ভেজালে বিষাক্ত খাবার ওষুধ পানীয় ঝুঁকিতে জনস্বাস্থ্য

34

নিজস্ব প্রতিবেদক

চট্টগ্রামের সব জায়গায় ফার্মেসিতে অবাধে বিক্রি হচ্ছে মেয়াদোত্তীর্ণ, ভেজাল ও অনুমোদনহীন ওষুধ। ফার্মেসিতে অভিযান চালালেই মিলছে মানহীন ওষুধ। ভোক্তারা ফার্মেসি থেকে এসব ওষুধ কিনে প্রতারিত হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। পড়ছেন মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। মেয়াদোত্তীর্ণ, ভেজাল ও অনুমোদনহীন ওষুধ উৎপাদন ও বিপণন আইনত দন্ডনীয় অপরাধ জেনেও কতিপয় অসাধু ওষুধ কোম্পানি ও ফার্মেসি ব্যবসায়ী অর্থের লোভে এ ধরনের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
জানা যায়, ওষুধের দ্বিতীয় বৃহত্তম পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের হাজারী গলি। এ বাজারে রয়েছে ভেজাল ওষুধের অনেক গোডাউন। এখানে লাখ লাখ টাকার নকল-ভেজাল ও ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ সরকারি ওষুধের হরদম চলছে বেচাকেনা। এসব ওষুধ আবার চলে যাচ্ছে চট্টগ্রামের বিভিন্নস্থানের ফার্মেসিগুলোতে। যার কারণে ফার্মেসিতে অভিযান চালালেই মিলছে মানহীন ওষুধ। তবে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন সব জেনেও নিরব থেকেছে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানান, ওষুধ যেমন জীবন রক্ষা করতে পারে, তেমনি একই ওষুধ নকল, মেয়াদোত্তীর্ণ কিংবা নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় সংরক্ষণ না করলে কার্যকারিতা হারিয়ে জীবনহানিও ঘটাতে পারে। এছাড়া এসব ওষুধ খেলে চামড়ার ওপর মারাত্মক এলার্জি সৃষ্টিসহ কিডনি ও লিভার নষ্ট হতে পারে। মস্তিষ্কের প্রদাহে অজ্ঞান হয়ে মারাও যেতে পারে। সর্বোপরি এ ধরনের ওষুধ সেবনে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়তে পারে রোগীরা।
অভিযোগ রয়েছে, মেয়াদোত্তীর্ণ ও ভেজাল ওষুধ ব্যবসার সিন্ডিকেটের সঙ্গে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর ও কোম্পানির একশ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত। এদের হাত ধরে শহর থেকে গ্রামে সবখানে মেয়াদোত্তীর্ণ ও ভেজাল ওষুধ ফার্মেসিতে ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়া চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও জেনারেল হাসপাতালের রোগীদের জন্য বরাদ্দকৃত সরকারি ওষুধগুলো হাজারী গলির বিভিন্ন দোকানে বিক্রি হয়।
কনজুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর চট্টগ্রাম বিভাগীয় সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ওষুধ প্রশাসন তদারকি করে না বলেই এ অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। তাই ওষুধ প্রশাসনের গাফিলতির কারণে তাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করা দরকার। এছাড়া ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ নির্মূলে এসব ওষুধ যারা উৎপাদন ও বিপণন করে তাদের বিষয়ে প্রশাসনকে তথ্য দেওয়া ওষুধ কোম্পানিগুলোর নৈতিক দায়িত্ব বলে মনে করি। এই বিষয়ে সবাইকে সচেতন হওয়া প্রয়োজন।
তাছাড়া নগরীর হাট-বাজারে সামুদ্রিক মাছে বিষাক্ত রং ও ফরমালিন মিশিয়ে অবাধে বিক্রি করা হচ্ছে। বলতে গেলে এখন কোথাও কেমিক্যালমুক্ত মাছ মেলে না। সবখানে ভেজাল আর ভেজাল। অধিক মুনাফার আশায় একশ্রেণির ব্যবসায়ী প্রতিনিয়ত ক্রেতাদের সাথে প্রতারণা করে যাচ্ছেন। বাজারে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কঠোর নজরদারি না থাকায় মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েছেন ভোক্তারা।
সংশ্লিষ্টদের মতে, ইউরিয়া, ফরমালিনসহ নানা কেমিক্যাল ও কাপড়ের বিষাক্ত রং মিশিয়ে মাছকে বিপজ্জনক বিষে পরিণত করা হচ্ছে। পাইকারি আড়তগুলোতে মাছ স্ত‚প করে রেখে প্রকাশ্যেই ফরমালিন ছিটানো হয়। স্প্রে করা হয় কেমিক্যাল মিশ্রিত পানি। মাছ আহরণ করার পর থেকেই প্রয়োগ করা হয় ফরমালিন। অপেক্ষাকৃত বড় আকারের মাছগুলো তাজা অবস্থায় ইনজেকশনের মাধ্যমে ফরমালিন পুশ করা হয়। আর ছোট আকারের মাছগুলো ফরমালিন মিশ্রিত পানির ড্রামে চুবানো হয়। ফরমালিনযুক্ত বরফের মধ্যেই দিনভর চাপা দিয়ে রাখা হয় মাছ।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানান, খাদ্যপণ্যে ভেজালের কারণে দেশে বিভিন্ন রকমের ক্যান্সার, লিভার সিরোসিস, কিডনি ফেলিউর, হৃদযন্ত্রের অসুখ, হাঁপানি, বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম এগুলো বেড়ে যাচ্ছে। এছাড়াও ভেজাল খাবারের কারণে মানুষ অ্যালার্জি, অ্যাজমা, চর্মরোগ, বমি, মাথাব্যথা, খাদ্যে বিষক্রিয়া, অরুচি, উচ্চ রক্তচাপ, ব্রেন স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাকের শিকার হচ্ছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশে বছরের খাদ্যশস্য ও মসলার যে চাহিদা রয়েছে, তার প্রায় সবই দেশে উৎপাদন হয়। তবে এর বাইরে খাদ্যশস্য ও অন্যান্য পণ্যের একটি বড় অংশ আমদানি করে বাংলাদেশ। এর মধ্যে চাল, গম, ভুট্টা, পেঁয়াজ, মসুর ডাল, ছোলা, সয়াবিন তেল, চিনিসহ নানারকম নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য রয়েছে। আমদানি পণ্যের মধ্যে এক পঞ্চমাংশ নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী। সারাবছর দেশের বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক পর্যায়ে ওঠানামায় থাকলেও রমজানে মাসে চাহিদা বৃদ্ধির অজুহাতে সৃষ্টি হয় চরম সংকট ও অব্যবস্থাপনা। এসময় সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে পর্যাপ্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য আমদানির অনুমতি প্রদান করে। তারপরও একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী অতি মুনাফার লোভে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য মজুদ করে বাজারে সংকট সৃষ্টি করে। এসময় নানা পদক্ষেপ নেওয়ার পরও সরকারকে বাজার নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খেতে হয়।
এসব বিষয় বিবেচনায় এনে গতকাল সোমবার খাদ্যদ্রব্যের উৎপাদন, মজুদ, স্থানান্তর, পরিবহন, সরবরাহ, বিতরণ ও বিপণন (ক্ষতিকর কার্যক্রম প্রতিরোধ) আইন ২০২২ এর খসড়ার নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। এই আইনের অধীনে অপরাধীকে সর্বোচ্চ ৫ বছরের কারাদন্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ড ভোগ করতে হবে। নিরাপদ খাদ্য আদালতে এসব অপরাধের বিচার হবে। তবে ভ্রাম্যমাণ আদালতেও বিচারের সুযোগ থাকছে।