ভূমিকম্প এবং বাংলাদেশ

22

 

রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম সহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ৬ দশমিক ১ মাত্রার ভূকম্পন অনুভূত হয়েছে। ২৬ নভেম্বর ভোর ৫টা ৪৫ মিনিটে ভূকম্পন অনুভূত হয়। এভাবে প্রায়ই ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠছে দেশ। যা দেশবাসীর মনে আতঙ্ক ছড়ায়। সবার ভয় এই বুঝি ভেঙে পড়বে ঘর-বাড়ি মাথার উপর; এই বুঝি মৃত্যু নিশ্চিত। ভূমি কম্পকে ভয় পেলে চলবে না। ভয়কে জয় করতে হবে। ভূমিকম্প থেকে বাঁচার উপায় বের করতে হবে। দীর্ঘ দিন ধরেই বাংলাদেশে শক্তিশালী ভূমিকম্প এবং সুনামির আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এর লক্ষণ হিসেবে প্রায়ই দেশের কোথাও না কোথাও মৃদু ও মাঝারি মাত্রায় ভূমিকম্প হচ্ছে। প্রশ্ন হলো ভূমি কম্প মোকাবিলায় বাংলাদেশ কি প্রস্তুত? পাঠক রানা প্লাজা ধসের পরই আমাদের সক্ষমতা কতোটুকু তা আর বুঝতে বাকি থাকেনা। ভূমিকম্প পরবর্তী প্রস্তুতি খুবই জরুরী। হালসময়ে যে ভূমিকম্প হচ্ছে প্রায় সব কটারই এর উৎপত্তি স্থল ভারতের ত্রিপুরা, মায়ানমার, নেপাল কিংবা চীনে। আমাদের সবচেয়ে কাছে ত্রিপুরায় উৎপত্তি হওয়া ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৫.৫, তবে অন্যান্য ক্ষেত্রে ৭.৪ এবং ৭.৯ মাত্রার ভূমিকম্পও হয়েছে। আমাদের থেকে ভৌগোলিকভাবে সেসব ভূমিকম্পের উৎপত্তি স্থল দূরে হওয়ার কারণে সেসবের মাত্রা আমরাত তটা অনুভব করিনি। এ ছাড়াও এ সময়ে ছোট এবং মাঝারি কয়েক দফা ভূকম্পন অনুভূত হয়। মাত্রা হিসাবে নেপাল, চীন এবং ভারতের প্রায় অর্ধেক মাত্রায় ভূমিকম্প অনুভূত হয় বাংলাদেশে। নেপালের সম মাত্রায় বাংলাদেশে ভূমিকম্প হলে রাজধানী ঢাকার ৬০ থেকে ৭০ ভাগ ভবন ধসে এবং হেলেপড়ার আশঙ্কা রয়েছে। সারাদেশে ক্ষয় ক্ষতির পরিমাণ কতো ভয়াবহ হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।
বিগত ২০০ বছরে বাংলাদেশে ৮টি বড় ধরনের ভূমিকম্পের মধ্যে ১৮৮৫ সালের বেঙ্গল ভ‚মিকম্প ও ১৮৯৭ সালের ভ‚মিকম্পের মতো আরেকটি ভূমিকম্প আঘাত হানলে ভবনের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে আগের চেয়ে বাংলাদেশে ক্ষতি হবে বহুগুণ বেশি। ১৮৯৭ সালের ১২ জুন রিখটার স্কেলের এক ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৮ দশমিক ১, যা সর্বোচ্চ ১০ মাত্রায় পৌঁছে। সেটিরও উপকেন্দ্র ছিল বাংলাদেশ সীমানার কাছাকাছি তৎকালীন আসাম ও আজকের মেঘালয়। এ ভূমিকম্পে ব্যাপক সম্পদহানি ছাড়াও মৃত্যুবরণ করে ১ হাজার ৫৪২ জন মানুষ। ১৯১৮ সালের শ্রীমঙ্গল ভূমিকম্পের উৎপত্তি স্থল ছিল বাংলাদেশের অভ্যন্তরেই। বিগত বছর গুলোতে দেশে মৃদু ও মাঝারি ধরনের ভ‚মিকম্পই হয়েছে অনেকবার। তাতে বড় ধরনের কোনো ধ্বংসযজ্ঞ না হলেও বিভিন্ন স্থানে ভবন হেলেপড়া বা ফাটল ধরার ঘটনা ঘটেছে। ভূমিধসও দেখা গেছে কোথাও