ভূ-স্বর্গ কাশ্মির ঘুরে এসে

13

আশ্ফা খানম

হাউসবোট

বিলাসবহুল এই সকল বোট হাউসে রাত্রিযাপন রাজা-বাদশাহদের বিলাসী নৌকায় চড়ার স্বাদ আমাদের মতো সাধারণ মানুষদের উপভোগ করার সুযোগ করে দেয়। প্রতিটি বোট হাউস অপূর্ব সুন্দর। ঐতিহ্যবাহী কারুকার্যখচিত। বাহির থেকে দেখতে তা’ যেমন চমৎকার ভিতরেও তা’ খুব সুন্দরভাবে ইংরেজ স্টাইলে সাজানো। আমরা আসবো জেনে এত রাতেও সেখানকার ফেরী করা দোকানীরা তাদের পসরা নিয়ে বোট হাউসের সামনে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। ডাল লেক বেশ কোলাহলপূর্ণ জায়গা। ঐখানে প্রচুর বোট হাউস রয়েছে। তদাপেক্ষা নাগিন লেক কোলাহলহীন হওয়ায় আমরা রাতে নাগিন লেকে বোট হাউসে রাত্রিযাপনের জন্য বরাদ্দ করি। ডোগরা রাজের আমলে ডোগরা মহারাজা কাশ্মীরের ছোট ছোট পবর্তগুলোতে ঘর বানানো নিষেধ করেন। পরবর্তীতে ব্রিটিশ শাসনামলে তারা সেখানে আকর্ষনীয় হাউস বোট নির্মাণের অনুমতি দেয়। তখন সেই হাউস বোটগুলোকে বলা হতো “ঊধপয ড়হব ধ ষরঃঃষব ঢ়রবপব ড়ভ ঊহমষধহফ ধভষড়ধঃ ড়হ উধষ” অর্থাৎ “একটি বোট হাউস যেন ডাল লেকে এক এক টুকরা ভাসমান ইংল্যান্ড”। ভারত স্বাধীনের পর সেখানে হানজী গোত্রের মানুষরা বসবাস শুরু করে এবং বোটগুলোর মালিক হয়। অতঃপর সেগুলোর রক্ষনাবেক্ষণ করে এবং তাদের সৃষ্ট হস্তসামগ্রী দিয়ে বাজার সৃষ্টি করে একটি কমিউনিটি গড়ে তোলে। এভাবে ডাল লেকে বোট হাউসকে ঘিরে তাদের জীবিকার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। আমরা আমাদের বোট হাউসে রাত্রিযাপনের জন্য কাছেই নাগিন লেকে ছুটে চলি। নাগিন লেককে ডাল লেকের অংশই বলা হয়। কারন এটি ডাল লেকের সাথে সংযুক্ত। ডাল লেকেও নাগিন লেকে বোট হাউসে অবস্থান করা ও নৌকা ভ্রমণ বা শিকারা খুবই স্বাভাবিক দৃশ্য। নাগিন লেকের বোট হাউসের মালিকরা আমাদের জন্য রাতের খাবার নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। ঘরোয়া পরিবেশে খোলা আকাশের নীচে তাদের ঘরোয়া রান্নায় আমাদের রাতের ডিনার আপ্যায়ন করেন। আমরা ডিনার সেরে বোট হাউস ঘুরে দেখি। ইউরোপ ও মুসলমান ঐতিহ্যের সংমিশ্রনে বোট হাউসগুলো নির্মিত। সুন্দর কারুকার্য খচিত (এমনকি সিলিং ও)। আমাদের বোট হাউসে বাথরুম সহ ৩টি বেডরুম, একটি ড্রইং রুম, ডাইনিং রুম, ছোট কিচেন এবং বারান্দা রয়েছে। খুবই রুচিশীলভাবে হাতের কাজ করা পর্দা দিয়ে ইংলিশ স্টাইলে ড্রইংরুম সাজানো। সেখানে হারমোনিয়াম ও পিয়ানোও রয়েছে। পুরো বোট হাউস কার্পেটে মোড়ানো। আমরা খাবার ও নামাজ সেরে অনেক রাত পর্যন্ত একসাথে গল্প-গুজব করে ঘুমাতে যাই। এখানে পরিবেশের কারনে বোধ হয় তৃপ্তির ঘুম দিয়ে খুব ভোরে আমরা উঠে পড়ি।
বারান্দায় দৃশ্য উপভোগ করতে বসলে নৌকায় করে বিক্রেতারা তাদের হস্তে বানানো পসরা নিয়ে আমাদের বোট হাউসের সামনে ভীড় জমাতে থাকে। অনুমতি দিলে তারা তাদের নৌকা ভিড়িয়ে বারান্দায় তাদের পসরা দেখাতে থাকে। আমরা নিজের ও আত্মীয় ও প্রিয়মানুষদের জন্য কেনাকাটা করে সকালের নাস্তা খাবার জন্য তৈরী হই। সকাল ৭টায় ব্রেকফাস্ট সেরে সব গুছিয়ে ফ্রেশ হয়ে আমরা সবাই যথাসময়ে তৈরী। আজ আমরা কাশ্মীরের সুইজ্যারল্যান্ড খ্যাত সোনমার্গে ঘুরতে যাবো।

