ভূতের ভয়

187

খুব সাহসী ছেলে অভয়। দিন দুপুর আর রাত দুপুর বলে তার কাছে কিছু নেই। এজন্য সবাই তার সাহসের তারিফ করে। বয়সও বেশি নয়, বিশের নিচেই হবে। রাতের বেলা কেউ কোন কাজের দরকার পড়লে ডাক পড়ে অভয়ের। বাবার আর্থিক দুরবস্থার কারণে লেখাপড়াও বেশি দূর এগোয়নি। বাড়ির লোকের এই কাজ সেই কাজ করতে করতে কখন সূয্যটা বিধায় নেয় খেয়ালও করতে পারে না অভয়। ধীরে ধীরে ছেলেটা ভীষণ সাহসী হয়ে উঠল। ঝাড়ে জঙ্গলে কাজ করতে করতে সাপ,ব্যাঙ,ভূত, পেত্নী কিছুকেই ভয় পায় না অভয়। হোক দিন আর রাত। মানুষ সাপ দেখলে ভয়ে পালায়, আর অভয়কে সাপে দেখলে ভয়ে পালায়। ভূত পেত্নী কোথায় থাকে খোঁজ করে সেই। যত বড় ঝাড় জঙ্গলই হোক না কেন, ওখানে প্রবেশ করা তার জন্য পানিভাত। গ্রামের ভেতর রাস্তা চলে গেছে অগ্নিকোণ বরাবর। অই কোণেই বিশাল শ্মশান খোলা। বহু পুরনো শ্মশান হওয়াতে গাছ গাছালিতে ভরপুর। কত হাজার নাম না জানা গাছ গাছালি আছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। তিন চারটি তালগাছ দাড়িয়ে আছে যেন আকাশ ছোবে। একটিতে তাল ধরে, পেঁকে পেঁকে ঝরে পরে। কেউ ভয়ে তাল কুড়িয়ে আনতে সাহস করে না। সুযোগটা কাজে লাগায় অভয়। তাল গুলো কুড়িয়ে এনে কিছু ধান্ধা করে টাকা পায়। আবার কেউ খুঁজে নিয়ে টাকা না দিলেও কিচ্ছু কয় না অভয়। এজন্য সবাই তাকে ভালোবাসে। শুধু যে তালগাছ আছে তা নয়, অনেক ধরনের ফল মূলের গাছের অভয়ারণ্য শ্মশান জঙ্গলে। ওগুলো মানুষেরা খেতে না পারলেও প্রকৃতির প্রাণী কুলেরা নিজেদের ভোগ মেটায়। দিনের আলো যখন নিবে গিয়ে রাতের আঁধার গমন করে বিভিন্ন প্রাণীর আওয়াজ কানে বাজে অনেক দূর থেকেও। অনেকে ভয়ে সন্ধ্যার পর ওদিকে হাঁটে না। যারা হাঁটে তারাও সাহসী বলা যায়। সবাই বলে আমবস্যার রাতে নাকি ভূত পেত্নীদের জন্য খুশির দিন। অই দিন ভূত পেত্নীরা পুলকে মেতে ওঠে। আলো ভূত, কালো ভূত, আন্ধা ভূত, মান্ধা ভূত, খামতো ভূত,মামতো ভূত, জামতো ভূত, যত রকম ভূত পেত্নী আছে সবাই দল বল, বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে পথে ঘাটে ঘুরে বেড়ায় নিজেদের খেয়াল খুশি মতো। আর এই অবস্থায় যদি কাউকে, মানে কোন মনুষ্যকে সামনে পায়, তাহলে তার কী অবস্থা হবে সহজেই অনুমেয়। বয়স্করা কেউ কেউ বলে বেড়ায় আগেরকার দিনে এই শ্মশান জঙ্গলে অনেকে গিয়েছে, কিন্তু সবাই ফেরত আসেনি। দুই তিনদিন পর খালে বিলে পাওয়া যেত। এগুলো শুনলে মানুষ আরো ভয়ে কাতর হয়ে যায়। কিন্তু ব্যতিক্রম অভয়। অভয় বলে ফেলে রাখ, আগেরকার দিন। এখনকার দিনের কথা বলো। আগে ভূতে নাকি মানুষের ঘাঁড় ভেঙ্গে দিত, এখন ভূতকে পেলে আমিই ঘাঁড় ভেঙ্গে দেব। ভূত কোথায় থাকে বা আছে আমাকে নিয়ে চলো। দেখি