ভোক্তাদের ভোগাচ্ছে ‘অনিরাপদ’ পণ্য

48

প্রতিদিনের খাবার, জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য, ইলেকট্রনিক্স পণ্য, মনিহারি, এমনকি নির্মাণ সামগ্রী-সবকিছুতেই এখন চলছে ভেজালের রাজত্ব। অসাধু ব্যক্তিরা অতিরিক্ত মুনাফা লাভের আশা আর লোভে সব ধরনের পণ্যই ভেজাল-নকল করে বাজারে ছাড়ছে। নকলের ভিড়ে এখন আসল পণ্য চেনাটাই কঠিন হয়ে পড়েছে।
আসল-নকলের ধন্ধে ভোক্তারা প্রতিনিয়তই ঠকছেন মানে-ওজনে-দামে। সমন্বিত কার্যক্রম না থাকায় ঠেকানো যাচ্ছে না অসাধু ভেজালকারীদের।
আজ ১৫ মার্চ বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস। দিবসটির এবার প্রতিপাদ্য বিষয় ‘নিরাপদ মানসম্মত পণ্য’। কিন্তু বাংলাদেশের ভোক্তাদের সর্বক্ষণ ভোগাচ্ছে ‘অনিরাপদ’ পণ্য। নিরাপদ পণ্য পাওয়াটা এখন দেশের বাজারে দুস্কর।
অবশ্য নিরাপদ ও মানসম্পন্ন প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা। কিন্তু প্রতারক চক্রের দাপটে নিরাপদ পণ্য নিশ্চিত করতে পারছে না এসব সংস্থা।
চট্টগ্রামে ভেজালবিরোধী অভিযান পরিচালনার সাথে সংশ্লিষ্ট সংগঠনের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা এবং ভ্রাম্যমাণ আদালতের ম্যাজিস্ট্রেটদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, অভিযান চালালেই ভেজালের প্রমাণ মিলে। ভেজালের দায়ে জরিমানা করা হয়, প্রতিষ্ঠান বন্ধও করে দেওয়া হয়। কিন্তু ভেজালকারীরা দমে যায় না। কয়েক মাস পর আবারও একই কর্মকাÐ শুরু করে।
নগরীর বিভিন্ন স্থানে অসাধু ব্যক্তিরা গড়ে তুলেছেন ভেজাল পণ্য উৎপাদনের কারখানা। অভিযানের সময় বিভিন্ন খাদ্য পণ্য উৎপাদনের নকল কারখানার সন্ধান মিলে, সেখানে মানসম্মত প্রতিষ্ঠানে খাদ্যপণ্য নকল করা হচ্ছে। নকল ইলেকট্রনিক্স পণ্য তৈরির কারখানা, কসমেটিক্স পণ্যের কারখানাও মিলছে হরহামেশা। সবচেয়ে জঘন্য ব্যাপার ঘটছে, জীবন রক্ষাকারী ওষুধও নকল করার জন্য কারখানা তৈরি করেছে অসাধু ব্যক্তিরা।
ভোক্তারা পণ্যের মানে তো ঠকছেনই। ওজন আর দামেও ঠকছেন। বাজারে গেলেই সওদাপাতি করা লোকটি ভোক্তাকে ওজন কম দিচ্ছেন, ইচ্ছেমতো দামও বাড়িয়ে নিচ্ছেন।
এসব অনাচার থেকে ভোক্তাদের যেন মুক্তি নেই।
নগরীর চকবাজার কাঁচাবাজারে গতকাল বৃহস্পতিবার বাজার করতে আসা স্কুল শিক্ষিকা শারমিন আক্তার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘চিংড়ি মাছে জেলি মিশিয়ে রাখে বিক্রেতারা।
এতে মাছগুলো একদিকে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হয়ে যায়, অন্যদিকে মাছের ওজনও বাড়ে। বিক্রেতারা যখন তখন ইচ্ছেমতো দাম বাড়িয়ে দেয়।’
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নকল ও ভেজাল পণ্যের কারণে মানুষের রোগ-ব্যাধি বেড়ে গেছে। প্রায় প্রতিটি ঘরেই এখন রোগবালাই। অনিরাপদ খাদ্যপণ্যের কারণেই মানুষের অসুস্থতা, স্বাস্থ্য সমস্যা বাড়ছে।
