ভুল প্রশ্নে ভর্তিপরীক্ষা

72

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) ‘ডি’ ইউনিটে ইংরেজি মাধ্যমের ৪১৬ জন শিক্ষার্থীর ভুল প্রশ্নে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে। ঘটনাটিকে ‘অনিচ্ছাকৃত ভুল’ দাবি করে এ ইউনিটের ফল প্রকাশ স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
এ ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে আগামী ৬ নভেম্বর ভুল প্রশ্নে পরীক্ষা দেয়া ওই শিক্ষার্থীদের পুনঃপরীক্ষা নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। শুধুমাত্র ৪১৬ জন শিক্ষার্থীর পরীক্ষা নেয়া হলে বৈষম্যের শিকার হতে পারেন বলে আশঙ্কা করছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
পরীক্ষা কেন্দ্র কি ঘটেছিল : গত ২৮ অক্টোবর ‘ডি’ ইউনিটের অধীনে দুই শিফটে প্রায় ৪৪ হাজার ৯৯০ জন ভর্তিচ্ছু অংশ নিয়েছেন। পরীক্ষায় ইংরেজি মাধ্যমের ন্যাশনাল ও ব্রিটিশ কারিকুলামের মোট ৬৭৬ জন শিক্ষার্থী আবেদন করেছিলেন। এর মধ্যে ন্যাশনাল কারিকুলামের ৪১৬ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিলেও তাদের জন্য আলাদা প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করা হয়নি। তাদের পরীক্ষা নেওয়া হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের নিচ তলার ১০১, ১০২ ও ১০৩ নাম্বার কক্ষে।
নিয়মানুযায়ী, ব্রিটিশ কারিকুলামের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় বাংলা বিষয়ের পরিবর্তে বিশেষ ইংরেজি বিষয়ে ৩০টি প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার কথা। আর ইংরেজি মাধ্যমে ন্যাশনাল কারিকুলামের শিক্ষার্থীদের পুরো প্রশ্নপত্র ইংরেজি ভাষায় প্রণয়ন করলেও, শুধুমাত্র বাংলা বিষয়ের আবশ্যক ৩০ নম্বরের প্রশ্ন বাংলা ভাষায় থাকার কথা। ন্যাশনাল কারিকুলামের প্রশ্নপত্র প্রণয়ন না করায় ‘ভুল নিয়মে’ ব্রিটিশ কারিকুলামের প্রশ্নপত্রেই তাদের পরীক্ষা দিতে বলা হয়। ওই সময় শিক্ষার্থীরা বাংলা বিষয় অংশের প্রশ্ন না দেখে আপত্তি জানালে, তাদের সাধারণ ইংরেজি বিষয়ের পাশাপাশি ব্রিটিশ কারিকুলামের প্রশ্নের বিশেষ ইংরেজি বিষয়ের উত্তর দিতে বলা হয়। ‘তোমরা যা পারো, তা লিখ। বাকিটা আমরা দেখবো’- এমন নির্দেশনাও দেয়া হয়। কিন্তু বাংলা আবশ্যক বিষয়ের পরিবর্তে ইংরেজি বিষয়ের উত্তর প্রদানের নির্দেশনাটি ‘মারাত্মক অনিয়ম’ বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
তুলকালাম কান্ড, জানানো হয়নি সংশ্লিষ্টদের : ভর্তি পরীক্ষা শুরুর পর ৪১৬ জন শিক্ষার্থী প্রশ্ন নিয়ে জটিলতায় পড়েন। সকাল ১১টা থেকে বিকাল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত বিষয়গুলো নিয়ে জটিলতা দেখা দিলেও এ বিষয়ে জানতেন না বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য (দায়িত্বপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার এবং ওই ইউনিটের প্রধান ও শিক্ষা অনুষদের ভারপ্রাপ্ত ডিন অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ আল ফারুক। ঘটনার একদিন পর অভিভাবকদের মাধ্যমে তারা জানতে পারেন বলে দাবি করেছেন। প্রশ্ন উঠেছে ইউনিট প্রধান ও উপাচার্যকে না জানিয়ে কিভাবে ভুল প্রশ্নে পরীক্ষা নেয়া হয়? ওই পরীক্ষার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের নিচ তলায় দায়িত্ব পালন করা একাধিক শিক্ষক জানিয়েছেন, বিষয়টি দেখভাল করে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. কাজী এসএম খসরুল আলম কুদ্দুসী।
বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘প্রশ্ন সংক্রন্ত জটিলতা দেখা দিলে বিষয়টি অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. ফরিদ উদ্দিন আহামেদকে জানিয়েছিলাম। ওই সময় অতিরিক্ত পর্যাপ্ত প্রশ্নপত্রও ছিল না যে, শিক্ষার্থীদের আদালা করে বাংলা প্রশ্ন দেওয়া হবে। ডিন নিষ্ক্রিয় থাকায় তাৎক্ষণিক পরিস্থিতির মোকাবেলায় আমি ব্রিটিশ কারিকুলামের প্রশ্নে পরীক্ষা দিতে বলি। কারণ তখন ওই শিক্ষার্থীদেরতো বের করে দেওয়া যায় না। আর মোবাইল নেটওয়ার্কে সমস্যা থাকায় বিষয়টি ইউনিট প্রধানকে জানাতে পারিনি।’
অভিযোগটিকে মিথ্যাচার বলে আখ্যা দিয়েছেন সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. ফরিদ উদ্দিন আহামেদ। তিনি বলেন, ‘ওইদিন কোন দায়িত্বরত কোন শিক্ষক বা কোন লেভেল থেকে আমাকে জানানো হয়নি। জানালে ১০ মিনিটের মধ্যে বিষয়টি সমস্যার সমাধান করা যেত। বাকি সবকিছু ঠিক আছে, তখন আলাদা করে শুধু বাংলা বিষয়ের প্রশ্ন সরবরাহ করলেই সমাধান হয়ে যেত। আর খসরুল কুদ্দুসী কোন দায়িত্বে এখানে এসেছেন বা তদারকি করে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, তাও আমি জানি না। তিনিও সমস্যার বিষয়ে আমাকে কিছু জানাননি। এ অনুষদের পরীক্ষার দায়িত্ব বন্টনের ফাইলে কোথাও আমি তার নাম দেখিনি। আর তাকে কি দায়িত্বে এখানে পাঠানো হয়েছে, তাও ইউনিট প্রধান আমাকে জানাননি। প্রথম শিফটের পরে বিরতি ছিল, তখনও বিষয়টি জানতে পারতেন তারা। কেউ আমাকে জানায়নি। আমি জেনেছি, কয়েকজন অভিভাবক থেকে।’
খসরুল কুদ্দুসীর দায়িত্বের বিষয়ে ইউনিট প্রধান অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ আল ফারুক বলেন, ‘ইংরেজি মাধ্যমের কিছু শিক্ষার্থী বাংলা ভাষার প্রশ্নে পরীক্ষা দিতে চেয়েছিলেন। তাই তাদের জন্য প্রশ্নপত্র নিয়ে সমাজবিজ্ঞান অনুষদে গিয়েছিলেন খসরুল কুদ্দুসী। ইউনিট প্রতিনিধি হিসেবে ওই কেন্দ্রের তত্ত্বাবাধানের জন্য তাকে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু আমাকে পরীক্ষার সময় কেউ বিষয়টি জানাননি। লিখিতভাবেও অভিযোগ দেয়া হয়নি।’
বিকালের শিফটের পরীক্ষায় ৯৯টি প্রশ্ন : একই ইউনিটের দ্বিতীয় শিফটের ভর্তি পরীক্ষায় সাধারণ জ্ঞান অংশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু সংক্রান্ত একটি প্রশ্নে কোন সঠিক উত্তর ছিল না। প্রশ্নে ছিল- ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ২৯তম অধিবেশনে বাংলায় বক্তৃতা দেন কোন সালের কোন তারিখে?’ উত্তরের চারটি অপশনে- অক্টোবর মাসের বিভিন্ন তারিখ ছিল। সঠিক উত্তর ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর কোথাও ছিল না। সাধারণ জ্ঞানের সর্বমোট ১৯টি প্রশ্নের বিবেচনা করে মোট ফল প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এক্ষেত্রে এ অংশের ১৯ নাম্বারের মধ্যে শিক্ষার্থীদের প্রাপ্ত নাম্বারকে আবার ২০ নম্বরে গড় করা হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই জ্যেষ্ঠ শিক্ষক বলেন, ‘এখানে ভুল হয়েছে শুধু সাধারণ জ্ঞান প্রশ্নে। এর সাথে আরো ঐচ্ছিক বিষয় অর্থনীতি ও গণিত বিষয়ের উত্তর দেওয়ার সুযোগ ছিল শিক্ষার্থীদের। সকালের শিফটের শিক্ষার্থীরা, বিকালের শিফটে সাধারণ জ্ঞানের পরিবর্তে অর্থনীতি ও গনিত বিষয়ে উত্তর দেয়া শিক্ষার্থীরা ২০টি উত্তর দেওয়া সুযোগ পাচ্ছেন। কিন্তু বিকালের শিফটে সাধারণ জ্ঞান উত্তর দেওয়া শিক্ষার্থীরা ১৯টি প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন। এখানেও গড় করলে নম্বর বাড়বে বা কমবে। আর এসব প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় দশমিক ২৫ এর জন্যও চান্স পান না অনেক শিক্ষার্থীরা। এর দায় কে নেবে?’