ভূতগুলো কত শক্তিশালি। এই শ্মশান জঙ্গলে আমি কত ভূতকে খুঁজলাম কিন্তু পাইনি। আসলে ভূতগুলো থাকে কই? জানলে আমাকে ঠিকানা দাও। আমি যাব ভূতের বাড়ি। অভয়ের কথা শুনে সবাই হাসে আর ভাবে ছেলেটা আসলেই সাহসী। অমাবস্যা আর পূর্নিমা যত ঘন কালো অন্ধকার রাত হোক, তার কাছে ভয় শব্দটা ঘেষতে পারে না কখনো। অনেকের কাছে শুনেছে, বৈদ্য কবিরাজরা নাকি কালি পূজার পাগলা অমাবস্যার রাতে শ্মশান জঙ্গল থেকে তাদের প্রয়োজনীয় ঔষুধ সংগ্রহ করে। কথাগুলো শুনে অভয়ের মনে কৌতুহল আরো বেড়ে গেছে। এবার অমাবস্যার রাতে সেইও যাবে শ্মশান জঙ্গলে। দেখি ভূত টুত কিছুর সাক্ষাত পাই কিনা! এই প্রতিজ্ঞায় দিন কাটে অভয়ের। এভাবে দিন গড়িয়ে সামনে এলো পাগলা অমাবস্যার রাত। আজকে অভয়ের ভূত দেখার দিন। দেখবে বৈদ্য কবিরাজদের কান্ড কারকানা। এলাকার যারা অভয়ের এই যাত্রার কথা জানে বা শুনছে তাদের মাঝেও একটা কৌতুহলের সৃষ্টি হলো। কেউ কেউ তাকে বুঝায়, অভয় এসব করে তোমার কোন লাভস্বার্থ আছে? না, আমি চাই এই ভূত পেত্নীর ভয়টা মানুষ থেকে দূর হোক। আমি প্রমাণ করতে চাই আসলেই ভূত পেত্নী বলতে কিছু নেই। যেই বলা সেই কাজ। রাত যখন ঠিক দূপুরে অবর্তীন ঠিক তখনি অভয় এগোতে থাকে শ্মশান জঙ্গলে। কেউ কেউ ভয় কাতরে অপেক্ষা করতে থাকে কি অবস্থা হয় অভয়ের। এমন ঘন কালো অন্ধকার রাত নিঝুম এমনিই ভয় লাগার কথা। কিন্তু অভয়ের ভয় নেই। না জানি কি হয়! ধীর পায়ে এগোয়। শ্মশান জঙ্গল পুরো চষে বেড়াচ্ছে অভয়। খুঁজে চলেছে ভূত পেত্নী। রাত শেষের পথে। এখনো পর্যন্ত কোন ভূত পেত্নীর সাথে অভয়ের দেখা সাক্ষাতের সুযোগ হয়নি। কোন বৈদ্য কবিরাজের সাথেও না। শ্মশান জঙ্গল ঘুরতে ঘুরতে এক সময় যেন আর পা এগোতে চায় না। আগে কখনো এমন ক্লান্তি অনুভব হয়নি। হঠাৎ অভয়ের কানে কী একটা বিকট শব্দ অনুভূতি হল। কোন দিক থেকে শব্দটা এল বুঝতে চেষ্টা করছে। না, বুঝতে পারছে না। এবার একটা দমকা হাওয়া। তবুও মনোবল স্থির রাখতে সচেষ্ট অভয়। এক পা দু’পা করে পা বাড়াচ্ছে সামনের দিকে। আবারো একটি দমকা হাওয়া। এই হাওয়াতে অভয়ের শরীর হিম শীতল অনুভূত হল। ভারি হয়ে উঠল শরীর। ঠিক আবারো হিম শীতল দমকা হাওয়া সজোরে ধাক্কা দিল অভয়কে। এবার আর স্থির থাকতে পারেনি অভয়, পড়ে গেল মাটিতে। আর হুঁশ নেই অভয়ের। রাত পেড়িয়ে যখন ভোর হলো তখন এলাকার সবাই অভয়ের খোঁজ করতে লাগল। কোথায়, কোন সমস্যা হল না তো? কোন একজন দেখল, শ্মশান জঙ্গলে মাটিতে পড়ে আছে অভয়। সবাই ধরাধরি করে সেবা যত্ন করে যখন অভয়ের হুঁশ ফিরল তখন সবাই জিজ্ঞাসা করছে, কি অভয় ভূত ধরতে গেলি কিন্তু ভূত পেলি না? সবার দিকে তাকায় অভয়। বলে ওঠে, আসলে কিন্তু ভূত নেই তবে ভূতের ভয় আছে। এটাই এখন বিশ্বাস করি।