ভোগ্য পণ্য থেকে শিল্প পণ্য এমনকি সেবার ক্ষেত্রেও প্রতিনিয়ত ঠকানো হচ্ছে ক্রেতাকে। প্রতারণার হাতিয়ার বন্ধ করার জন্য দায়িত্বশীল সংস্থাগুলো অভিযান পরিচালনা করে। এসব অভিযানে ভোক্তাকে ঠকানোর নানান প্রমাণও মিলে। দেওয়া হয় শাস্তি। কিন্তু ফলাফল গিয়ে দাঁড়ায় পূর্বের অবস্থায়। অবশ্য সরকার ভোক্তাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আইন প্রণয়ন করেছে। কিন্তু সে আইনের প্রয়োগ বাস্তনে তেমন নেই। আবার যে ভোক্তার জন্য আইন করা হয়েছে, সে ভোক্তারাই আইন সম্পর্কে সচেতন নন।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) চট্টগ্রাম অঞ্চলের সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, নিত্যপণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে ভোক্তা নানাভাবে প্রতারিত হচ্ছে। ইলেকট্রনিক্স আইটেম থেকে শুরু করে বিল্ডিং নির্মাণসামগ্রীসহ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মানহীন পণ্যে বাজার সয়লাব। বিদেশ থেকেও মানহীন পণ্য আসছে। তিনি বলেন, ভোক্তারা প্রতিনিয়ত ঠকছেন। কেউ ওজনে কম দিচ্ছে, কেউ ডিজিটাল স্কেলেও কারচুপি করছে। কেউ ভেজাল মিশিয়ে বিক্রি করছে। মানহীন, মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে। একেক প্রতিষ্ঠানে সেবার একেক দর, ইচ্ছেমতো টাকা আদায় করছে, কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা করছে না। যখনই দেখি ভোক্তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে, নানা সিদ্ধান্ত জোর করে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে তখন প্রতিবাদ করছি। তবে এখন ভোক্তাদের মধ্যে কিছুটা সচেতনতা এসেছে।
বাজারে ভেজাল আর নকল পণ্যের দাপট এতটাই যে কোনটি আসল আর কোনটি নকল চেনাই কঠিন। অত্যন্ত কৌশলে নামিদামি কোম্পানির মোড়কে ক্রেতার হাতে যাচ্ছে নকল পণ্য। বিভিন্ন মৌসুমী ফল ও পণ্যে ব্যবহার করা হয় ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য। বিএসটিআই এসব পণ্যের মান দেখার কথা থাকলেও শুধু অনুমোদন পর্যন্ত তাদের কাজ সীমাবদ্ধ। মাঝে মধ্যে অভিযানের নামে চলে লোক দেখানো প্রচারণা মাত্র।
এসব ব্যাপারে জানতে চাইলে চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ভোক্তার অধিকার বড় অধিকার। তারা বিভিন্নভাবে প্রতারিত হন। তারা খাদ্যপণ্যে, মূল্যে, ওজনে প্রতারণার শিকার হন। এ জন্য ভোক্তাকে সচেতন হতে হবে। এখন ভোক্তারা অনেক সচেতন হয়েছেন। ভোক্তার মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা গেলে অসাধু তৎপরতাকারীরাও গুটিয়ে যাবে।
ভোক্তাদের অধিকার সংরক্ষণে দেশে ২০০৯ সালে ‘ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন’ প্রণীত হয়। এ আইন প্রয়োগে ‘জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর’ গঠন করা হয়। ২০১০ সালে চট্টগ্রামেও ‘জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর’ এর কাজ শুরু হয়। এ আইনের আওতায় কেউ পণ্য কেনা ও সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের প্রতারণার শিকার হলে অভিযোগ দায়ের করতে পারেন। ভোক্তার অভিযোগ পাওয়ার পর অধিদপ্তর সেটার তদন্ত করে দেখেন। অভিযোগ প্রমাণিত হলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে যদি জরিমানা করা হয়, তাহলে জরিমানার ২৫ শতাংশ অভিযোগকারী ভোক্তাকে প্রদান করবে অধিদপ্তর। আইন পাস হওয়ার পর থেকে কয়েক বছর পর্যন্ত অধিদপ্তরে জমা পড়েনি কোনো অভিযোগ। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ভোক্তার অভিযোগের সংখ্যা বেড়েছে এ সংস্থায়। গত বছর সংস্থাটির কাছে অভিযোগ জমা পড়ে প্রায় সাড়ে তিনশ। চলতি বছরের প্রথম আড়াই মাসেই জমা পড়ে প্রায় এক হাজার অভিযোগ।