ফের পরীক্ষার সিদ্ধান্তে বৈষম্যের আশঙ্কা : এদিকে পরীক্ষা অংশ নেওয়া ৪৪ হাজার ৯৯০ জন্য মধ্যে মাত্র ৪১৬ জন শিক্ষার্থীর পুনঃপরীক্ষা নেওয়া হলে বৈষম্যের সৃষ্টি হবে বলে মত দিয়েছেন বিশ^বিদ্যালয়ের একাধিক জ্যেষ্ঠ শিক্ষক। তাদের মতে, ‘শুধুমাত্র কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থীর পুনরায় পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্তটি আইনসিদ্ধ নয়। এটিকে চ্যালেঞ্জ করার যতেষ্ট যুক্তি রয়েছে। প্রশ্নের একই ধরনের মান ধরে রাখা সম্ভব নয়। প্রশ্ন সহজ হলে এই ৪১৬ জন লাভবান, বাকি ৪৪ হাজার বৈষম্যের শিকার হবে। আর কঠিন হলে এই ৪১৬ জন বৈষম্যের শিকার হবেন এবং বাকী ৪৪ হাজার লাভবান হবেন। এখানে শিক্ষার্থীদের কোন পক্ষের ভুল নেই। প্রশাসনের ভুলে শিক্ষার্থীরা কেন বৈষম্যের শিকার হবেন? এটি নিয়ে আদালত পর্যন্ত যাওয়ার গ্রাউন্ড আছে শিক্ষার্থীদের। তাই বিষয়টি আরেকবার নিয়ে চিন্তা করা উচিত। আর এই ৪১৬ জন শিক্ষার্থী প্রশ্নের মান সম্পর্কে ধারণা পেয়েছেন এবং আবার প্রস্তুতির সময় পাচ্ছেন।’
এ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার সাধারণ প্রশ্নে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, ‘ইংরেজি মাধ্যমে বেশিরভাগ শিক্ষার্থী মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত পরিবারের। তাদের ক্ষেত্রে সমস্যা হওয়ায় আবার পরীক্ষা নেওয়া হবে শুধু তাদেরই। কিন্তু আমরা এখানে বৈষম্যের শিকার হবো। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ন্যাশনাল কারিকুলামের শিক্ষার্থীদের বাদে বাকীদের ফলাফল প্রকাশ করে উত্তীর্ণদের বাছাই করতে পারে। ওই ৪১৬ জন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আগের পরীক্ষা শুধুমাত্র উত্তীর্ণদের আবার পরীক্ষার ব্যবস্থা করলে বিষয়টি ন্যায়সঙ্গত ও গ্রহণযোগ্য হবে। গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি পরীক্ষায় এটি অনুসরণ করা হয়।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন ও অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. গাজী সালেহ উদ্দন বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের একাংশের আবার পরীক্ষা নেওয়া হলে প্রশ্নের মান একই হবে না। এখানে পরিষ্কার বৈষম্য হবে। যে কেউ চাইলেই চ্যালেঞ্জ করতে পারেন। আর আমি শুনেছি, ওই পরীক্ষায় বাংলা আবশ্যক ছিল না বলে পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে। আমাদের সময় এসব ছিল না। এটিতো রাষ্ট্রের নীতি বিরোধী।’
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বক্তব্য : এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (দায়িত্বপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার বলেন, ‘আমাকে কয়েকজন অভিভাবক বিষয়টি জানিয়েছেন। তাই আমরা পরীক্ষা কমিটির সকলের সঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নিয়েছি কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থীর আবার পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমাদের কেউ অভিযোগ করেননি। তাও যেন কোন প্রশ্ন না ওঠে, তাই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
‘ডি’ ইউনিটের প্রধান অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ আল ফারুক বলেন, ‘বিষয়টি আমাদের ভুল, আমরা এজন্য দুঃখ প্রকাশ করছি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও আটটি শিফটে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে। এখানে আমরা প্রশ্নের মান ঠিক রাখবো। এ পুনঃপরীক্ষাকে তৃতীয় শিফট হিসেবে গণ্য করা হবে। এখানে কোন বৈষম্য হবে না।’