কোথাও। ১৯১৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর বিকাল ৩টা ২৮ মিনিটে রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামে রিখটার স্কেলে ৫ দশমিক ৩ মাত্রার মাঝারি ধরনের ভ‚কম্পনের উৎপত্তিস্থল ছিল ভারত-মিয়ানমার সীমান্ত এলাকায়। এসব ভূমিকম্প বাংলাদেশের বাহিরের সীমানায় উৎপত্তিস্থল থাকায় ক্ষয়ক্ষতি কম হয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন বাংলাদেশ ক্রমেয়েই বড় ধরনের ভূমিকম্পের দিকে এগুচ্ছে। ছোট ছোট ভূমিকম্প গুলোই তার জানান দিচ্ছে। ২০২১ সাল ২৬ ডিসেম্বর ভোরে ৬.১ মাত্রার যে ভূমিকম্প হয়েছে তা সবার মাঝে আতংক তৈরি করে বৈকি! এ অবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে ভূমিকম্পে আমাদের প্রস্তুত কিনা? ভূমিকম্প পরবর্তী সময়ে উদ্ধার কাজের জন্য সরকারের কতটা সক্ষমতা রয়েছে?
সরকারের তরফ হতে যন্ত্রপাতি ক্রয় ও স্বেচ্ছাসেবক প্রশিক্ষণের কথা বলা হলেও ভূমিকম্প পরবর্তী বিপর্যয় সামাল দেয়ার ন্যূনতম প্রস্তুতিও যে আমাদের নাই তা স্পষ্ট। ব্যাপক অভাব জনসচেতনতাও তৈরি করা হয়নি। ভূমিকম্পের ব্যাপারে গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ, ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার প্রচারণার কোনোটাই সরকারের পক্ষ থেকে করা হচ্ছে না। ইতোমধ্যে অনেক মূল্যবান সময় অপচয় হয়েছে। আর বিলম্ব করা সমীচীন হবেনা। ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবিলায় সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণের প্রকৃত সময় এখনই। ভূমিকম্প মোকাবিলায় সর্বদা আমাদের নিজেদেরও প্রস্তুত থাকতে হবে। ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবিলার ক্ষেত্রে আমাদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত দুইটি। প্রথমত, ভূমিকম্পে ক্ষয় ক্ষতির মাত্রাকে নিম্নতম পর্যায়ে রাখা এবং দ্বিতীয়ত, ভূমিকম্প পরবর্তী বিপর্যয় সামাল দেয়া।
পত্রিকান্তে বিশেষজ্ঞদের যে মতামত পাওয়া গেছে, তাতে ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই আমাদের দেশে সুনামি ও ভূমিকম্পের ঝুঁকি বেশি। তাদের মতে ৩টি প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। বঙ্গোপসাগারের কূল ঘেঁষে বেঙ্গল বেসিনের প্রধান অংশে বাংলাদেশের অবস্থান। তবে বড় ভূমিকম্প হবেই কিন্তু নিশ্চিত করে বলা যাবেনা। ভুমিকম্পের ব্যাপারে কেউই কোনকিছু নিশ্চিত করে বলতে পারেনা। তবে সম্প্রতি যেভাবে দেশে ঘনঘন ভূমিকম্প অনুভূত হচ্ছে তাতে আতঙ্ক বাড়ে বৈকি? অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস পাওয়া যায়। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগাম খবর অনুযায়ী জান মাল রক্ষায় ব্যবস্থা নেয়া যায়। কিন্তু ভূমিকম্পের বেলায় সে সুযোগ নেই। ভূমিকম্প ঘটে হঠাৎ করে। ফলে জানমাল রক্ষার প্রস্তুতি গ্রহণ করা সম্ভব হয় না। তাই ভুমিকম্পের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। ভুমিকম্প হলে কি করণীয় তার প্রস্তুতি নিতে হবে। ভুমিকম্প হলে নিচের ৬টি বিষয় খুব লক্ষ রাখবেন। তাতে ভুমিকম্পে ক্ষতি অনেকটা কমানো যাবে।