পণ্যের মাননিয়ন্ত্রণে কাজ করা সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) চট্টগ্রাম অঞ্চলের সহকারী পরিচালক মোস্তাক আহমদ পূর্বদেশকে বলেন, বিএসটিআইয়ের আওতাধীন পণ্যগুলোর মান নিশ্চিতে আমরা কাজ করি। বাধ্যতামূলক পণ্যের ক্ষেত্রে উৎপাদন মেয়াদ, মূল্য ও ওজন থাকতে হয়। তাছাড়া কি কাজে ব্যবহার করা হবে এবং কি কি উপাদান দিয়ে তৈরি সেটাও উল্লেখ থাকতে হয়। রেজিস্ট্রেশন দেওয়া পণ্যের ক্ষেত্রে সেটা করা হচ্ছে কি-না আমরা তদারকি করি। লাইসেন্সের পর বাজার থেকে স্যাম্পল সংগ্রহ করে মান ঠিক আছে কি-না সেটা পরীক্ষা করা হয়। সব সময় আমরা একটা তদারকি ব্যবস্থার মধ্যে থাকি।
তিনি বলেন, কোনো পণ্য বিএসটিআইয়ের সার্টিফিকেটপ্রাপ্ত কি-না, তা নিশ্চিত হয়েই ভোক্তাদের কে-না উচিত। শুধু বিএসটিআই লোগো দেখলেই হবে না, সে ব্যাপারে ভোক্তাদের নিশ্চিতও হতে হবে। বিএসটিআইয়ের ওয়েবসাইটে এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য আছে, সেটি দেখে নেওয়া যেতে পারে।
ভোক্তার অধিকার সংরক্ষণে কাজ করছে বেশ কয়েকটি সংস্থা। সরকারের এসব সংস্থার মধ্যেও নেই কোনো সমন্বয়। একেক সময় এক এক সংস্থা ক্ষুদ্র পরিসরে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জরিমানা করে থাকে। সমন্বিত কার্যক্রম না থাকায় ঠেকানো যাচ্ছে না প্রতারণা। আবার নির্ধারিত কাজের বাইরে গিয়েও কাজ করার সুযোগ নেই এসব সংস্থার। যার কারণে ভোক্তার প্রতারিত হওয়া দেখেও অনেক সময় কিছু করার থাকে না সংস্থাগুলোর। এতে ভেজাল ও মানহীন পণ্য বাজারে দাপিয়ে বেড়ানোর সুযোগ পায়। আর এসব পণ্য ভোগ করে ভোক্তারা নানার সমস্যার সম্মুখীন হয়।
ভেজাল ও মানহীন পণ্যের কারণে মানুষের শরীরে কেমন প্রভাব পড়ে জানতে যোগাযোগ করা হয় চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন আজিজুর রহমান সিদ্দিকীর সাথে। কিন্তু তিনি ‘ঢাকার একটি মিটিংয়ে যোগ দিতে যাচ্ছেন’ এমন অজুহাত দেখিয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
ভোক্তা অধিকার দিবসের কর্মসূচি :
চট্টগ্রামে দিবসটি পালনের জন্য জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর এবং কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) চট্টগ্রাম বিভাগীয়, মহানগর, জেলা ও উপজেলা শাখা সংগঠনসমূহের উদ্যোগে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে র‌্যালি, আলোচনা সভা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানভিত্তিক সচেতনতা সভা, প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনী ইত্যাদি।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন ও ক্যাব চট্টগ্রামের যৌথ উদ্যোগে আজ সকাল ৯টায় সার্কিট হাউস চত্বর থেকে র‌্যালি শুরু হয়ে ১০টায় সম্মেলন কক্ষে ‘নিরাপদ মানসম্মত পণ্য’ শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত হবে। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াছ হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিতব্য সেমিনারে প্রধান অতিথি থাকবেন বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ আবদুল মান্নান, বিশেষ অতিথি থাকবেন উপ-মহাপুলিশ পরিদর্শক (ডিআইজি খোন্দকার গোলাম ফারুক, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান, চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ এর সভপতি মাহবুবুল আলম, ক্যাব, কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন প্রমুখ।