার্চ সারাদেশে রাতের তাপমাত্রা কমে যায়। ১৭ মার্চ দেশের সর্বউত্তরের সীমান্তবর্তী তেঁতুলিয়ায় সর্বনিম্ন ১১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। বিদায়ী মার্চে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে শূন্য দশমিক এক ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা শূন্য দশমিক ছয় ডিগ্রি সেলসিয়াস কম ছিল।
এর আগে আবহাওয়া অধিদপ্তরের তিন মাস (মার্চ, এপ্রিল ও মে) মেয়াদী পূর্বাভাসে বলা হয়েছিল, এপ্রিল মাসে দেশে স্বাভাবিক থেকে স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা বেশি বৃষ্টিপাত হতে পারে। পাশাপাশি বঙ্গোপসাগরে এক থেকে দুটি নিম্নচাপ সৃষ্টি হতে পারে। এর মধ্যে একটি রূপ নিতে পারে ঘূর্ণিঝড়ে। পুরো মাসজুড়ে দেশের উত্তর থেকে মধ্যাঞ্চল পর্যন্ত দুই থেকে তিনদিন বজ্রপাতসহ মাঝারি থেকে তীব্র কালবৈশাখী অথবা বজ্রঝড় এবং দেশের অন্যত্র চার থেকে পাঁচদিন হালকা থেকে মাঝারি কালবৈশাখী বা বজ্রঝড় হতে পারে। পাশাপাশি দেশের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে একটি তীব্র তাপপ্রবাহ এবং অন্যত্র এক থেকে দুটি মৃদু বা মাঝারি তাপপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। সর্বশেষ মে মাসের দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, এ মাসে দেশে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের লক্ষণই বিদ্যমান রয়েছে। একই সময়ে বঙ্গোপসাগরে পাশাপাশি বঙ্গোপসাগরে এক থেকে দুটি নিম্নচাপ সৃষ্টি হতে পারে। এর মধ্যে একটি রূপ নিতে পারে ঘূর্ণিঝড়ে। মে মাসজুড়ে দেশের উত্তর, উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলে দুই থেকে তিনদিন মাঝারি থেকে তীব্র কালবৈশাখী এবং দেশের অন্যত্র তিন থেকে চারদিন হালকা থেকে মাঝারি মাত্রার কালবৈশাখী ঝড় হতে পারে। পাশাপাশি দেশের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে এক থেকে দুটি তীব্র তাপপ্রবাহ এবং অন্যত্র দুই থেকে তিনটি মৃদু বা মাঝারি তাপপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে।
এবার কালবৈশাখী মৌসুম শুরু হওয়ার পর গত ৩ মার্চ ভোরে প্রথম শিলাবৃষ্টির দেখা মেলে। ওইদিন ভোরের আলো না ফুটতেই মাদারীপুরের শিবচর, ফরিদপুর ও চাঁদপুরে কয়েক মিনিট স্থায়ী শিলাবৃষ্টি হয়েছে। এতে আমের মুকুল ও ফসলের ক্ষেতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। পরদিন রাজধানী ঢাকাসহ দেশের সাত জেলার ওপর দিয়ে কালবৈশাখী ঝড় বয়ে যায়। চট্টগ্রাম বিভাগের চাঁদপুরে শিলাবৃষ্টির দেখা মিললেও সদরসহ অধিকাংশ এলাকায় এখনও কালবৈশাখী ঝড়ে আক্রান্ত হয়নি। বরং এখানকার উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতেই গত কয়েকদিন ধরে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হচ্ছে। শিলাবৃষ্টির পরদিন অর্থাৎ গত ৪ মার্চ রাতে ঢাকা ছাড়াও ফরিদপুর, মাদারীপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও টাঙ্গাইলসহ আশপাশের এলাকার ওপর দিয়ে মৌসুমের প্রথম কালবৈশাখী ঝড় আঘাত হানে। এসময় কোথাও ঝড়ো বাতাসের গতি, আবার কোথাও বৃষ্টির দাপট বেশি ছিল।
প্রকৃতিবিশারদদের মতে, নামে বৈশাখ যুক্ত থাকলেও শীতের বিদায়ের পর ফাল্গুন, চৈত্র, বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাসে বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, সমগ্র পূর্ব এবং উত্তরপূর্ব ভারতে যে ঝড় বয়ে যায় তাই কালবৈশাখী। বাংলা বর্ষের শুরুতে মানে বৈশাখ মাসে এ ঝড় তুলনামূলকভাবে বেশি হয় বলেই এ ঝড় কালবৈশাখী নামে পরিচিত লাভ করেছে। কালবৈশাখীর আসল নাম,‘নর-ওয়েস্টার।’ অর্থাৎ উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে এই ঝড় ধেয়ে আসে বলে একে বলে ‘নর-ওয়েস্টার’। তাই বলে কালবৈশাখী শুধুমাত্র বৈশাখ মাসেই (১৫ এপ্রিল থেকে ১৫ মে পর্যন্ত) দেখা যাবে- এমনটি নয়। কালবৈশাখী এবং সাধারণ ঝড়ের মধ্যে পার্থক্য বিচার করার কিছু মাপকাঠি রয়েছে। মোটা দাগে বলা যায়, ঝড়ের গতিবেগ ঘন্টার ৫০ কিলোমিটারের বেশি এবং স্থায়ীত্ব অন্তত একমিনিট হলে সেটাই কালবৈশাখী ঝড়।
উল্লেখ্য, এশিয়া অঞ্চলের আবহাওয়াবিদরা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রাকে তীব্র তাপপ্রবাহ, ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে মাঝারি এবং ৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে মৃদু তাপপ্রবাহ হিসেবে গণনা করেন।