ভূমিকম্পের উচ্চঝুঁকিতে চট্টগ্রাম-সিলেট জনসচেতনতার পাশাপাশি কাঠামোগত প্রস্তুতি নিতে হবে

34

গত মাসের শেষ শনিবার সিলেটের জৈন্তাপুরে এবং জগন্নাথপুরে ছোটমাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে। এসময় এক ঘণ্টার মধ্যে চার দফা ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এতে শুধু সিলেট নয়, পুরো দেশজুড়ে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। সম্প্রতিককালে বড়মাত্রার ভূমিকম্প হয়নি মানে এই নয় যে, এখানে আর বড় ভূমিকম্প হবে না। বরং বিশেষজ্ঞরা বলছেন এধরনের ছোট ছোট ভূমিকম্প বড় ভূমিকম্পের ইঙ্গীত বহন করে। যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর ও বাংলাদেশের একদল বিজ্ঞানী তাদের গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারের কিছু অংশজুড়ে ভূগর্ভে বিরাট এক ফাটলরেখা বা ‘ফল্ট’ আছে। এর কারণে এই এলাকায় বেশ বড় আকারের ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাঁদের আনুমানিক হিসাবে রিখটার স্কেলে ৮ দশমিক ২ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে, যার ফলে ফাটলরেখা এলাকার আশপাশে ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিপুল প্রাণহানি ও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হবে। দুঃসংবাদটা হচ্ছে সিলেট ও চট্টগ্রামে এ ঝুঁকিটা বেশি। বৃহস্পতিবার দৈনিক পূর্বদেশে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডাউকি ফল্ট লাইনে থাকা সিলেট অঞ্চলে এর আগে বড় ভূমিকম্প হয়েছিল ১৮৯৭ সালে। রিখটার স্কেলে ৮ মাত্রার ওপরে থাকা সেই ভূমিকম্পে সিলেটে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। এর প্রায় একশত বছর পর ১৯৯৬ সালে চট্টগ্রামেও বড় ধাক্কা লেগেছিল ভূমিকম্পের। কাজেই চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলে ব্যাপক সতর্কতার প্রয়োজন। ভ‚মিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্রের তথ্য বলছে, গত ২৯ মে থেকে সর্বশেষ ৭ জুন পর্যন্ত সিলেট অঞ্চলে মাত্র তিনদিনে সাত দফা মৃদু মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। এর মধ্যে গত ২৯ মে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মত একদিনেই উপর্যুপরি চার দফা ভূ-কম্পন অনুভূত হয়। এছাড়া চট্টগ্রাম, রাঙামাটি পার্বত্য জেলা ও কক্সবাজার’সহ আশপাশের এলাকায় সর্বশেষ গত ১৮ এপ্রিল সন্ধ্যা সাতটা ২৪ মিনিটে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়। বিশেষ করে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় ওই ভূ-কম্পনটি তুলনামূলকভাবে বেশি অনুভূত হয়েছিল। রিখটার স্কেলে পাঁচ দশমিক শূন্য মাত্রার ওই ভ‚মিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল প্রতিবেশি দেশ মিয়ানমারের হেখা অঞ্চলে। দেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয় রাজধানী ঢাকার আগারগাঁও থেকে ৪১৪ কিলোমিটার দূরত্বের পাশাপাশি ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ২৭ দশমিক ৩ কিলোমিটার গভীরে ভূ-কম্পন হওয়ার কারণে সেটা খুব বেশি টের পাওয়া যায়নি। অতিমাত্রায় ঘনবসতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জন্য এ খবরটি মোটেই সুখকর নয়। কারণ, ভূমিকম্প এমন এক প্রাকৃতিক বিপর্যয়, যার মানবিক ক্ষয়ক্ষতির তারতম্য নির্ভর করে মূলত সংশ্লিষ্ট এলাকার জনঘনত্বের ওপর। অতি ঘনবদ্ধ জনবসতির ক্ষতির মাত্রা হয়ে থাকে সর্বাধিক। ভূমিকম্পের পূর্বাভাস পাওয়া যায় না; এ বিপর্যয় আসে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো। আমাদের জন্য দুশ্চিন্তার বিষয় হলো, ভূমিকম্প মোকাবিলার অভিজ্ঞতা আমাদের কম। কারণ, এ দেশে ঘন ঘন ভূমিকম্প হয় না। ৮-৯ মাত্রা দূরে থাক, ৭ মাত্রার ভূমিকম্পের অভিজ্ঞতাও আমাদের অত্যন্ত বিরল। বিপদ লুকিয়ে আছে এখানেই। কারণ, বড় ভূমিকম্প হঠাৎ আঘাত হানলে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা যথাসম্ভব কম রাখা যাবে কিভাবে -এসব নিয়ে আমরা মোটেই ভাবছিনা। এ নিয়ে ব্যাপক কোন আলোচনা সরকারি নীতি-নির্ধারক পর্যায়ে হচ্ছে কিনা তাও আমাদের জানা নেই। কিন্তু ব্যাপারটি ভুলে থাকার সুযোগ নেই। অবশ্যই আমাদের প্রস্তুত নিতে হবে: কিছু দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতি, কিছু তাৎক্ষণিক দুর্যোগ মোকাবিলা-বিষয়ক। প্রথমত, ঘরবাড়িসহ সব ধরনের ইমারত ও ভৌত অবকাঠামো নির্মাণে ভূমিকম্প-সহনক্ষম প্রযুক্তি ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবে, নগরায়ণের বিশৃঙ্খলা দূর করতে হবে। দ্বিতীয়ত, বিপদকালীন উদ্ধার-তৎপরতা, ভূমিকম্পজনিত গ্যাস-বিস্ফোরণ, অগ্নিকাÐসহ অন্যান্য দুর্ঘটনা মোকাবিলার সামর্থ্য-দক্ষতা বাড়াতে হবে। ভূমিকম্পের সময় করণীয় সম্পর্কে কনটিনজেন্সি পরিকল্পনা তৈরি করে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। সবচেয়ে ঝুঁকিটা বেশি থাকে ইট-পাথরের তৈরি দালান-কোঠার নগরীতে। তাই নগর পরিকল্পনায় অনেক বেশি সতর্ক থাকতে হবে। যথাযথ পরীক্ষার মাধ্যমে সব ভবনের ভূমিকম্প-প্রতিরোধী সার্টিফিকেট নেওয়া বাধ্যতামূলক করতে হবে। দুর্যোগ মোকাবিলার প্রস্তুতি শক্তিশালী করতে হবে। আমাদের এখন যে প্রস্তুতি আছে এ সময় মাঝারি ও বড় ভূমিকম্প হলে দেশ অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এর মূল কারণ, আমাদের ভবনের সংখ্যা বাড়ছে। ভূমিকম্পের ঝুঁকি হ্রাস করার মূল অস্ত্র হচ্ছে বিল্ডিং কোড মেনে চলা। কেবল বিল্ডিং কোড থাকলেই হবে না, প্রয়োজন এর সফল ও সঠিক প্রয়োগ। ভূতত্ত্ববিদ ও সিসমোলজিস্টদের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে যেকোনো সময় মাঝারি কিংবা বড়মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে। এজন্য আমাদের কাঠামোগত এবং অবকাঠামোগত প্রস্তুতি এখনই বাড়ানো দরকার। এ ধরনের প্রস্তুতির মধ্য দিয়ে ভূমিকম্প দুর্যোগের ঝুঁকি বহুলাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।