সোনমার্গ

সোনমার্গ জন্মু ও কাশ্মীরের গানডারবাল জেলার পাহাড়ী ভূমিতে অবস্থিত। এটি গানডারবাল শহর থেকে ৬২ কিলোমিটার এবং শ্রীনগরের উত্তর-পূর্ব হতে ৮০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এই স্থান অতি প্রাচীনকাল থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ প্রাচীন সিল্করোডের মুখ এখানে অবস্থিত, যা কাশ্মীরকে চীনের সাথে সংযুক্ত করে। এখানে লাদাখের যাবার রাস্তা শুরু এবং ভারতের সৈন্যবাহিনীর বেইস ক্যাম্পও এখানে অবস্থিত। শীতকালে পুরো স্থানটি এবং এর পাহাড়গুলো সাদা সোনার বরফে পুরোপরি আবৃত থাকে বলে একে সোনমার্গ বলা হয়।
এই স্থানের অপার সৌন্দর্য আবিস্কারের জন্য উপযুক্ত সময় হলো এপ্রিল থেকে জুন মাস। গাড়ী ছুটে চলছে। আমরা দু’পাশের দৃশ্য উপভোগ করছি। মনে হচ্ছিল ইউরোপের কোন দেশ ভ্রমণ করছি। এখানকার ঘরবাড়ি এবং প্রকৃতিতে সেই ছোঁয়া পাওয়া যায়। গাড়ী যতই সোনমার্গর নিকটবর্তী হচ্ছিল আমরা সৃষ্টিকর্তার ধরণীর বুকে জান্নাতের একটুখানি প্রকৃতির ছোঁয়া দেখে বিমোহিত হয়ে পড়ছিলাম। এর বিশাল বিশাল পাথুরে পাহাড়ের বুক লম্বা লম্বা পেরেকের মতো পূতেঁ দেয়া পাইন গাছ আর বরফের আস্তরণে আবৃত (এষধপরবৎ)। মনে হচ্ছিল মাঝে মাঝে শিল্পী তার সাদা তুলির ছোঁয়ায় সবুজের বুকে আচঁড় টেনে দিয়েছেন। আবার তুষার গলা পানির দ্বারা সৃষ্ট রাস্তাগুলোকে দূর হতে সাদা দুধের নহর মনে হচ্ছিল। যা উচুঁ পাহাড়ের বুক বেয়ে সরু খরস্রোতা পাহাড়ী নদীতে গিয়ে মিশে যাচ্ছিল। এ এক অভূতপূর্ব সৌন্দর্য ও দৃশ্য। সুবহানআল্লাহ ! সবাই গাড়ী থেকে এই অপরূপ দৃশ্য ভিডিও করছিল। আমরা অবশেষে সোনমার্গে পৌঁছি। মনে হচ্ছিল ইউরোপের কোন ঘোড়ার আস্তাবল ও চারণভূমিতে চলে এসেছি।
প্রচুর পর্যটক। ঘোড়ার মালিকরা তাদের ঘোড়া আবার কেউ কেউ জীপ গাড়ী নিয়ে পর্যটকের জন্য অপেক্ষা করছে। যে যার ইচ্ছামতো ঘোড়া বা জীপ ভাড়া করে সোনমার্গ ঘুরে দেখতে পারে। ঘোড়ার সাথে একজন গাইডও দেয়া হয়। নরম আলোকিত রোদে সবুজ ও সাদা প্রকৃতির চোখ ধাধাঁনো সৌন্দর্য যেন খালি চোখে উপভোগ করতে পারছিলাম না। তাই চোখে সানগ্লাস তুলে নিলাম। সানগ্লাসের ভিতর দিয় আলো-আধাঁরিতে সোনমার্গের প্রকৃতি অপূর্ব লাগছিল। সবাই প্রকৃতির সাথে ছবি তুলতে ব্যস্ত।
পরে ২টি জীপ গাড়ী ভাড়া করে সোনমার্গের শেষ গ্রাম পর্যন্ত ঘুরে দেখবার জন্য আমরা রওয়ানা দিই। পাহাড়ের বুকে পথ ধরে গাড়ী ছুটে চলছে। প্রথমে সেখানকার একটি পার্কে নিয়ে যায়। সবুজ ঘাসের কার্পেটে মোড়ানো বিশাল মাঠ। পাশ দিয়ে বয়ে চলা স্বচ্ছ পানির লেক। পানির ভিতরে শ্যাওলাগুলো পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল। তাই দূর হতে সবুজ পানি মনে হচ্ছিল। এক পাশ থেকে পাথুরে পাহাড়, যার বুকে মাঝে মাঝে পাহাড়ী ঝর্ণা আর বরফের আস্তর। বাচ্চারা সবাই আনন্দে ছুটোছুটি করছিল। অনেকে পাহাড়ের উপর উঠার চেষ্টা করছিল। আমি পার্কের নরম সবুজ ঘাসের বুকে বসে চারপাশের সৌন্দর্য আর সবার আনন্দ করাকে উপভোগ করছিলাম। সবার আনন্দ উপভোগ করার মধ্যেও যে স্বর্গীয় মানসিক প্রশান্তি পাওয়া যায় তা’ বুঝতে পারছিলাম। “হে সৃষ্টিকর্তা ! তোমার নিয়ামতের শুকরিয়া কি দিয়ে আদায় করবো”। তাই গাড়ীতে জোহরের নামাজের সাথে দু’রাকাত শোকরানার নামাজ আদায় করেছিলাম।
এবার গাড়ী ছুটে চলেছে পাহাড়ের আরো উপরে। দূর হতে পাহাড়গুলোকে ব্কল্যাক ফরেস্ট কেকের মতো লাগছিল যার উপরের বরফগুলোকে সাদা ক্রীম মনে হচ্ছিল। তুষার গলা পানির পাথুরে খরস্রোতা নদীর কলকল ধারার শব্দ প্রকৃতিতে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। পথে ভারতীয় সৈন্যদের বেইস ক্যাম্পে গাড়ী থামে। সেখানে আমরা ছবি তুলি। অতঃপর গাড়ী পাহাড়ের আরো উপরে উঠতে থাকে। সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত ভারতের জনপ্রিয় মুভি “পুষ্পা” সিনেমাটির কেন্দ্রীয় চরিত্র পুষ্পার গ্রামের বাড়ীতে নিয়ে যায়। সেখানে একটি মসজিদ ছিল। কিন্তু তা বন্ধ ছিল।
আগামী মাসে মসজিদটি খুলবে। কারণ গ্রীষ্ম থেকে বসন্তকাল পর্যন্ত মসজিদটি খোলা থাকে। তখন মসজিদের ইমাম আবার এই গ্রামে ফিরে আসেন। সেখানকার গাড়ীচালক জানালেন প্রচন্ড ঠান্ডার কারনে এখানকার অধিবাসীরা শীতকালে দূরে বসবাসের জন্য উন্মুক্ত জায়গায় চলে যায়। আবার গ্রীষ্মের শুরুতে ওরা তাদের গ্রামে নিজ বাড়ীতে ফিরে আসে।
কেননা এখানে শীতকালে সাদা সোনা বা বরফ ছাড়া আর কিছুই দৃষ্টিগোচর হয় না। এরপর গাড়ী ছুটে যায় হিন্দুদের পবিত্র অমরনাথ যাত্রার তীর্থযাত্রীদের বেইস ক্যাম্পের দিকে যা সেখানকার বালতাল পর্বতের পাদদেশে অবস্থিত। জুলাই-আগষ্ট মাসে এই সকল ক্যাম্পে প্রচুর তীর্থযাত্রীদের সমাবেশ দেখা যায়। ফলে তখন সে সময় এখানে প্রচুর ট্রাফিক জ্যামও হয়। সেখান থেকে সোনমার্গের শেষ গ্রামের দিকে গাড়ী ছুটে চলে। সেখানে যাবার পথে একটি পাহাড়ের কাছে গাড়ী থামে। গাড়ীর ড্রাইভার একটি ভাঙ্গাঁ পুরনো কাঠের ছোট সেতু বা ব্রীজ দেখিয়ে জানান। একে এরা জিরো পয়েন্ট বলে।
প্রকৃতপক্ষে জিরো পয়েন্ট সমুদ্রপৃষ্ট থেকে ঐ পাহাড়ের ১৫৩০০ মিটার উচুঁতে অবস্থিত যা ভারত ও চীনের বর্ডারের কাছাকাছি অবস্থিত। এখানে রয়েছে সিন্দ নদী যা সিন্দ পর্বতের মাঝে দিয়ে বয়ে চলেছে। সিন্দ নদীর উৎস হিন্দুদের পবিত্র লেইক গঙ্গবাল বা হুরমুক পর্বতকে ধরা হয়। এই সোনমার্গ পৃথিবীর ভূস্বর্গ এবং মিনি সুইজ্যারল্যান্ড হিসেবে খ্যাত।