১। ভূমিকম্পের সময় সবচেয়ে উত্তম পন্থা হলো ‘ড্রপ-কাভার-হোল্ড অন’ বা ‘ডাক-কাভার’ পদ্ধতি। অর্থাৎ কম্পন শুরু হলে মেঝেতে বসে পড়ুন, তারপর কোন শক্ত টেবিল বা ডেস্কের নিচে ঢুকে কাভার নিন, এমন ডেস্ক বেছে নিন বা এমনভাবে কাভার নিন যেন প্রয়োজনে আপনি কাভারসহ মুভ করতে পারেন। তাদের মতে, ভূমিকম্পে আমেরিকার খুব কম বিল্ডিংই কলাপস করে; যেটা হয় তাহলো আশেপাশের বিভিন্ন জিনিস বা ফার্নিচার গায়ের উপর পড়ে নেক-হেড-চেস্ট ইনজুরি বেশি হয়। তাই এগুলো থেকে রক্ষার জন্য কোন শক্ত ডেস্ক বা এরকম কিছুর নিচে ঢুকে কাভার নেয়া বেশি জরুরি।
২। ভূমিকম্পের সময় কোন ফ্লোর নিরাপদ? অনেকে এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে চান। এটা ঐ জায়গার মাটির গঠন, বিল্ডিং কিভাবে তৈরি- এটারও পরই অনেকাংশে নির্ভর করে। সাধারণত ভূমিকম্পের সময় চার ভাবে ফ্লোরবা দালান ধসে পড়তে পারে। দালানের কোন্ তলা বেশি নিরাপদ- এক্ষেত্রে বেশির ভাগ মতামত যেটা পেয়েছি তাহলো ভূমিকম্পের সময় উপরের দিকের তলা গুলোতে দুলু নি হবে বেশি, নিচেরতলায় কম। কিন্তু দালান যদি উলম্ব বরাবর নিচের দিকে ধসে পড়ে তবে নিচতলায় হতাহত হবে বেশি, কারণ উপরের সব ফ্লোরের ওজন তখন নিচে এসে পড়বে। তাই ভূমিকম্পের সময় নিচে নামার চেষ্টা না করে যেখানে আছেন সেখানেই শতর্ক অবস্থানে থাকুন। মনে রাখতে হবে ভুমিকম্পে প্রলয় ঘটে কয়েক সেকেন্ডে তখন কোন সুযোগই আপনি পাবেন না।
৩। যে ফ্লোরেই থাকুননা কেন ভূমিকম্পের সময় বেশি নড়াচড়া, বাইরে বের হবার চেষ্টা করা, জানালা দিয়ে লাফ দেবার চেষ্টাই ত্যাদি না করাই উত্তম। একটা সাধারণ নিয়ম হলো- এসময় যতো বেশি মুভমেন্ট করবেন, ততো বেশি আহত হবার সম্ভাবনা থাকবে। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে অফ দ্য রেকর্ড একটা কথা- যদি গ্রাউন্ড ফ্লোরে একেবারে দরজার কাছে থাকেন, তবে এক দৌড়ে বাইরে কোন খোলা জায়গায় চলে যান। সিঁড়ি পার হয়ে যেতে হলে না যাওয়াই ভালো।
৪। কিছুতেই সিঁড়িতে আশ্রয় নেয়া উচিত নয়। এছাড়া ভূমিকম্পের সময় এলিভেটর/লিফট ব্যবহারও উচিত না।
৫। রাতে বিছানায় থাকার সময় ভূমিকম্প হলে উদ্ধারকর্মী বলছে- গড়িয়ে ফ্লোরে নেমে পড়তে- এটা বিল্ডিং ধসার পার্সপেক্টিভেই। রেডক্রস বলছে- বিছানায় থেকে বালিশ দিয়ে কাভার নিতে, কারণ সিলিং ধসবেনা, কিন্তু ফ্লোরে নামলে অন্যান্য কম্পনরত বস্তু থেকে আঘাত আসতে পারে।
৬। ভূমিকম্প হলে খুব অল্পসময়ের মধ্যে শেষ হয়। প্রলয় যা হবার তা হয় কয়েক সেকেন্ড কিংবা মিনিট সময়ের মধ্যে। এ সময়ে আপনি কি নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে পারবেন? রাস্তায় গিয়ে তো আরো বিপদে পড়তে হবে আপনাকে। বাড়ি ঘর হেলে গিয়ে ধসে পরে সব কিছু তো রাস্তার ওপরই পড়বে। বরং রাস্তায় থাকলে চাপা পড়ে, মাথা কিংবা শরীরেরও পরে কিছু পড়ে আপনি হতাহত হতে পারেন। যারা এক তলা কিংবা দোতলায় থাকেন পাশে খালি মাঠ থাকলে দ্রুত দৌড়ে যেতে পারেন। সেখানে যেতে যদি জঞ্জাল থাকে তাহলে সৃষ্টি কর্তাকে ভরসা করে শক্ত কোনো কিছুর নিচে অবস্থান নেয়াই শ্রেয়। ভিম কিংবা কলামের পাশে শক্ত কোনো কিছুর পাশে থাকতে হবে। বিশেষ করে খাট কিংবা শক্ত ডাইনিং টেবিল হলে ভালো হয়। আগে থেকেই আশ্রয়ের জায়গা ঠিক করে নিতে হবে। ঘরে রাখতে হবে সাবোল এবং হাতুড়ি জাতীয় কিছু দেশীয় যন্ত্র। বাটাল, রশি, চার্যার কিংবা ব্যাটারি চালিত লাইট, হেক্সো বেøড রাখবেন। প্রয়োজনে এগুলো কাজে লাগতে পারে। ভূমিকম্প হলে অনেকেই তড়িঘড়ি করে নিচে ছোটেন। তারা জানেন না ভূমিকম্পে যতো ক্ষতি হয় তার চেয়ে বেশি ক্ষতি হয় অস্থির লোকদের ক্ষেত্রে। বিশেষজ্ঞদের মতে, কেবল ভূমিকম্পই নয়, দেশের উপকূলীয় এলাকা ঘিরে ভয়াবহ সুনামি সৃষ্টির জন্য সাইসমিক গ্যাপ বিরাজ মান আছে। এ গ্যাপ থেকে যে কোনো সময় সুনামিও হতে পারে। তাদের মতে বঙ্গোপসাগরের উত্তরে আন্দামান থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সাবডাকশন জোনবরাবর ৬শ’ কিলোমিটারের একটি সাইসমিক গ্যাপ রয়েছে। আমাদের দেশে শক্তিশালী ভূমিকম্প হওয়ার জন্য যথেষ্ট শক্তি এই সাইসমিক গ্যাপে জমা হয়ে আছে। এখান থেকে ৮ মাত্রার মতো শক্তিশালী ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর তা যদি সাগর তলে হয় তাহলে সেই ভূমিকম্প সুনামি সৃষ্টি করতে পারে। বাংলাদেশে শক্তিশালী ভূমিকম্প এবং সুনামিরই আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাহলে কি ভূমিকম্পে শুধুই অকাতরে প্রাণ দিতে হবে? জীবন রক্ষার কি কোনো উপায় নেই। এ দুর্যোগ থেকে কিছুটা রক্ষা পেতে পূর্ব প্রস্তুতি দরকার। প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো ভূমিকম্পে আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন হওয়া অধিক জরুরি। তাই ভূমিকম্পের সময় করণীয় সম্পর্কে সঠিক ধারণা রাখা এবং সে অনুযায়ী প্রস্তুত থাকা প্রয়োজন। জাতিসংঘের তৈরি ভূমিকম্পজনিত দুর্যোগের তালিকায় ঢাকা এখন দ্বিতীয় অবস্থানে। ভূ বিদদের এক পরিসংখানে দেখা গেছে সাড়ে সাত মাত্রার ভূমিকম্প হলে কেবল রাজধানী ঢাকার প্রায় ৩ লাখ ২৬ হাজার অবকাঠামোর মধ্যে ৭২ হাজার ভবন ধসে যাবে। এতে প্রায় ৯০ হাজার লোকের প্রাণহানী হবে। তাই সচেতন হওয়ার পাশাপাশি যথাযথ উদ্যোগও নিতে হবে। যাতে ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা নিম্নতম পর্যায়ে রাখা যায়। ভূমিকম্পকে ভয় পেলে চলবেনা। ভয়কে জয় করতে হবে। ভূমিকম্প থেকে বাঁচার উপায় বের করতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সমাজগবেষক