ভুয়া মামলা, নামের মিল

108

সবুর শুভ

লাকী আক্তার নামে এক নারী ২০১৫ সালের ১৮ জানুয়ারি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২ এ একটি মামলা দায়ের করেন। পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে এ মামলায় অভিযোগ আনা হয় তাকে ধর্ষণের। এ মামলায় মূল আসামি ছিলেন শুলকবহর এলাকার মুন্সিপুকুর পাড়স্থ শেখ শহীদ হোসেন। বিচারক পতেঙ্গা থানা কর্তৃপক্ষের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন চান। এরপর শেখ শহীদসহ আসামিদের প্রতিপক্ষের তরফে থানার সীল স্বাক্ষর জাল করে আদালতে একটি প্রতিবেদনও জমা দেয়া হয়। আদালতে দাখিল করা জাল প্রতিবেদনটি বিশ্বাস করানোর জন্য এতে পতেঙ্গা থানার এসআই মো. গোলাম আবছারের নামটিও জুড়ে দেয়া হয়। ওই ভুয়া মামলা ও জাল প্রতিবেদনটি আমলে নিয়ে পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয় নিয়ম অনুযায়ী। এরপর আসামিরা জানতে পারেন তাদের বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলা করেছে লাকী আক্তার নামে একজন। যদিও এ বাদীনীকে আদালতে আর কখনো হাজির করা যায়নি। ২০১৫ সালের ২৩ নভেম্বর এ মামলা ও তদন্ত প্রতিবেদন জাল হিসেবে আদালতের সামনে প্রমাণ হওয়ায় আসামিদেরকে অব্যাহতি দেন বিচারক। এ অবস্থায় সন্ধিগ্ধ আসামি হিসেবে ৬ জনের নাম উল্লেখ করে আদালতের কাছে প্রতিকার চান শেখ শহীদ হোসেন। ২০১৬ সালের ৫ জানুয়ারি আদালতে দাখিল করা শেখ শহীদের ওই আবেদনে কাউন্সিলর, এডভোকেট ও সংশ্লিষ্ট আদালতের পেশকারও রয়েছেন। এরপর আদালত ডিবিকে এ জালিয়াতির সাথে কারা জড়িত খুঁজে বের করার আদেশ দিলে ডিবি এ বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে আদালতে। ২০১৭ সালের ২০ জুনে আদালতে ডিবির ইন্সপেক্টও মোহাম্মদ ফজলুল করিম সেলিমের দাখিল করা প্রতিবেদনে শেখ শহীদের সন্ধিগ্ধ ৬ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পান। সর্বশেষ এ ঘটনায় হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ জালিয়াতকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য গত ২৩ সেপ্টেম্বর একটি আদেশ প্রচার করেছে।
আদালত ও কারাগার থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, অপরাধ না করেও দেড় বছর কারাভোগের পর সম্প্রতি মুক্তি পান হাসিনা বেগম (৪০) নামের এক নিরীহ নারী। জামিনে যাওয়ার পর মাদক মামলায় ছয় বছরের সাজাপ্রাপ্ত প্রকৃত আসামি হাসিনা আক্তারের বদলে সাজা ভোগ করেন টেকনাফের ওই নিরাপরাধ নারী । গন্ডগোল শুধু বেগম ও আক্তার এ দুই শব্দের মধ্যে। তিনি মুক্তি পেলেও তার সবকিছু তছনছ হয়ে যায়
একইভাবে ২০০৬ সালের জুলাই মাসে কোতোয়ালী থানার রহমতগঞ্জ এলাকায় কোহিনুর আক্তার ওরফে বেবী নামের এক নারীর খুনের মামলায় রায়ের দিন ছিল। কিন্তু অপরাধী কুলসুমী আদালতে অনুপস্থিত থাকায় আদালত তার বিরুদ্ধে সাজা পরোয়নাসহ গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। পরে ২০১৮ সালের ১২ জুন মিনু নামের এক মহিলাকে সাজাপ্রাপ্ত আসামি কুলসুম আক্তার ওরফে কুলসুমী সাজিয়ে আত্মসমর্পণ করানো হয় টাকার বিনিময়ে। সম্প্রতি সেই মিনু সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। জেলের ঘানি টানতে টানতে মিনুর পরিবারও তছনছ হয়ে যায়। ২০১৭ সালে কর্ণফুলীতে ইয়াবাসহ আটক হওয়ার ঘটনায় হাসিনা আক্তার নামের একজনের কারাদন্ডাদেশ হয়েছিল। তবে নামের একাংশের সঙ্গে মিল থাকায় তার জায়গায় প্রায় দেড় বছর ধরে সাজা খেটেছেন হামিদ হোসেনের স্ত্রী টেকনাফের এ হাছিনা বেগম (৪০)। মাদক মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামি একই এলাকার হাসিনা আক্তারের বদলে পুলিশ ভুক্তভোগী হাছিনা বেগমকে আটক করে আদালতে চালান করে। ২০০০ সালের ১৬ জুলাই কোতোয়ালী থানার লালদীঘির পাড় এলাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তার কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনায় মামলা হয়। ডাকাতি মামলার আসামির সঙ্গে নামের মিল। বাবার নামও একই। কিন্তু বাড়ির ঠিকানা ভিন্ন। তবে নামের মিল থাকার খেসারত দিতে হলো কুমিল্লার লেপতোশকের দোকানি মো. ইউনুছকে (৫৫)। পুলিশের ভুলে বিনা দোষে কারাভোগ করেন ৫৮ দিন। অবশেষে আদালতের নির্দেশে মুক্তি পান ।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন-(বিএইচআরএফ) প্রধান নির্বাহী এডভোকেট এলিনা খান ও চট্টগ্রামের প্রধান এডভোকেট জিয়া হাবিব জানান, শুধুমাত্র নামের মিল ও নাম বিভ্রাটের কারণে কিছু নিরীহ, নিরাপরাধ নারী পুরুষকে কারাভোগ ও চরম হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। বিষয়টি প্রশাসনের নজরে আসার পরেও দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হচ্ছে না এবং ক্ষতিগ্রস্তদের পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থাও করা হচ্ছে না। এতে এ ধরনের অপরাধের প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে।