ভোরের আলো ফুটলে প্রাণ ফিরে পায় ক্যাম্প

57

উখিয়া-টেকনাফের পাহাড়ি এলাকায় শীতে দুর্ভোগে পড়েছে রোহিঙ্গারা। ছোট ছোট বাঁশের ঝুপড়ি ঘরগুলোর পলিথিনের ছাউনির ছিদ্র দিয়ে বৃষ্টির পানির মতো করে কুয়াশা পড়ছে আর হিম বাতাস ঢুকছে। স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে শীতজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত রোহিঙ্গা বৃদ্ধ, নারী ও শিশুদের ভিড় বাড়ছে। এখনো রোহিঙ্গাদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ হয়নি বলে জানিয়েছেন অনেক রোহিঙ্গারা।
গতকাল রবিবার বিকালে টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নে শালবন, লেদা ও জাদিমুড়াসহ কয়েকটি শিবির ঘুরে দেখা যায়, কক্সবাজার-টেকনাফ প্রধান সড়ক থেকে এক কিলোমিটার ভেতরে পাহাড়ি এলাকায় শালবন নামক রোহিঙ্গা শিবিরের অবস্থান। অনেকের ঘরে ছাউনি থাকলেও নিচে মাটিতে পলিথিন বিছিয়ে রয়েছেন। গত কয়েকদিন ধরে কনেকনে ঠান্ডায় কাবু হয়ে পড়েছেন রোহিঙ্গারা। অনেকে শীতজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত রোহিঙ্গাদের চিকিৎসা নিতে স্থানীয় স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ছুটছেন।
শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হালিমা বেগম (৭২) নামে এক রোহিঙ্গা নারী বলেন, শীতে খুব কষ্ট পাচ্ছি। পাহাড়ি এসব ঝুপড়ি শিবিরে ঠান্ডায় কনকনে রাত পেরিয়ে যখন ভোরের আলো ফোটে, তখন যেন প্রাণ ফিরে পায় রোহিঙ্গারা। অধিকাংশের ঘরেই শীতবস্ত্র নেই। ঝুপড়ি ঘরগুলোর পলিথিনের ছাউনির ছিদ্র দিয়ে বৃষ্টির পানির মতো করে কুয়াশা পড়ছে। নিচে মাটিতে পলিথিন দিয়ে থাকতে হয়। এতে ঠান্ডা লেগে সর্দি-কাশিতে নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। তাই চিকিৎসা নিতে হাসপাতালে যাচ্ছি।
ফাতেমা খাতুন নামে আরেক রোহিঙ্গা নারী বলেন, শীতের কোন জামা নেই, কম্বল নেই। ফলে শীত থেকে বাঁচাতে পাহাড়ি লাকড়ির অংশ জ্বালিয়ে কোনোরকমে উপায় খোঁজার চেষ্টা অসহায় মানুষগুলোর। শীতবস্ত্রের বদলে আগুনই শীত নিবারণের একমাত্র ভরসা।
তিনি আরো বলেন, কয়েকদিন ধরে ঠান্ডায় খুব কষ্ট হচ্ছে। ঘরে দুই নাতনি ডায়রিয়া, সর্দি-কাশিতে নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। রাতে ঝুপড়ির বাঁশের বেড়া দিয়ে যখন ঠান্ডা বাতাস ঢোকে তখন শিশুরা কান্নাকাটি করে। এখনো কোন এনজিও সংস্থার কাছ থেকে কম্বল ও শীতের কাপড় পায়নি।
এদিকে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) একটি চিকিৎসা সংক্রান্ত গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও স্বাস্থ্য বিভাগের দেওয়া তথ্যমতে, গত তিন দিনে দেড় শতাধিকের বেশি রোগীকে চিকিৎসা দিয়েছে। যা শীতজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়েছে। তার মধ্যে বেশির ভাগই রোহিঙ্গা নারী ও শিশু।
আইসিডিডিআরবি’র লেদা শরণার্থী শিবিরের ডায়রিয়া ট্রিটমেন্ট সেন্টারের চিকিৎসক ডা. মোহাম্মদ জাহেদুর রহমান বলেন, শীতজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। শীতের কারণে রোগীর সংখ্যা প্রায় চারগুণ বেড়েছে। তবে তাদের পর্যাপ্ত চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
টেকনাফ লেদা রোহিঙ্গা শিবিরের ডেভেলপমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলম বলেন, গত কয়েকদিনে প্রচন্ড শীতে রোহিঙ্গাদের অবস্থা খুবই করুন। বেশির ভাগ বৃদ্ধ, নারী ও শিশুরা কষ্টে আছে।
শীতে কাঁপলেও রোহিঙ্গারা প্রয়োজনীয় শীতবস্ত্র পায়নি। আর্ন্তজাতিক সংস্থাসহ কোন এনজিও শীতবস্ত্র বিতরণ করেনি সেখানে। ফলে প্রতিদিন সন্ধ্যার পর থেকে সকাল পর্যন্ত ঠান্ডায় কষ্ট পচ্ছেন রোহিঙ্গারা।
টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্মকর্তা টিটু চন্দ্র শীল বলেন, শীতকালে পাহাড়ি এলাকায় আশ্রয় নেওয়া নারী-শিশুরা ঠান্ডাজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। তারা ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কাইটিস, সর্দি-জ্বর, কাশি, চোখের অ্যালার্জিসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। তবে সবাই যেন চিকিৎসা পায় সে চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, রোহিঙ্গা শিবিরে ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। তারা চিকিৎসাসেবা পাচ্ছে। তবে এখানে শীতবস্ত্র এলে রোহিঙ্গাদের মাঝে বিতরণ করা হবে।
শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (অতিরিক্ত) সামছু দৌজ্জা বলেন, রোহিঙ্গা শিবিরে আর্ন্তজাতিক সংস্থাগুলো তাদের বাজেট অনুযায়ী শীতবস্ত্র বিতরণ করার কথা রয়েছে। সেই বিষয়ে খোঁজ খবর নেওয়া হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্মম নির্যাতনের মুখে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর অল্প সময়ের মধ্যে রাখাইন ছেড়ে বাংলাদেশে আসেন প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা। এর আগে থেকে এ দেশে অবস্থান করছিলেন আরও চার লাখ রোহিঙ্গা। সীমান্তবর্তী জেলা কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে প্রায় ৩৪টি শিবিরে বর্তমানে ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করছেন।